নতুন কংগ্রেস সভাপতির মুকুট ফুলের না কাঁটার?

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নবনির্বাচিত সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে
ছবি : রয়টার্স

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নবনির্বাচিত সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বুধবার, ২৬ অক্টোবর, আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। দীপাবলি এবং নতুন সভাপতির অভিষেক পর্ব উপলক্ষে ভারত জোড়ো যাত্রায় তিন দিনের বিরতি পেয়ে দিল্লিতে এসে খাড়গের অভিষেক পর্বে হাজির থাকবেন রাহুল গান্ধী। সভাপতি নির্বাচন ঘিরে তেমন কোনো চমক ছিল না। কংগ্রেসের ‘ফার্স্ট ফ্যামিলি’ চেয়েছে, তাই অশীতিপর খাড়গে জিতেছেন। দল পরিচালনায় এখন তিনি কোনো চমক দেখাতে পারেন কি না, কৌতূহল তা নিয়ে।

কৌতূহলের কারণ অনেক। প্রথম কারণ, কুড়ি বছর পর নির্বাচন হওয়া। নির্বাচনের স্ক্রিপ্ট যতই আগে থেকে লেখা থাকুক না, চ্যালেঞ্জার হিসেবে শশী থারুর কত ভোট টানেন, সেটা ছিল স্বাভাবিক আগ্রহ।

২০ বছর আগে সোনিয়ার বিপরীতে দাঁড়িয়ে জিতেন্দ্র প্রসাদ যেখানে ১০০ ভোটও টানতে পারেননি, শশী থারুর সেখানে সহস্রাধিক ভোট সংগ্রহ করে বোঝালেন, দলের স্বার্থে যেসব সংস্কারের কথা তাঁরা বলে আসছেন, তাতে অনেকের সায় রয়েছে। সেই সংস্কারের পথে নতুন সভাপতি হাঁটেন কি না—প্রথম কৌতূহল।

দ্বিতীয় কৌতূহল খাড়গেকে নিয়ে। ভোটের আগেই তিনি জানিয়েছিলেন, দলের স্বার্থে গান্ধী পরিবারের পরামর্শ সব সময় নেবেন। দলের জন্মাবধি যে পরিবার যাবতীয় ভালোমন্দের সঙ্গে জড়িত, যাঁদের এত অবদান ও ত্যাগ স্বীকার, তাঁদের উপেক্ষা করা মূর্খতা। অনুগত থেকেও খাড়গে কতটা স্বাধীনভাবে দল পরিচালনা করতে চাইবেন ও পারবেন, সেটাও অবশ্যই এক কৌতূহল।

বিশেষ করে মনোনীত হওয়া ইস্তক ‘রবার স্ট্যাম্প’ ও ‘রিমোট কন্ট্রোল’ শব্দ দুটি যখন তাঁকে ঘিরে আবর্তিত। খাড়গের কাছে এই শব্দদ্বয় অসম্মানজনক হলে এক কথা, না হলে অন্য। কীভাবে তিনি পরিচিত হবেন বা হতে চাইবেন, নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করাবেন কি না, তাঁর ব্যাপার। এই দায়িত্ব তাঁর নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করারও একটা সুযোগ এনে দিয়েছে।

তৃতীয় কৌতূহল, যে কারণে ২০ বছর পর এই ভোট, নতুন সভাপতি সেই চাহিদা কতটা মেটাতে পারবেন, তা ঘিরে। তিন বছর ধরে সংগঠনের সর্বস্তরে নির্বাচনের দাবি (থারুরও সেই দাবিদারদের অন্যতম) খাড়গে মানবেন কি? তিনি চাইলেও গান্ধী পরিবার এবং এযাবৎকালের দাক্ষিণ্যভোগীরা তা হতে দেন কি না, সেটা বড় আকর্ষণ। মনোনয়নের বদভ্যাস বনাম নির্বাচন, এটা কংগ্রেসে আগামী দিনের অনিবার্য দ্বৈরথ।

নিচুতলার কর্মীরা হতোদ্যম। হয় বসে গেছে নতুবা দলত্যাগ করেছে। বুথ স্তরে কমিটি করার উপায় পর্যন্ত অন্তর্হিত প্রায় গোটা আর্যাবর্তে। হিন্দি বলয়ের কাছে অচেনা ৮০ বছর বয়স্ক কোনো দক্ষিণি নেতার কাছে এত অল্প সময়ে এই বিপুল কর্মযজ্ঞ সারা কি সম্ভব? সেই জেদ, তেজ, অভীপ্সা ও শারীরিক শক্তি কি তাঁর আছে? প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক। জবাবের জন্য খাড়গের হাতে সময় কিন্তু বেশি নেই। মুকুট ফুল না কাঁটার, জানতে পারবেন অচিরেই।

মনে রাখতে হবে, একটা সময় রাহুল নিজেই কিন্তু ‘বাস্তুঘুঘুদের’ বাসা ভাঙতে ব্লক স্তর থেকে নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়ার আদলে ভোট করার কথা শুনিয়েছিলেন। এখন তাঁর মন ও মত বদল হয়েছে কি না, জানা নেই। এই সব কৌতূহলের নিরসনের ওপর কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ বহুলাংশে নির্ভরশীল।

চতুর্থ কৌতূহলটি থারুরের ভবিষ্যৎ নিয়ে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর কেউ কেউ তাঁকে ‘ধারাবাহিকতার স্বার্থে’ সরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। ভোটাভুটি এড়িয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি বেছে নেওয়ার পক্ষে ছিলেন তাঁরা। বলেছিলেন, সবার জন্য ওটাই ‘মঙ্গলজনক’। ওটাই দলের ঐতিহ্য।

থারুর মানেননি। প্রচারের সময় ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ না থাকায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছেন। এমনকি ভোটে কারচুপিরও। ভোট মিটতে প্রত্যাশিত পাটকেল তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে তিনি ‘দুমুখো’। দলে এক কথা বলেছেন, মিডিয়ায় অন্য কথা। অতীতে ভোটে আগ্রহী চ্যালেঞ্জারদের রাজনৈতিক ভাগ্য যেভাবে বদলেছে, যেভাবে স্থিতাবস্থা রক্ষাকারী অনুগতরা সমস্বরে ‘বিদ্রোহীদের’ কোণঠাসা করতে চেয়েছেন, শশী থারুরের ভাগ্যে তেমন কিছু রয়েছে কি না, জানতে অপেক্ষায় থাকতে হবে। দেখতে হবে, অনুগতরা থারুরকে ব্রাত্য করতে চাইলে পরিবার তাতে সায় দেয় কি না। খাড়গে নিজেও থারুরকে সঙ্গী করতে আগ্রহী হন কি না, দেখতে হবে।

হারার পর থারুর নিজে ‘নতুন সভাপতি প্রবীণ, অভিজ্ঞ ও স্থিতধী’ বলে জানিয়েছেন, ‘তাঁর নেতৃত্বে আমরা সবাই মিলে দলকে নতুন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করতে পারব।’ অর্থাৎ বুঝিয়েছেন, নতুন টিমের সদস্য হতে তিনি আগ্রহী। নেতৃত্বের ভাবনা ইতিবাচক হলে থারুরদের সঙ্গে নিয়ে কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়ানোর রাস্তায় পা ফেলতে পারে। নেতিবাচক হলে সেই ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’।

জিতলে কী করতেন শশী, সে কথা নির্বাচনী ইশতেহারে জানিয়েছিলেন। দল ছেড়ে বিজেপির দিকে যাঁরা পা বাড়িয়েছেন, তাঁদের ঘরে ধরে রাখা। খাড়গেরও প্রথম কাজ সেটাই হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে তাঁকে দ্রুত সমাধান করতে হবে রাজস্থান নামক ধাঁধার। মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট ও প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস নেতা শচীন পাইলটের দূরত্ব মেটানো বৃত্তকে চতুষ্কোণে পরিণত করার মতোই কঠিন। অথচ দুজনই দলের সম্পদ। আগামী বছরের শেষে রাজস্থানে ভোট। উজ্জ্বল কংগ্রেস জেগে রয়েছে এই রাজস্থান ও ছত্তিশগড়েই। অন্যত্র টিমটিমে।

এটা এখন নিশ্চিত, ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত খাড়গের হাতেই সরকারিভাবে থাকবে দল পরিচালনার ব্যাটন। এ সময়ের মধ্যে ১১টি রাজ্যে বিধানসভার ভোট হবে, যার অন্যতম তাঁর নিজের রাজ্য কর্ণাটক। বিজেপির হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার একটা সুযোগ এই রাজ্যে কংগ্রেসের সামনে রয়েছে। দল যদিও প্রদেশ সভাপতি ডি কে শিবকুমার ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধারামাইয়ার মধ্যে বিভাজিত। সভাপতি হিসেবে খাড়গের গুরুদায়িত্ব শ্যাম ও কুল দুটোই রক্ষা করা।

সেটা পারার ক্ষমতা খাড়গের আছে। কারণ, তিনি বিতর্কিত নন। ঠান্ডা মাথার মানুষ বলে পরিচিত। সবার সঙ্গে মেশার একটা সহজাত ক্ষমতা তাঁর আছে। জোট রাজনীতির আবহে তাঁর জয় তাই অবশ্যই কংগ্রেসের পক্ষে ভালো খবর। তাঁর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে কারণ, দলত্যাগীদের অভিযোগ, নেতৃত্বের কাছে পৌঁছানোই নাকি এক বিরাট ঝক্কি! মাসের পর মাস প্রতীক্ষায় থাকতে হয়! আসামের নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মা প্রথম প্রকাশ্যে এই অভিযোগ তুলে দলত্যাগ করেছিলেন। তাঁর পর একে একে বহু। খাড়গেকে এই অভিযোগ দূর করতে হবে দ্রুত।

কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ও সংসদীয় বোর্ডের গঠন কোন প্রক্রিয়ায় হবে, নির্বাচনের মাধ্যমে নাকি মনোনয়নের মধ্য দিয়ে ‘অ্যাডহক’ পদ্ধতিতে, সেই সিদ্ধান্তও তাঁকে নিতে হবে। একইভাবে ঠিক করতে হবে, প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিগুলো কীভাবে পুনর্গঠিত হবে। দিল্লির চাপিয়ে দেওয়া চিরকালীন পদ্ধতি মেনে, নাকি নতুন গণতান্ত্রিক উপায়ে। কংগ্রেস সেবা দল, শ্রমিক সংগঠন আইএনটিইউসি, যুব কংগ্রেস বা ছাত্রসংগঠন এনএসইউআই বছরের পর বছর অকর্মণ্য নিস্তেজ পড়ে আছে।

নিচুতলার কর্মীরা হতোদ্যম। হয় বসে গেছে নতুবা দলত্যাগ করেছে। বুথ স্তরে কমিটি করার উপায় পর্যন্ত অন্তর্হিত প্রায় গোটা আর্যাবর্তে। হিন্দি বলয়ের কাছে অচেনা ৮০ বছর বয়স্ক কোনো দক্ষিণি নেতার কাছে এত অল্প সময়ে এই বিপুল কর্মযজ্ঞ সারা কি সম্ভব? সেই জেদ, তেজ, অভীপ্সা ও শারীরিক শক্তি কি তাঁর আছে? প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক। জবাবের জন্য খাড়গের হাতে সময় কিন্তু বেশি নেই। মুকুট ফুল না কাঁটার, জানতে পারবেন অচিরেই।

অজাতশত্রু এই কান্নাডিগার পক্ষে সুখবর, ভারত জোড়ো যাত্রা আশাতীত সাড়া ফেলেছে। দলটা চনমনে হয়ে উঠছে। তাঁকে হতে হবে ‘ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার’।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি