ত্রিপুরার ভোট: তিপ্রাল্যান্ড গড়ার নতুন জাগরণ কি সফল হবে

ত্রিপুরার নতুন অহিংস শক্তি ‘তিপ্রা মথা’র মূল চমক প্রদ্যোত মানিক্য।
ছবি: এএনআই

ভারতের লোকসভায় আসনসংখ্যা ৫৪৩। তার মধ্যে ত্রিপুরার হিস্যা মাত্র ২টি। ভারতের সবচেয়ে ছোট রাজ্যগুলোর একটা ত্রিপুরা। তার চেয়ে ছোট কেবল সিকিম ও গোয়া। জনসংখ্যায়ও ৪০ লাখ মানুষের ত্রিপুরার অবস্থান অনেক নিচে, ২২তম। কিন্তু তারপরও ত্রিপুরার নির্বাচন ভারতীয় বড় বড় দলগুলোর নজরে রয়েছে। ১৬ ফেব্রুয়ারি সেখানে নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনকে আগ্রহ ভরে দেখছে বাংলাদেশও।
ভোটের ময়দানে ‘তিপ্রাল্যান্ড’

ত্রিপুরার তিন দিকেই বাংলাদেশ। বলা যায়, ভারতের অন্য যেকোনো রাজ্যের চেয়ে বাংলাদেশ ত্রিপুরার নিকটতম প্রতিবেশী। এ রাজ্যে এমন কোনো জিলা নেই যার সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত নেই। এখানকার রাজনীতি ও সমাজজীবনেও অতীতে বাংলাদেশ আলোচ্য বিষয় হয়ে থাকত। এবার অবশ্য পরিস্থিতি সে রকম নয়। এবারকার নির্বাচনে প্রধান আলোচ্য বিষয় ত্রিপুরী বা ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী নিজেরাই। বৃহত্তর ‘তিপ্রাল্যান্ড’ চায় তারা। রাজ্যের বাঙালিরা আবার সেটা চায় না। এই বিবাদের মধ্যেই নির্বাচনী প্রচার চলছে। বিজেপির চলতি শাসনের নানা অনাচার ও সহিংসতাও নির্বাচনের হিসাব-নিকাশে আসছে।

নতুন শক্তি তিপ্রা মথা

ত্রিপুরার বিধানসভায় আসন ৬০টি। এবারের আগে এ রাজ্যে বিধানসভার যে ১১ দফা নির্বাচন হয়েছে তাতে বামপন্থীরা সাতবার এবং কংগ্রেস ও বিজেপি একবার করে জিতেছে। একদা নির্বাচন মানেই ছিল বামপন্থী বনাম কংগ্রেস ভোটযুদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালার পর কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর তৃতীয় দুর্গ ছিল ত্রিপুরা। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কংগ্রেস। কিন্তু কংগ্রেস ও সিপিএম উভয়ে পুরোনো জায়গা হারিয়েছে। গত নির্বাচন থেকে নতুন শক্তি তৈরি হয়েছে বিজেপি। কংগ্রেসের ভোট ও প্রার্থীদের বড় অংশ কেড়ে নিয়েছে বিজেপি। সঙ্গে ত্রিপুরাদের ভোটও কিছু যুক্ত হয়েছে তাদের শিবিরে।
গত পাঁচ বছরে বিজেপির শাসনের মধ্যেই এ রাজ্যে নতুন শক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছে ‘তিপ্রা মথা’। একান্তই ত্রিপুরাদের রাজনৈতিক দল। ফলে এবারের ভোট হবে ত্রিমুখী। বিজেপি ও সিপিএম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে থাকলেও তিপ্রা মথাও এখানে সরকার গড়তে পারে বা সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে বলে জোর অনুমান আছে।

তিপ্রা মথার লক্ষ্য ২০টি আসন

বাঙালিরাই ত্রিপুরা রাজ্যে সংখ্যাগুরু এখন। প্রায় ৭০ শতাংশ। বাকিটা ট্রাইবাল ভোট। কিন্তু এক-তৃতীয়াংশ হলেও রাজ্যজুড়ে ত্রিপুরা বা ত্রিপুরীদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব কম নয়। বাঙালিদের তাড়াতে অনেক সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে এই জনগোষ্ঠীর গেরিলারা। সেসব অনেক কমেছে এখন। দীর্ঘদিন অনেক উপদলে বিভক্ত ছিল ত্রিপুরারা। সম্প্রতি পুরোনো রাজবংশের সর্বশেষ পুরুষ প্রদ্যোত মানিক্য দেববর্মা তাঁর আদিবাসী সমাজকে একত্র করে রাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতা পেতে চেষ্টা করছেন। তাঁর ‘তিপ্রা মথা’ নামের দলটি সেই সূত্রেই সাড়া জাগিয়েছে। ৬০ আসনের বিধানসভা ভোটে অন্তত ২০টি আসনে এখানে ত্রিপুরাদের ব্যাপক উপস্থিতি আছে। এই আসনগুলো ট্রাইবালদের জন্য সংরক্ষিতও বটে। প্রদ্যোত মানিক্যের লক্ষ্য এই ২০ আসন। তিনি জানেন বাকি ৪০ আসন ভাগাভাগি হবে বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে। এই ভাগাভাগির ভেতর যার হাতে ২০টি আসন থাকবে, তার হাতেও সরকার গঠনের সুযোগ চলে আসতে পারে। ত্রিপুরার ভেতর স্বশাসিত যে ট্রাইবাল জেলা কাউন্সিল আছে, তাতে তিপ্রা মথাই ক্ষমতায় আছে।

প্রদ্যোত মানিক্য বৃহত্তর তিপ্রা রাজ্যের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন

ত্রিপুরার নতুন অহিংস শক্তি ‘তিপ্রা মথা’র মূল চমক প্রদ্যোত মানিক্য। তাঁর মধ্যে তিপ্রা সমাজ তাদের ‘বোবাগ্রা’কে দেখছে। তিপ্রা ভাষায় বুবাগ্রা হলেন রাজা। তিপ্রা মহারাজা। প্রদ্যোতকে ঘিরে আদিবাসী সমাজে মহারাজা বোধের জাগরণ এবারের ভোটে বিজেপি ও সিপিএমকে ভোগাবে মনে হচ্ছে। বুবাগ্রা প্রদ্যোতের রাজনৈতিক পণ্য বৃহত্তর তিপ্রাল্যান্ড। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সব ত্রিপুরীকে একটা বৃহত্তর রাজ্যের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। কিন্তু বাঙালিদের সমর্থন ছাড়া এটা বাস্তবায়নের একটাই উপায়—ত্রিপুরার বিভক্তি। ত্রিপুরার বাঙালিরা সেটাও সমর্থন করছে না। সে কারণে বাঙালি ভোট হারানোর ভয়ে সিপিএম বা বিজেপি তিপ্রাল্যান্ডের দাবি সমর্থন করছে না। তিপ্রা মথার সঙ্গে তারা কেউ জোট করতেও আগ্রহী নয় নির্বাচনের আগে। ৬০ আসনের বিধানসভায় ৪২টি আসনে বিজেপি ও বামদের তৃতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী তিপ্রা মথা। ত্রিমুখী এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শেষমেশ কী ঘটবে, সেটা ধারণা করা মুশকিল। বাঙালিরা যে তিপ্রা মথাকে ভোট দেবে না, সেটা স্পষ্ট। যদিও এই দলের প্রার্থী তালিকায় ট্রাইবাল নয়, এমন জাতির মানুষও আছে।

মানিক সরকারকে মনোনয়ন দেয়নি সিপিএম

ত্রিপুরায় বিজেপির উত্থানের পর থেকে পাহাড়ি-বাঙালি শিবিরের ভোটের পুরোনো হিসাব এলোমেলো হয়ে গেছে। বিজেপি নির্বাচনে ৫৫ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। ৫টি আসন ছেড়েছে ট্রাইবাল মিত্র ‘ইনডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (আইপিএফটি)’ দলকে। আইপিএফটিকে দিয়ে তারা পাহাড়ি ভোট টানতে চায়।

বামদের প্রধান দল সিপিএম। গত নির্বাচনে হারের আগে তারা ২৫ বছর একনাগাড়ে এই রাজ্য শাসন করেছে। এবার তাদের পাশে রয়েছে পুরোনো কংগ্রেসের অবশিষ্ট। কংগ্রেসকে তারা ১৩টি আসন ছেড়ে দিয়ে জোট গড়েছে। বাকি ৪৭-এর ৩টা অন্য তিন বাম দলকে দিয়ে নিজেদের হাতে রেখেছে ৪৩টি। একটি আসনে (রামনগর) তারা একজন স্বতন্ত্রকে সমর্থন দিয়েছে। সিপিএম-কংগ্রেস জোটের পরও বাঙালি ভোটারদের মাঝে সিপিএমের চেয়ে বিজেপি এগিয়ে আছে বলেই মনে হচ্ছে। পাশাপাশি বিজেপির অর্থ জোরও বেশ। এ অবস্থা পোষাতে সিপিএমের ভরসা পুরোনো ট্রাইবাল ভোট। ফলে তাদের একদিকে বিজেপির সঙ্গে অন্যদিকে তিপ্রা মথা-আইপিএফটি জোটের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে।

সিপিএম প্রার্থী হিসেবে নবীনদের সামনে এনেছে। তাদের ৪৩ প্রার্থীর ২৪ জনই নতুন। প্রচারেও তারা নতুন ভোটারদের ওপর জোর দিচ্ছে। সে জন্য আড়াই লাখ চাকরি সৃষ্টির কথা বারবার বলছে প্রচারণায়। তারা বৃদ্ধ নেতাদের অনেককে মনোনয়ন দেয়নি এবার। যার মধ্যে আছেন বহুল আলোচিত ৭৪ বছর বয়সী মানিক সরকারও। যিনি এ রাজ্যে চারবারের (১৯৯৮-২০১৮) সাবেক মুখ্যমন্ত্রী। তবে সিপিএমের নির্বাচনী প্রচারে তিনিই প্রধান মুখ হিসেবে আছেন। তাঁর প্রার্থী না হওয়া এবারের নির্বাচনের বড় চমক এখানে।

ত্রিপুরার ভোটের ফল বাংলাদেশের জন্যও তাৎপর্যবহ

পুরো ভারতের বিবেচনায় এই রাজ্যের ভোট বড় ধরনের কোনো প্রভাব তৈরি করতে না পারলেও দুটি কারণে ত্রিপুরার দিকে সবার নজর এখন। প্রথমত সিপিএম পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে সমর্থ কি না, তার একটা পরীক্ষা হবে এখানে। কেরালা ছাড়া আর কোনো রাজ্য তাদের হাতে নেই। এ অবস্থা বদলাতে না পারলে দলটির সর্বভারতীয় পরিচয়ে টান পড়ে যায়।

অন্যদিকে ত্রিপুরার ভোট উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোর ভোটারদের কিছুটা হলেও প্রভাবিত করবে। পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের মনোজগতেও এই নির্বাচনের কিছু ছাপ পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিজেপি যদি আবারও ত্রিপুরায় সরকার গড়তে পারে, তাহলে কলকাতায় সরকার গঠনের প্রত্যাশা বাড়বে তাদের। বাংলাদেশের জন্যও সেটা ভাবনার বিষয়। তবে বাংলাদেশ বিশেষভাবে দেখতে চাইছে ‘বৃহত্তর তিপ্রাল্যান্ড’ দাবির পরিণতি। বুবাগ্রা প্রদ্যোতের রাজনীতির পরিণতির দিকেই মনে হচ্ছে সবার মনযোগ। কারণ, গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের ধারণা এমন কিছু যার পরিণতি নানামুখী হতে পারে। ত্রিপুরার বাইরেও অনেক ত্রিপুরী রয়েছে, আছে বাংলাদেশেও।

  • আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক