মেট্রোরেল নিয়ে আমি অত্যন্ত আশাবাদী। এই ট্রেন শুধু একটি অবকাঠামো প্রকল্প অথবা যাত্রার মাধ্যম নয়।
মেট্রোরেল নিয়ে আমি অত্যন্ত আশাবাদী। এই ট্রেন শুধু একটি অবকাঠামো প্রকল্প অথবা যাত্রার মাধ্যম নয়।

মতামত

মেট্রোরেলে যে বিপত্তিগুলো আমাদের ভোগাচ্ছে

শনিবার দুপুর। তেমন ভিড় ছিল না ট্রেনে। তবে আসনগুলো পরিপূর্ণ। মতিঝিল থেকে ছেড়ে আসা মেট্রোরেলটি শাহবাগ স্টেশনে থামতেই উঠলেন বোরকা পরা পঞ্চাশোর্ধ্ব এক নারী; সঙ্গে স্বামী। স্বামীর এক হাত ধরে যেভাবে কামরায় প্রবেশ করলেন, তাতে বোঝা যাচ্ছিল তিনি অসুস্থ। সম্ভবত ডাক্তার দেখিয়ে ট্রেনে উঠেছেন। হয়তো যানজট এড়িয়ে একটু আরামদায়কভাবে দ্রুত বাড়ি ফিরতেই উঠেছিলেন ট্রেনে। উঠেই তাকালেন চারদিকে কোনো আসনে বসা যায় কি না। ভদ্রলোক স্বামী বেচারাও তাকালেন চারদিকে, অসুস্থ স্ত্রীর জন্য কোনো আসন মেলে কি না। কিন্তু না! যাত্রীদের কেউ ভ্রুক্ষেপ করলেন না। কেউবা সিটে জানালার সমান্তরালে বসে সেলফি নিচ্ছেন; কেউ নিমগ্ন হয়ে ফেসবুকিং করছেন। আবার কেউ কেউ ইউটিউব চালিয়ে বুঁদ হয়ে রয়েছেন।

উপায়ান্তর না দেখে কামরার মাঝখানের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা। ২ ফুট দূরে আমিও দাঁড়িয়ে। লক্ষ করছিলাম তাঁকে। দুহাতে শক্ত করে ধরলেন স্টেনলেস স্টিলের পিচ্ছিল হাতল। দুহাত জড়িয়ে মা যেমন সন্তানকে বুকে জড়িয়ে রাখেন সেভাবেই ধরলেন হাতল। যেন পড়ে না যান সেই চেষ্টা। ট্রেন ছুটে চলল। দুই হাতের পর এবার চোখ বন্ধ করে মাথাটি ঠেকিয়ে রাখলেন হাতলে।

এক মিনিটের মধ্যে কারওয়ান বাজার পৌঁছানোর আগেই সবাইকে প্রত্যক্ষ করতে হলো এক কষ্টকর দৃশ্য। পিচ্ছিল হাতল থেকে পানির ফোঁটা যেভাবে নিচের দিকে নেমে আসে ঠিক সেভাবেই ভদ্রমহিলার কপালটি হাতল বেয়ে নিচের দিকে নেমে আসতে থাকল। পাশে দাঁড়ানো কিংকর্তব্যবিমূঢ় স্বামী কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রেনের মেঝেতে বসে পড়লেন ওই ভদ্রমহিলা। তবে শক্ত করে হাতল ধরে রাখার কারণেই রক্ষা পেলেন বড় বিপদ থেকে। এবার হুঁশ হলো অনেকের। আসন ছেড়ে দিলেন কয়েকজন। যাঁরা ছেড়ে দিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই সুস্থ-সবল যুবক। আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার।

ওই ঘটনার পর লক্ষ করলাম, যে আসনটি ভদ্রমহোদয়েরা ছেড়ে দিলেন, সেগুলো ছিল প্রাধান্য আসন। অর্থাৎ, এগুলো কেবল অসুস্থ, বয়স্ক, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, গর্ভবতী নারী, সন্তান কোলে ভ্রমণকারীদের জন্য নির্ধারিত। যেখানে ওই ভদ্রমহিলার বসা একটি অধিকার। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে দেখেছি, ভিড় থাকলেও প্রাধান্য আসনগুলো ফাঁকা থাকে। আমাদের এখানে থাকে না। কেন ফাঁকা থাকে না, সেটি আমরা সবাই কমবেশি বুঝি। আমার লেখার উদ্দেশ্য সেই কারণ বিশ্লেষণ নয়।

মেট্রোরেল নিয়ে আমি অত্যন্ত আশাবাদী। এই ট্রেন শুধু একটি অবকাঠামো প্রকল্প অথবা যাত্রার মাধ্যম নয়। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের মানুষকে একটি সাম্যবাদী ব্যবস্থার ধারণা দিয়েছে। ধনী-গরিব, মন্ত্রী-এমপি, মেজর জেনারেল-সচিব সবার জন্য একই নিয়ম মেট্রোরেলে। সুন্দর নিয়ম মেনে সবাই চলাচল করছেন। স্টেশনে কোনো ময়লা নেই। সবকিছু পরিষ্কার।

কিন্তু এর মধ্যেও রয়েছে কিছু অসংগতি, যেগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

পল্লবী এলাকার একজন বাসিন্দা হওয়ায় শুরু থেকে মেট্রোরেলের একজন নিয়মিত যাত্রী আমি। সেই সুবাদে এ বিষয়ে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে, যা সাংবাদিক হিসেবে মানুষের সামনে তুলে ধরা আমার দায়িত্ব বলে মনে করি। যেগুলো পালন করলে আরেকটু সুন্দর হয় আমাদের মেট্রোযাত্রা। কোনো বিনিয়োগ দরকার নেই। কোনো অবকাঠামোর প্রয়োজন নেই। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন প্রয়োজনমাত্র।

মাস তিনেক আগে হবে। পল্লবী থেকে উঠে বিজয় সরণি স্টেশনে নামতে দরজায় অবস্থায় নিয়েছি। হঠাৎ ‘ঢক’ করে একটি শব্দ। চমকে উঠলাম। বুঝতে পারলাম না কিসের শব্দ। ফিরে তাকাতেই দেখলাম ষাটোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে পড়ে গেছেন। মাথাটা আছড়ে পড়েছে ট্রেনের মেঝেতে। সবাই ধরাধরি করে বসিয়ে দিলেন পাশের একটি আসনে।

মেট্রোরেলে যাঁরা নিয়মিত চলাচল করেন, তাঁদের একটি বিরাট অংশ অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ রকমের সক্রিয়। বয়সে তরুণ নারী-পুরুষ। অধিকাংশের ঘাড়ে থাকে ব্যাগপ্যাক। কিন্তু এই ব্যাগগুলো যে অন্যদের জন্য একটি সমস্যার কারণ হচ্ছে সে বিষয়ে যেন কারও মাথাব্যথা নেই। ঘাড়ে ব্যাগ চেপেই ট্রেনে ওঠেন অধিকাংশ যাত্রী এবং ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলিয়েই দাঁড়িয়ে থাকেন। লক্ষ করেন না যে মেট্রোরেলের সীমিত স্থানের মধ্যে তিনি প্রায় দুজনের জায়গা ব্যবহার করছেন। স্টেশন থেকে ওঠানামার সময় ব্যাগগুলো যাত্রীদের পথ রুদ্ধ করে। দুই দিন আগে দেখলাম দুই মুখ করে দাঁড়ানো দুই যাত্রীর ব্যাগের মাঝখান দিয়ে নামতে না পেরে ঝগড়াঝাঁটি শুরু করে দিলেন এক যাত্রী। যাঁদের জন্য ওই যাত্রী নামতে পারলেন না সেই দুজন লজ্জিত না হয়ে উল্টো তর্ক শুরু করে দিলেন। একজন বললেন, ‘ব্যাগ ফেলে দেব?’

না, ব্যাগ ফেলে দিতে হবে না। যাত্রার সময় ব্যাগ থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যাগগুলো ঘাড়ে না রেখে যদি নিচে নামিয়ে রাখা হয় অথবা এক হাতে ব্যাগ ধরে পায়ের দিকে রাখা হয়, সে ক্ষেত্রে ব্যাগের জায়গায় আরেকজন মানুষ সুন্দরভাবে দাঁড়াতে পারেন, নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারেন। আমার মনে হয়, অন্যের অসুবিধা মাথায় রেখে আমাদের উচিত হবে, এ বিষয়ে একটুখানি সচেতন হওয়া। আমি মনে করি না যে আমাদের যাত্রীরা ইচ্ছে করে এমন করেন। আসল ব্যাপার হলো, চিন্তা করেন না যে তাঁদের সামান্য কোনো কাজ অন্যের সমস্যার কারণ হতে পারে।

তবে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের উচিত হবে ঘোষণা করা, যাত্রীরা যেন চলাচলের সময় ঘাড়ের ব্যাগ নামিয়ে রাখেন।

মেট্রোরেলের আসনে বসা নিয়ে আরেক সমস্যা! আপনি যদি মাঝরাস্তার কোনো স্টেশন থেকে উঠে কোনো আসন ফাঁকা পেয়ে যান, তখন দেখবেন আরেক প্রবণতা। বিষয়টি যদি এমন হয়, সাত সিটের আসনে আপনি ৭ নম্বর যাত্রী হয়ে বসতে যাচ্ছেন, তাহলে দেখবেন আগে থেকে বসে থাকা যাত্রীরা আপনার জন্য জায়গা ছাড়তে চাইবেন না। আপনাকে সর্বোচ্চ একটি সিটের অর্ধেক ছাড় দেবেন; তাঁরা সবাই নিজেদের পা ইংরেজি ‘ভি’ আকৃতি করে বসে থাকবেন। এই আকৃতিতে বসলে যে অপর যাত্রীদের স্থান সংকুলানে অসুবিধা হবে, সেটি নিয়ে ভাবনা নেই অনেকেরই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘ভাই সরে বসুন’ না বলা পর্যন্ত আপনি আপনার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা পাবেন না।

এখানেও আমাদের একটু সচেতন হতে হবে। ‘ভি’ আকৃতির পরিবর্তে ইংরেজি ‘এইচ’ আকৃতি করে বসলে সবাই সুন্দরভাবে বসতে ও চলাচল করতে পারবেন। মেট্রোরেলের যাত্রা সর্বোচ্চ আধঘণ্টার। এই সামান্য সময়ে খুব বেশি কি আরাম দরকার!

আসন না পেয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন, সেখান দেখবেন আরেক সমস্যা। কামরার ওপরের দিকে ঝোলানো হাতলের সংখ্যা যাত্রী সংখ্যার চেয়ে কম। সে কারণেই অনেক যাত্রী হাতল ধরতে পারেন না। ট্রেন চলার সময় হাতলের ওপর দিকের প্লাস্টিকের দড়িটি ধরে কামরায় শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করেন। কিন্তু দেখবেন কিছু কিছু যাত্রী (যদিও তাঁদের সংখ্যা কম) দুটি হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু অন্য যাত্রীরা একটি হাতলও ধরতে পারছেন না। ট্রেন চলা শুরু করলে অথবা থামলে একবার এর শরীরে আরেকবার ওর শরীরে আছড়ে পড়ার উপক্রম হন। এগুলো কি একটু বিবেচনা করতে পারি না আমরা?

সারা বিশ্বে মেট্রোরেলে ঠাসা ভিড় থাকে। বিশেষ করে অফিস গমনের সময় এবং অফিস থেকে ফেরার সময়। ভিড়ের মধ্যে দেখা দেয় আরেক বিপত্তি: এ সমস্যার প্রকটতা বেশি হয় আমার মতো খাটো আকৃতির যাত্রী ও নারীদের জন্য। ট্রেন চলাচলের সময় লম্বা যাত্রীরা যখন হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন, তখন তাঁদের বগলের অংশটি খাটো যাত্রীদের নাক-মুখের কাছাকাছি থাকে যা অস্বস্তিকর। বাংলাদেশের আবহাওয়া গরম ও আর্দ্র। এখানে মানুষের ঘাম হবে, সেটিই স্বাভাবিক। আবার লম্বা অথবা খাটো হওয়াও কোনো সমস্যা নয়। তবে আমরা যদি নিজেদের গায়ের গন্ধের ব্যাপারে সচেতন থাকি, দুর্গন্ধনাশক ব্যবহার করি, তাহলে সমস্যাটি আর থাকে না।

সভ্য মানুষ হিসেবে নারী যাত্রীদের প্রতি আমাদের আরেকটু সহনশীল হওয়া প্রয়োজন। সেদিন দেখলাম একজন গ্রাম্য নারী সাধারণ কামরায় উঠে পড়েছেন। দাঁড়িয়ে ছিলেন এক ভদ্রলোকের পাশে। ওই ভদ্রলোক তাঁকে বলতে শুরু করলেন, ‘আপনি কেন এখানে উঠলেন? আপনাদের জন্য তো মহিলা কামরা আছে। সেখানে যাননি কেন?’ ভদ্রমহিলা কিছু বলতে পারছিলেন না। কিছুটা ভ্যাবাচেকা হয়ে তাকিয়ে থাকলেন, আর সেই ভদ্রলোক বলেই চলেছেন বিভিন্ন নারীবিদ্বেষী কথা।

সবাই চুপ থাকলেও একজন প্রতিবাদ করলেন। ‘কেন ভাই তিনি উঠেছেন তো কী হয়েছে? মেয়েরা কি সাধারণ কামরায় উঠতে পারে না! আপনি তাঁকে নরম পেয়ে বাজে কথা বলেই যাচ্ছেন।’ সঙ্গে সঙ্গে অন্য যাত্রীরা তাঁকে সমর্থন করে সেই পুরুষটিকে মোটামুটি ধুয়ে দিলেন। অনেকে ব্যবহার করলেন বাজে শব্দ, যেটি মোটেও কাম্য নয়।

আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাস-ট্রেনে একজন নারী এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের দাঁড়িয়ে থাকলে দেখতে আসন ছেড়ে দেওয়ার সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল। এখন আর নেই। কেউ এ ব্যাপারে খুব বেশি মাথা ঘামায় বলে মনে হয় না। কেন বয়োজ্যেষ্ঠদের আসন ছেড়ে দেওয়া দরকার, সেই কথা বলেই শেষ করতে চাই।

মাস তিনেক আগে হবে। পল্লবী থেকে উঠে বিজয় সরণি স্টেশনে নামতে দরজায় অবস্থায় নিয়েছি। হঠাৎ ‘ঢক’ করে একটি শব্দ। চমকে উঠলাম। বুঝতে পারলাম না কিসের শব্দ। ফিরে তাকাতেই দেখলাম ষাটোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে পড়ে গেছেন। মাথাটা আছড়ে পড়েছে ট্রেনের মেঝেতে। সবাই ধরাধরি করে বসিয়ে দিলেন পাশের একটি আসনে।

সময়স্বল্পতার কারণে তাড়াতাড়ি নেমে যেতে হলো। জানতে পারলাম না পরে কী ঘটেছিল তাঁর ভাগ্যে। তবে ভীষণ মন খারাপ লাগছিল।

মানুষ হিসেবে আমি আশাবাদী। পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে আমার প্রত্যাশা অনেক। তবে তাঁদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করার দায়িত্ব আমাদের সবার। সেটি শুরু করতে হবে পরিবার থেকে। আমরা যদি আমাদের নিজ নিজ সন্তানদের মূল্যবোধ এবং বিবেচনাবোধ শেখাই, তবেই সেটি সম্ভব হবে। আইন নয় সচেতনতা, মূল্যবোধ ও বিবেচনাবোধ দিয়েই সুন্দর করা সম্ভব মেট্রোযাত্রা।

কামরান রেজা চৌধুরী সাংবাদিক