জি-৭ সম্মেলন সামনে রেখে মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট এল ইয়েলেন বিরলভাবে ইসরায়েলকে তিরস্কার করে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ইসরায়েল ফিলিস্তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৈশ্বিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করার যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তা পশ্চিম তীরের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।
তবে মনে হচ্ছে, অনেক দেরি হয়ে গেছে। পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) ইতিমধ্যে সীমিত হয়ে পড়া স্বশাসনের শেষ চিহ্নগুলোকে আরও ছেঁটে ফেলতে মরিয়া হয়ে ওঠা ইসরায়েলি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচকে থামাতে ইয়েলেনের এই তিরস্কার কোনো কাজে আসছে বলে মনে হচ্ছে না।
স্মোত্রিচ মূলত যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চান, তা হচ্ছে ইসরায়েলি ব্যাংকগুলোকে কোনো ধরনের আইনি পদক্ষেপের মুখে পড়ার ভয় ছাড়াই ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে লেনদেন করতে দেওয়ার সুযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া।
অর্থাৎ ফিলিস্তিনিদের ব্যাংক লেনদেন থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও স্পেন আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণার প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্মোত্রিচ এই ঘোষণা দিয়েছেন।
অথচ ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড এবং বিশ্বের নিষ্ক্রিয়তার কারণে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ একেবারে ভেঙে পড়ার মুখে রয়েছে।
ইয়েলেন বুঝতে পারছেন, ফিলিস্তিনের ওপর স্মোত্রিচের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিকল্পনাকে শুধু ইসরায়েলের ইতিহাসের সবচেয়ে আগ্রাসী ও দখলদার সরকারের আদর্শগত ভিত্তির জন্য দায়ী করা যায় না।
দ্রুত যুদ্ধ শেষ করার জন্য বৈশ্বিক চাপের মধ্যেও গাজায় দ্বিগুণ শক্তিতে হামলা করে ইসরায়েল যে বিচ্ছিন্নতার দিকে যাচ্ছে, এটি তারও ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তবে ইসরায়েলের প্রতি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ধারাবাহিক সমর্থনের কারণে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের আর্থিক সামর্থ্য কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, সে সম্পর্কে বাইডেনকে ধারণা দিতে ইয়েলেনের এই উদ্বেগকে বৈধ বলেই মনে হচ্ছে।
পশ্চিম তীরের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করলেও পশ্চিম তীরে (এবং অন্যত্র) বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা গাজার চলমান বিপর্যয়কর যুদ্ধের দিকেই তাদের চোখ স্থির করে রেখেছেন।
গাজা যুদ্ধের কারণে কী অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ইসরায়েলের ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল হয়ে থাকা পশ্চিম তীর ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে, তা নিয়ে খুব কম পর্যবেক্ষকই উদ্বেগ বা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
এই অসম সম্পর্কের মধ্যে কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলের দখলদারি চলে আসছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের জমি, সম্পদ ও অধিকারের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
তাদের ওপর চরমপন্থী ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা ক্রমবর্ধমানভাবে সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘকাল ধরে তারা এসব অন্যায় থেকে দায়মুক্তি ভোগ করছে।
ফিলিস্তিনকে একচেটিয়াভাবে নির্ভরশীল করে রাখার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকে। ইসরায়েল ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হয়ে শুল্ক ও আমদানি কর আদায় করে।
স্মোত্রিচ যখন দেখলেন ফিলিস্তিন সংকটের একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির দিকে গতি বাড়ানোর জন্য ইউরোপীয়রা সক্রিয় হয়েছে, তখনই তিনি শুল্ক–রাজস্ব বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেন এবং নতুন আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দেন।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ শুল্ক হিসেবে প্রতি মাসে ২৭ কোটি মার্কিন ডলার রাজস্ব পেয়ে আসছিল। এই অর্থ দিয়ে ফিলিস্তিনের ১ লাখ ৪৭ হাজার সরকারি কর্মচারীর বেতন দেওয়া হচ্ছিল।
মূলত এই অর্থ দিয়েই ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের চাহিদা মেটানো হচ্ছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ইসরায়েল একতরফা সিদ্ধান্তে ফিলিস্তিনিদের সেই নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ ও স্বাস্থ্যবিলের অর্থ কাটছাঁট করেছে।
২০১৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনি শহীদদের পরিবার এবং ইসরায়েলি জেলে বন্দী থাকা ফিলিস্তিনিদের পরিবারের প্রাপ্য সরকারি সহায়তাও কেটে নেওয়া হয়। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ এই অতিরিক্ত কেটে নেওয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় ১২০ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়।
গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর স্মোত্রিচ গাজায় ফিলিস্তিনের কর্মী এবং পেনশনভোগীদের জন্য ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ যে অর্থ খরচ করে তা, কমাতে শুরু করে।
চলতি বছরের এপ্রিলের মধ্যে ব্যক্তিগত ভোগ এবং আমদানিতে ব্যাপক পতন ঘটে। এর ফলে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ‘বৈধ’ রাজস্ব মাসে ১০ কোটি ডলারের নিচে নেমে আসে। অর্থাৎ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মাসিক বাজেটের এক–চতুর্থাংশের কাছাকাছি অর্থ কমে গেছে।
স্মোত্রিচ এখন এই অর্থও বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দিয়েছেন। এই অর্থ ইসরায়েলি অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে। বাজেয়াপ্ত এই ইসরায়েলের যুদ্ধ তহবিলে স্থানান্তর করতে আইন পাস করার জন্য তিনি চাপ দিচ্ছেন।
আর্থিকভাবে ইসরায়েল তার স্ক্রুগুলোকে আরও টাইট করার জন্য ফিলিস্তিনি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নেওয়া বৈদেশিক মুদ্রাকে ইসরায়েলি শেকেলে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত আটকে রেখেছে।
এর ফলে ইসরায়েলি শেকেল জমা করতে না পারা গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এদিকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীন কর্মচারীদের বেতন ছয় মাস ধরে বাকি পড়ে গেছে। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ আর্থিক পতনের মুখে পড়ে গেছে।
ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মুস্তফা সম্প্রতি বলেছেন পশ্চিম তীর ‘খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে এবং সেখানে যেকোনো সময় গণবিস্ফোরণ ঘটার ঝুঁকি’ রয়েছে।
বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে গদিতে বসার প্রথম দিকে কেউ কেউ আশা করেছিলেন, তিনি ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে কাজ করবেন। কিন্তু তিনি তাঁদের আশাভঙ্গ করেছেন। তবে এখন ইউরোপের কিছু দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করতে চায় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন তাদের কাছে যুদ্ধের বিষয়ের চেয়ে বেশি কিছু, তাহলে তাকে অবশ্যই ফিলিস্তিনের যোগ্য রাষ্ট্র হওয়ার পথে দেওয়া ভেটো তুলে নিতে হবে।
জি-৭ এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ করা আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী গত সপ্তাহে বৈঠকে মিলিত হয়েছিল।
তাঁদের এই অবস্থাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করতে হবে। এর বাইরে নীতিনির্ধারকদের কী করা যেতে পারে এবং কী করা ঠিক হবে না, সেদিকে স্পষ্ট দৃষ্টি রাখতে হবে।
বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে গদিতে বসার প্রথম দিকে কেউ কেউ আশা করেছিলেন, তিনি ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে কাজ করবেন। কিন্তু তিনি তাঁদের আশাভঙ্গ করেছেন।
তবে এখন ইউরোপের কিছু দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করতে চায় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন তাদের কাছে যুদ্ধের বিষয়ের চেয়ে বেশি কিছু, তাহলে তাকে অবশ্যই ফিলিস্তিনের যোগ্য রাষ্ট্র হওয়ার পথে দেওয়া ভেটো তুলে নিতে হবে।
রাজা খালিদি প্যালেস্টাইন ইকোনমিক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এমএএস) মহাপরিচালক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত