তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সর্বশেষ মস্কো সফরে ইউক্রেনের সঙ্গে শস্যচুক্তির ব্যাপারে মস্কোর আপত্তিগুলোও নিষ্পত্তি হবে—এ রকম উচ্চ প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী এরদোয়ান কৃষ্ণসাগরের বন্দর দিয়ে শস্যবাহী জাহাজ চলাচল চালু করাতে ব্যর্থ হলেও, একেবারেই খালি হাতে ফিরছেন না।
খাদ্য থেকে জ্বালানি—সবকিছুর ক্ষেত্রে তুরস্ক প্রধান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার ক্ষেত্রে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয়েই অনিশ্চয়তা আছে, সেটা হলো কত সময়ের মধ্যে তুরস্ক প্রধান আঞ্চলিক শক্তি হয়ে উঠতে পারবে।
জুলাই মাসে কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছিল রাশিয়া। এর পর থেকে এরদোয়ান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য বলে আসছেন। সোচি সম্মেলনে এরদোয়ান বলেন, শস্য চলাচলের পথ খোলার বিষয়ে বিশ্ব ব্যাকুল আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। এর আগে, গত মাসে রাশিয়া ও তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে শস্যচুক্তি প্রধান আলোচ্য সূচি ছিল।
শস্যচুক্তিতে রাশিয়াকে ফিরিয়ে আনা তুরস্কের প্রেসিডেন্টের জন্য অগ্রাধিকারের বিষয়। ২০২২ সালের জুলাই মাসে রাশিয়া, ইউক্রেন, তুরস্ক ও জাতিসংঘের মধ্যে যে শস্যচুক্তি হয়েছিল, তাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল আঙ্কারা। এ চুক্তি তুরস্ককে শস্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ট্রানজিটে পরিণত করেছিল। শস্যচুক্তির কারণে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছিল তুরস্ক।
পুতিন কিংবা এরদোয়ান তাঁদের সম্পর্ককে রাশিয়া ও তুরস্কের জনগণের মধ্যে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে কতটা কাজে লাগাচ্ছেন, সেটা খুব বড় বিবেচনার বিষয় নয়। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে অবধারিতভাবে অর্থনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি হতেই থাকবে। বিশ্বে জ্বালানির অন্যতম বড় উৎপাদক রাশিয়ার ইউরোপে হারানো বাজারের বিকল্প হিসেবে তুরস্ককে প্রয়োজন। আর মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার মাধ্যমে তুরস্ক অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে।
পুতিনের জন্যও একটি স্বার্থ রয়েছে। তাঁর জন্য তুরস্কের সঙ্গে দর-কষাকষির ভালো একটা উপায় হলো জ্বালানি। এরদোয়ানের সঙ্গে বৈঠকের পর পুতিন বলেন, ‘তুরস্কে যদি প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি হাব গড়ে তোলা যায়, তাহলে সেটা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করবে।’
শস্যের প্রতি এরদোয়ানের আকৃষ্ট হওয়ার কারণ যেমন নগদ অর্থ, জ্বালানির ওপর পুতিনের আকৃষ্ট হওয়ার কারণও তেমন অর্থ। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ইউরোপের বাজারে রাশিয়ার গ্যাস প্রবেশ করত জার্মানি হয়ে। বর্তমান রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনটি বন্ধ হয়ে গেছে। খুব শিগগির সেটা খুলবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ কারণেই জ্বালানি রপ্তানির জন্য মস্কোর নতুন অংশীদার দরকার।
পুতিনের অগ্রাধিকারে জ্বালানি আর সেটা থেকে নিশ্চিতভাবেই লাভবান হবে তুরস্ক। দেশটির অর্থনীতি চরম প্রতিকূলতার মধ্যে রয়েছে। গত মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫৮ দশমিক ৯ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরের পর যেটি ছিল সর্বোচ্চ। একপ্রকার মরিয়া হয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে তুরস্ক। তুরস্কে রাশিয়ার জ্বালানির হাব গড়ে তোলা সময়সাপেক্ষ। কিন্তু শস্যচুক্তি করা গেলে তার ফলটা খুব দ্রুত পাওয়া যাবে।
এই বিরোধ কীভাবে কমিয়ে আনা যাবে, সেটাই এখন পুতিন ও এরদোয়ানের সবচেয়ে বড় দর-কষাকষি করার ক্ষেত্র।
পুতিন বলেছেন, শস্যচুক্তি তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত নবায়ন করবেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্ব তাঁর দাবি মেনে না নেয়। পুতিনের দাবি হচ্ছে, তাঁদের কৃষিপণ্য রপ্তানির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, সেটা যেন প্রত্যাহার করা হয়, রাশিয়ার কৃষি ব্যাংককে আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা সুইফটের সঙ্গে যুক্ত করা। মস্কোর দাবির কোনো ভিত্তি নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব।
পশ্চিমাদের এই একগুঁয়েমি পুতিনকে খেলার সুযোগ করে দিচ্ছে। এরদোয়ানের সঙ্গে বৈঠকের পর পুতিন দাবি করেছেন, পশ্চিমাদের কাছে তিনি ‘প্রতারিত’ হয়েছেন। পুতিনের এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে শস্যচুক্তির মতো মানবিক কাজের বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ব্যাপারটি বাস্তবে কোনো দিনই সম্ভবপর নয়। এই বছর এ পর্যন্ত সপ্তমবারের মতো দাবি করলেন, পশ্চিমাদের কাছে প্রতারিত হয়েছেন তিনি।
লোকপ্রচারের দিক থেকে পুতিন সেরা। আগামী বছর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ভোটারদের উদ্দেশে তিনি এগুলো বলছেন। ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের নেতৃত্বে ভাগনার বিদ্রোহের পর পুতিনের জনপ্রিয়তা ১৪ শতাংশ কমে যায়। ফলে জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারে তিনি ভিকটিম কার্ড খেলতে শুরু করেছেন।
এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে এরদোয়ানের সঙ্গে পুতিন কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারলে তার পুরো কৃতিত্ব নেবে ক্রেমলিন। পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। এ কারণে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে এরদোয়ানকে মস্কো যেতে হবে। এ বিষয়ও ক্রেমলিনকে বাড়তি সুবিধা দেবে।
পুতিন কিংবা এরদোয়ান তাঁদের সম্পর্ককে রাশিয়া ও তুরস্কের জনগণের মধ্যে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে কতটা কাজে লাগাচ্ছেন, সেটা খুব বড় বিবেচনার বিষয় নয়। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে অবধারিতভাবে অর্থনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি হতেই থাকবে। বিশ্বে জ্বালানির অন্যতম বড় উৎপাদক রাশিয়ার ইউরোপে হারানো বাজারের বিকল্প হিসেবে তুরস্ককে প্রয়োজন। আর মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার মাধ্যমে তুরস্ক অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে।
সোচিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে শস্যচুক্তি না হওয়ায় একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলো। কিন্তু এটাই পুরো গল্প নয়। মস্কো ও আঙ্কারা আরেকটি নতুন শস্যচুক্তি করতে চলেছে। সেখানে কাতার হতে চলেছে নতুন খেলোয়াড়। জ্বালানি সহযোগিতা মস্কো ও তুরস্কের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠবে।
পুতিন ও এরদোয়ানের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক দুই পক্ষের জন্যই লাভজনক। একজনের বন্ধু দরকার আর অন্যজনের দরকার শস্য ও গ্যাস। সোচিতে নিরাশা তৈরি হলেও, দুজনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হতে চলেছে।
নিকোলাই মিকোভিচ সার্বীয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত