খবরের কাগজ খুললেই লুটপাটের সংবাদ পাই। গেরস্তের বাড়ি, রিলিফের কম্বল কিংবা চাল আর দোকানবাজার-ব্যাংক লুট তো ছিল প্রাচীন আমলের শিরোনাম। হাল আমলে লুটের আকার ও প্রকার বদলে গেছে। এখন ব্যাংক লুটের জন্য ব্যাংকের কোনো শাখায় হামলা করতে হয় না। শেয়ারবাজার লুট শুরু হয়েছে অনেক আগেই। মাঝেমধ্যে বিরতি দিয়ে এটা এখনো চলছে। ১৯৯৬ সালে শুরু হয়ে এখন বোধ হয় তার তৃতীয় সেমিস্টার চলছে।
ঋণের নামে ব্যাংকে রাখা লাখ লাখ আমানতকারীর টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কিছু লোক। এসব হচ্ছে সরকারের প্রশ্রয়ে। কারণ, নিয়মনীতি পাল্টে এক পরিবারের একাধিক সদস্যকে বারবার পরিচালক হওয়ার সুযোগ দিয়ে এগুলোকে পারিবারিক এন্টারপ্রাইজ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ যে কাণ্ডটি ঘটে গেছে কয়েক বছর আগে, তা হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা লোপাট হয়ে যাওয়া। যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের ধরা হয়নি। সবচেয়ে বড় অপরাধ তাঁরা করেছিলেন বিষয়টি গোপন রেখে, চেয়েছিলেন ধামাচাপা দিতে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তিনি নাকি এটা জেনেছেন দুই মাস পর।
সত্তরের দশকে এ দেশের মানুষ কম্বল চুরির বিরুদ্ধে স্লোগান দিত। এখন আর শুধু কম্বল নয়, গোটা দেশের সম্পদ নানাভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে গুটিকয় পরিবার ও গোষ্ঠী। তাঁরা কেউ বিদেশে থাকেন, কেউ দেশে হোমরাচোমরা হয়ে বসে আছেন। তাঁদের অনেকের পরিবার বিদেশে উড়াল দিয়েছে অনেক আগেই।
মানুষ রাষ্ট্র তৈরি করে তার ইহজাগতিক মঙ্গলের জন্য। তার অনেক সেবার প্রয়োজন। তার খাবার চাই, মাথাগোঁজার ঠাঁই চাই, অসুখ-বিসুখে চিকিৎসা চাই, সন্তানের জন্য লেখাপড়ার ব্যবস্থা চাই, ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য চাই কর্মসংস্থান। চাই পানি, বিজলি, জ্বালানি আর যাতায়াতের পরিবহন। আর চাই বসবাস ও চলাফেরার নিরাপত্তা। একসঙ্গে অনেক লোক থাকলে এসব দেখভাল করার জন্য একটা প্রতিষ্ঠান লাগে। রাষ্ট্র হচ্ছে এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান। মানুষের জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য মানুষ নয়। কিন্তু আমাদের দেশে সব যেন উল্টো চলছে।
শৈশবে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের একটা ছড়া পড়েছিলাম। ‘মজার দেশ’ নামের এই ছড়ার কয়েকটা লাইন ছিল এ রকম:
এক যেয়াছে মজার দেশ
সব রকমে ভালো,
রাত্তিরেতে বেজায় রোদ
দিনে চাঁদের আলো।
আকাশ সেথা সবুজ বরন
গাছের পাতা নীল,
ডাঙ্গায় চরে রুই কাতলা
জলের মাঝে চিল।
কেন শাসকেরা এমন হয়? ইউরোপের এক দেশের এক রাজা আঠারো শতকে বলেছিলেন, আই অ্যাম দ্য স্টেট, আমিই রাষ্ট্র। আমাদের এক নেতা গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বলেছিলেন, আই অ্যাম দ্য কনস্টিটিউশন, আমিই সংবিধান। এ রকম যুগাবতার মাঝেমধ্যে পৃথিবীতে তশরিফ আনেন এবং দুনিয়া ধন্য করে দেন। কিন্তু তাঁদেরও শেষ ছিল।
আমরা এমনি এক মজার দেশে বাস করি, যেখানে সব উল্টো চলে। এখানে সেবার দিক দিয়ে রাষ্ট্র ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। শিক্ষাব্যবস্থা চলে গেছে ব্যক্তির পকেটে। তাঁরা এখন সম্মানিত শিক্ষা উদ্যোক্তা। প্রাইভেট হাসপাতাল আর ক্লিনিক থেকে চিকিৎসা কিনতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা গুনতে হয়। গণপরিবহন বলতে কিছু নেই। আর নিরাপত্তা? সে তো আছে শিষ্টের দমন আর দুষ্টের পালনের জন্য।
আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী আছে। তাদের পেছনে রাষ্ট্রের অর্থ খরচ হয়। অথচ কী ভোজবাজির মধ্য দিয়ে ইয়াবা চলে আসে আকাশে উড়ে কিংবা নদী সাঁতরে! রাস্তায় চাঁদাবাজির খপ্পরে পড়েননি এমন মানুষ আঙুলে গোনা যায়। চাঁদাবাজি কারা করে সবাই জানে। এর ভাগ কোথায় কোথায় যায়, সেটাও অনুমান করতে কষ্ট হয় না।
আর যাঁরা পাবলিক সার্ভেন্ট, জনগণের খেদমত করার জন্য জনগণ খাজনা দিয়ে যাঁদের পোষে, তাঁদের কাছে সেবার জন্য ধরনা দিতে হয়। সেখানেও নগদ নারায়ণ ছাড়া ফাইল নড়ে না। এ দেশে ট্যাক্স দিতেও টাকা ঢালতে হয়। তো আমরা এই রাষ্ট্র তৈরি করলাম কেন?
রাষ্ট্র এখন একটি গোষ্ঠীকে সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার যন্ত্র। এই গোষ্ঠীর আকার ছোট হলেও তার হাত অনেক লম্বা। সেবার আকার ছোট হতে হতে বিন্দুতে পৌঁছেছে। কিন্তু ক্ষমতার চর্চায় রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে অনেক প্রবল ও বিশাল। অনেকটা সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো।
আমরা গণতন্ত্রের কথা জপতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলি। এখানে যে গণতন্ত্রের পত্তন হয়েছে, সেখানে গণ নেই। তার কথা কেউ শোনে না। খবরের কাগজ তার কথা ছাপতে ভয় পায়। সে ভোট দিতে গেলে তার ভোটটা আগেই কেউ দিয়ে দেয়। অথবা তাকে ভোট দিতেই হয় না। বছরের পর বছর চলছে এ রকম। এ এক তামাশা।
রাষ্ট্রের মালিকদের কোনো প্রশ্ন করা যায় না। প্রশ্ন করলেই সে হয় ষড়যন্ত্রকারী, বিদেশিদের এজেন্ট। মালিকের সুরে সুর মিলিয়ে কথা না বললে তার কপালে দেশদ্রোহীর তকমা এঁটে দেওয়া হয়। একটা কথাই তাঁরা ফাটা রেকর্ডের মতো বাজান: গঠনমূলক সমালোচনা করুন। গঠনমূলক সমালোচনা কী? হুজুর জিন্দাবাদ! সবকিছু চমৎকার! এসব বলা! সমালোচনা হলেই তাঁদের গাত্রদাহ হয়। তাঁরা বলেন কিছু কিছু ষড়যন্ত্রকারী দেশবিরোধী কাজে লিপ্ত। তারা শুধু সমস্যা দেখে। আমরা এই যে এত এত রাস্তা-সেতু-ভবন বানালাম, সেটা দেখে না? একই কথা তোতাপাখির মতো তাঁরা বলে যাচ্ছেন সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। আগে বলতেন, পাকিস্তান খতরে মে হ্যায়। এখন বলেন, দেশবিরোধী চক্রান্ত হচ্ছে।
যাঁরা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আছেন, তাঁদের কাজ হলো সেসব করা, যাতে মানুষের মঙ্গল হয়, দুর্ভোগ কমে। এটা তাঁদের দায়িত্ব। সে জন্য তাঁদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। সেখানে ব্যত্যয় হলে মানুষ তো প্রশ্ন তুলবেই, হিসাব চাইবেই। মানুষ যে প্রশ্ন করে, এতে তো দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকদের সুবিধা হওয়ার কথা! কোথায় কোথায় তাঁদের ভুল বা ঘাটতি, সেটা তাঁরা জানতে পারেন। সে জন্য তো প্রশ্নকারী বাহবা পাওয়ার যোগ্য। অথচ তাঁদের দেশপ্রেম নিয়ে মশকরা করা হয়।
ভারত ভেঙে পাকিস্তান হওয়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশক পরেও সব শাসকের গলায় একই সুর। সমালোচনা সহ্য করার সংস্কৃতিটা অধরাই থেকে গেল। আমিই ঠিক আর সবাই ভুল, এই আপ্তবাক্য জপ করেই তাঁরা পরম্পরা বজায় রাখছেন। সময় পাল্টাচ্ছে, সমাজ বদলাচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্র ও তার বাহকদের কথা বলার তরিকায় কোনো পরিবর্তন নেই।
কেন শাসকেরা এমন হয়? ইউরোপের এক দেশের এক রাজা আঠারো শতকে বলেছিলেন, আই অ্যাম দ্য স্টেট, আমিই রাষ্ট্র। আমাদের এক নেতা গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বলেছিলেন, আই অ্যাম দ্য কনস্টিটিউশন, আমিই সংবিধান। এ রকম যুগাবতার মাঝেমধ্যে পৃথিবীতে তশরিফ আনেন এবং দুনিয়া ধন্য করে দেন। কিন্তু তাঁদেরও শেষ ছিল।
এখন যে রকম অবস্থা চলছে, মানুষ কী করবে? অতীতাশ্রয়ী হয়ে বলবে, আগেই ভালো ছিলাম। কিংবা আরও বেশি করে অদৃষ্টবাদী হবে, নিয়তির কাছে সঁপে দেবে নিজেকে! বলবে, বদনসিব!
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক