মিয়ানমারের অনেক এলাকা এখন বিদ্রোহীদের দখলে
মিয়ানমারের অনেক এলাকা এখন বিদ্রোহীদের দখলে

মতামত

মিয়ানমার পরিস্থিতি: বাংলাদেশ কি সুযোগ হাতছাড়া করছে

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের একমাত্র পথ হিসেবে বাংলাদেশ ‍শুরু থেকেই প্রত্যাবাসনের কথা বলে আসছে। ২০২২ ও ২০২৩ সালে মিয়ানমার থেকে এ বিষয়ে যৎকিঞ্চিৎ উদ্যোগ তথা দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও ক্যাম্প পরিদর্শনের ঘটনা ঘটলেও বর্তমানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আশা দুরাশায় পরিণত হচ্ছে।

একদিকে কার্যকর উদ্যোগের অভাব, অপর দিকে নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার পর নাগরিকত্ব পাওয়া নিয়ে গভীর সন্দেহের কারণে রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রত্যাবর্তনের যে অনাগ্রহ দেখা গেছে, তা স্বাভাবিক। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ-সংঘাত রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের সব দরজাকেই কি আসলে বন্ধ করে দিচ্ছে? নাকি এ ধরনের আপাত-অনিশ্চয়তার মধ্যেও বাংলাদেশ কৌশলী হয়ে সমস্যাকে সম্ভাবনায় পরিণত করতে পারে?

সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার অল্প সময়ের মধ্যেই আরাকান আর্মি দক্ষিণ চিন প্রদেশের পালেতোয়ায় নিজেদের পতাকা উড়িয়েছে—বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার সীমান্তস্থিত দীর্ঘ ৮০ কিলোমিটার এলাকার নিয়ন্ত্রণ তারা নিয়েছে। নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে সামরিক সরকারের অধীন থাকা অন্যান্য একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলকেও। এ ধারা অব্যাহত থাকলে রাখাইনে আরাকান আর্মির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও  শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাতে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে—এমনটা আশা করা বাড়াবাড়ি।

অন্যদিকে মিয়ানমারের পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও আরাকান আর্মির সাফল্যের পর বাংলাদেশের নিষ্ক্রিয় থাকাটাও দুর্বল কূটনীতির পরিচায়ক। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা কেমন হবে, তা নির্ভর করছে বাংলাদেশ তথা রোহিঙ্গাদের প্রতি আরাকান আর্মির দৃষ্টিভঙ্গি, মিয়ানমারের দ্বিচারিতা ও চাতুর্যপূর্ণ আচরণ, এশিয়া ও আন্তর্জাতিক মহলের অতীত ও বর্তমানের ভূমিকার ওপর।

মিয়ানমারে যেহেতু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত, সেহেতু আরাকান আর্মির সঙ্গে দর-কষাকষির একটা সুযোগ বাংলাদেশ এ মুহূর্তে নিতে পারে, যেখানে দাবি থাকবে মংডু, সিত্তো ও ম্রাউকয়ু—এই অঞ্চলগুলো মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য একটা স্টেট বা প্রদেশ গঠন। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো রোহিঙ্গারাও ফেডারেল ইউনিয়নের অধীনে থাকবে। রাখাইনদের মতো রোহিঙ্গাদেরও সমান অধিকার থাকবে। অংশগ্রহণ থাকবে প্রশাসন, বিচার, নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে।

মিয়ানমারে যে দীর্ঘ সময় নিয়ে যুদ্ধ চলছে, তা দেশটির ইতিহাসে আর কখনোই চলেনি। সংঘাতময় এ পরিস্থিতির গোড়ার দিকে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী যখন বলছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য এটা উপযুক্ত সময় নয়, তখন চীনা রাষ্ট্রদূত মন্তব্য করেছিলেন, বেইজিং যেভাবে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার ব্যাপারে কাজ করছে, তা শিগগিরই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দরজা উন্মোচন করবে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে বিবিধ কারণে।

আরাকান আর্মির সাফল্য ও মিয়ানমারের সম্ভাব্য যে নতুন বাস্তবতার প্রত্যাশা অনেকে করছেন তখন এ কথাও মনে রাখা আবশ্যক যে মিয়ানমারের সামরিক সরকার ও আরাকান আর্মি—উভয়ই রোহিঙ্গা গণহত্যার অপরাধে অপরাধী। উভয়ের কাছেই রোহিঙ্গারা ‘অবৈধ বাঙালি’। বাংলাদেশে যে মাদক প্রবেশ করে, তার একটা বড় অংশের নিয়ন্ত্রণকারী আরাকান আর্মি। কিছুদিন পরপর মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত রোহিঙ্গাদের আটক করা হয় বটে। তবে এই মাদকের উৎপাদন, বিপণন তথা পরিবহনের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের কোনো সম্পর্ক নেই। পুরো কাজটি হয় আরাকান আর্মি ও সামরিক জান্তার ছত্রচ্ছায়ায়। কিন্তু নাম হয়ে যায় রোহিঙ্গাদের।

তবে বাংলাদেশ-সংলগ্ন মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকা দখলের পর এই আরাকান আর্মি এখন অনেকাংশে বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। সীমান্ত এলাকার শৈথিল্য ও কঠোরতা সাপেক্ষে স্থলবেষ্টিত অবস্থায় তারা নিজেদের মৌলিক প্রয়োজন ও সম্ভাব্য কৌশলগত সামগ্রীর জন্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা সামগ্রীর ওপর তারা নির্ভর করছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কৌশলী যোগাযোগের এটাই উত্তম সময়।

আরাকান আর্মি সিত্তো দখল করে ফেললে সেই সুযোগটি আর নাও থাকতে পারে। এমনিতেই চীন সামরিক সরকার ও সরকারবিরোধী শক্তি—উভয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে চলেছে। আরাকান আর্মিও চীনকে নিশ্চিত করেছে যে চীনের বিশাল বিনিয়োগে কোনো ক্ষয়ক্ষতি আরাকান আর্মি করবে না। সিত্তো বন্দর দখল করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চীন ও আরাকান আর্মির যোগাযোগ ও নির্ভরতায় অন্য মাত্রা সৃষ্টি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের গুরুত্ব তখন অনেকটাই কমে যাবে।
কিন্তু এসব বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে বাংলাদেশ যদি এখনো ‘ক্যাম্পে কোনো সন্ত্রাসী নেই’ বা ‘ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট ভালো’—এ ধরনের ভাষ্য প্রচার কিংবা ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী’র বদলে এফডিএমএন (বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক) বলতে হবে—এ ধরনের আত্মতুষ্টিমূলক প্রচারণায় ব্যস্ত থাকে, তাহলে সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে, সংকট আরও ঘনীভূত হবে।

মিয়ানমারে যেহেতু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত, সেহেতু আরাকান আর্মির সঙ্গে দর-কষাকষির একটা সুযোগ বাংলাদেশ এ মুহূর্তে নিতে পারে, যেখানে দাবি থাকবে মংডু, সিত্তো ও ম্রাউকয়ু—এই অঞ্চলগুলো মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য একটা স্টেট বা প্রদেশ গঠন। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো রোহিঙ্গারাও ফেডারেল ইউনিয়নের অধীনে থাকবে। রাখাইনদের মতো রোহিঙ্গাদেরও সমান অধিকার থাকবে। অংশগ্রহণ থাকবে প্রশাসন, বিচার, নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে।

রোহিঙ্গাদের জন্য এ ধরনের নির্দিষ্ট অঞ্চল গঠনের পর তা যেন ভবিষ্যতে সংঘাতের মধ্যে না পড়ে কিংবা কয়েক বছর পর আরেকটি ‘আসাম’ সৃষ্টির মতো ব্যাপার না হয়, সে জন্য আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনাটি সিদ্ধান্তে পরিণত হলে তা দ্রুত আন্তর্জাতিক কোনো চুক্তি বা ঐকমত্যের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এমন কিছু করা গেলে তা অনুসরণে আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকে।

সাধারণত আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণপূর্বক জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক আদালত এ-জাতীয় চুক্তি বাস্তবায়নের তদারক করে থাকে, যা লঙ্ঘন করা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকে। অতীতের বিভিন্ন সময়ের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগগুলোর কোনোটিই আন্তর্জাতিকভাবে বাধ্যবাধকতামূলক কোনো আইন কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তাই সেগুলো টেকসইও হয়নি।

আরাকান আর্মির সঙ্গে সংলাপে বসলেই কি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? এ প্রশ্নের আসলে একক কোনো উত্তর নেই। কারণ, এ সংলাপ মূলত একটি সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা, যা সফল হতে পারে আবার না-ও পারে। তবে এ ধরনের সুযোগ ঘটলে চীন বা রাশিয়া কি নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবে? মোটেও নয়। সুতরাং এ দেশগুলোর সম্ভাব্য আচরণ (হস্তক্ষেপ), তাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিবেচনায় রেখেই এগোতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে নিরপেক্ষ ও সব দিক বিবেচনা সাপেক্ষে পরামর্শ দিতে পারে—এ রকম একটি কমিশন গঠন করার মাধ্যমে সরকার এ বিষয়ে বাস্তবানুগ পদক্ষেপ নিতে পারে। লক্ষণীয়, জাপানের বিশেষ দূত ২০২৩ সালের নভেম্বরে সামরিক সরকারের সঙ্গে বৈঠকের পর আরাকান আর্মির সঙ্গেও কথা বলে গেছেন। চীন জানুয়ারি মাসে কুনমিংয়ে বৈঠক করেছে আরাকান আর্মি ও সামরিক সরকারের মধ্যে সমঝোতার জন্য। ভারত তার প্রতিনিধি পাঠিয়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ নিয়ে বৈঠক সেরেছে ফেব্রুয়ারিতে। বাংলাদেশ কী করবে, তা স্থির করতে অনেক সময় নিয়ে ফেলছে না তো?

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়টি বাংলাদেশ খুব জোরেশোরেই নিয়ে আসতে পারে আরাকান আর্মির সঙ্গে বৈঠকে। তবে সেই সঙ্গে নিজের অভ্যন্তরীণ নীতিমালা থাকাটাও জরুরি। শরণার্থী প্রতিপালনের ৪০ বছর পার হলেও বাংলাদেশ শরণার্থী ব্যবস্থাপনার একটা নীতি প্রণয়ন করতে পারেনি। কোনো নীতি না থাকাটাই নীতি—এ ধরনের ‘নীতি’ (?) নিয়ে সিরিয়ান শরণার্থীদের জর্ডান ‘শরণার্থী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায়নি, কোনো নীতিমালা তৈরি করেনি; এতে করে জটিলতা বেড়েছে এবং একপর্যায়ে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা আরোপিত শর্ত কবুল করে শরণার্থী ব্যবস্থাপনা করতে হয়েছে, সেটার পরিণতিও খুব ভালো কিছু হয়নি।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে প্রবেশের পরপরই আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতায় তাদের ফেরত পাঠানো প্রয়োজন ছিল। সেটি না করে তাদের শরণার্থী বলা হবে, নাকি এফডিএমএন নামে ডাকা হবে, সে ভাবনায় সময় গেছে। এরপর তাদের ক্যাম্পে কিছু অংশে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বকে একটা ভুল বার্তা দেওয়া, ভাসানচরে কিছু রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করার মাধ্যমে মিয়ানমারকে একটা ভুল বার্তা দেওয়া, বারবার প্রত্যাবাসনের এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া, যার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয় না—এ বিষয়গুলো মূল্যায়নের সময় এসেছে। কোনো নীতিমালা ছাড়া অতীতের মতো অ্যাডহক ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে থাকলে ভবিষ্যতেও একই ফলাফল আসবে এবং সুযোগগুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে।

  • ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।