নখ খোঁটা তাঁর মুদ্রাদোষ, বোঝা গেল। শুরু থেকেই বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখ এমনভাবে খুঁটছিলেন, তা চোখে না পড়ে যায় না। এতে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর দুই হাতের ‘লাবণ্যহীনতা’ও নজর এড়ায় না। খেটে খাওয়া মানুষের ভরসা যেমন তাঁর দুই হাত, তাঁর পরিচয়ের স্মারকও যেন হাত দুটো। না বললেও বুঝতে তাই অসুবিধা হচ্ছিল না ওই নারী একজন শ্রমিক; যিনি শ্রমের বিনিময়ে তাঁর মুখের খাদ্য জোগান। কিন্তু সেটাও কি ঠিকঠাক পারছেন, এখন, এই দুর্মূল্যের বাজারে? যে বাজার কিনা কেবল আগুনের সঙ্গে তুলনীয়!
এক আঁটি শাকের দাম ২০ টাকা। একমাত্র অ্যাংকর ডালের দাম শতকের ঘর ছাড়ায়নি। ডিমের হালি ‘হাফ সেঞ্চুরি’ করার পর নট আউট! দুই শর ঘর ছুঁয়েছে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দর। সবজি মেলে না ৬০ টাকার নিচে। বললেন, তাঁর একার ডাল-ভাতের জন্যও মাসে এখন সাড়ে তিন-চার হাজারের কমে হয় না।
একা কেন? কথা বলে জানা গেল, বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার চর ভেলামারীতে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় মা-বাবা বিয়ে দেন। কিন্তু ত্রিশালের সেই শ্বশুরবাড়িতে বেশি দিন টিকতে পারেননি। চাহিদামতো যৌতুক দিতে না পারায় স্বামী আরেকটি বিয়ে করেন। বাধ্য হয়ে মা-বাবা তাঁকে ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু তত দিনে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিলেন। পরে জন্ম হয় বুদ্ধি ও বাক্প্রতিবন্ধী মেয়ে ফারজানার। মেয়েটির বয়স এখন ১৪।
মা-বাবার ইচ্ছায় পরে দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন। ওই সংসারে তাঁর কোলে আসে ছেলে মাহাদি হাসান। ছেলের বয়স যখন ১৩ মাস, স্বামী মারা যান। তাঁর মৃগীরোগ ছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর ফিরতে হয় মা-বাবার সংসারে।
আগে পুরোদমে বাসাবাড়িতেই কাজ করতেন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে রাজধানীর ধানমন্ডি ৪/এ সড়কের একটি ফিজিওথেরাপি সেন্টারে ‘চাকরি’ করছেন। চাকরি মানে সেই ধোয়ামোছা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ। চাকরি সেরে এক বাসায় জামাকাপড় কাচা, থালাবাসন ধোয়া, ঘর মোছার কাজ করেন। দুই কর্মস্থল থেকে আয় যথাক্রমে আট ও দুই হাজার টাকা। এর মধ্যে ঘরভাড়া তিন হাজার, খাওয়া খরচ, বাড়িতে মেয়ের জন্য দেন এক হাজার টাকা। আট বছরে পড়া ছেলে মাহাদিকে দিয়েছেন হাজারীবাগের একটি মাদ্রাসায়। থাকা-খাওয়া বাবদ টাকা লাগে না। তবে খাতা-কলম কিনে দিতে হয়।
মাথার প্রায় সব চুলে পাক ধরেছে। অযত্নের ছাপ চেহারায়। পরনের সালোয়ার-কামিজ দেখে বোঝা যায় সেটি দামিই ছিল, তবে বেশ পুরোনো। সম্ভবত কেউ দিয়ে থাকবেন। পায়ে প্লাস্টিকের চপ্পল। বয়স জিজ্ঞেস করায় বললেন ৩০। শুনে চমকাতেই হলো! বিয়ের বয়স হিসাবে নিলে তাঁর এ কথায় দ্বিমত করার কিছু নেই। কিন্তু দেখে মনে হয়, নির্ঘাত চল্লিশোর্ধ্ব। বাল্যবিবাহ, অপরিণত বয়সে মা হওয়ার ধকল, গরিবির সঙ্গে লড়াই—এসবই সম্ভব করেছে এই অসম্ভবকে!
১৩ আগস্ট জিগাতলায় হাজী আফসার উদ্দিন লেনের ভাড়া বাসার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি যতক্ষণ কথা বলছিলেন, তাঁর চোখ দুটো টলটল করছিল। বিচ্ছেদ, মৃত্যু, প্রতিবন্ধী সন্তান—এসব কথা বলার সময় তাঁর গলা ধরে আসছিল। কিন্তু চোখ ও গলা কোনোটাই শেষতক ‘মাত্রা’ ছাড়াল না! আঘাতে আঘাতে মানুষ বুঝি এমনই হয়, ক্ষয়ে ক্ষয়ে যান, কিন্তু ভেঙে পড়েন না। ভেঙে পড়লে চলবেই বা কীভাবে? জীবনের ধর্ম তো সচলতা।
দেশের কমবেশি ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত, যেখানে ধরাবাঁধা বেতন-ভাতা নেই বললেই চলে। তৈরি পোশাকসহ কয়েকটি শিল্পে ন্যূনতম যে মজুরি, তা ৩২ হাজার টাকার ধারেকাছে কি না, মন্ত্রীর বলার জন্যই তোলা থাকল।
১২ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ ভালো আছে। আমরা সুখে আছি, বেহেশতে আছি।’ এ নিয়ে নানা মহলে নানা কথাবার্তা ওঠার পর ১৩ আগস্ট তার ব্যাখ্যা দিলেন এভাবে, ‘বেহেশতের কথা আমি বলেছি, কম্পারেটিভ টু আদার কান্ট্রি।’ এরপর তিনি ইংল্যান্ড, তুরস্ক, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতির হিসাব দিয়ে বলেছেন, ‘সেই দিক দিয়ে আমরা ভালো আছি।’
নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের তুলনা টানা অর্থহীন, বাংলাদেশ কখনো শ্রীলঙ্কা হবে না—এমন ভাষ্য তো সরকারেরই। আর মূল্যস্ফীতির তুলনায় জনগণের আয়রোজগারের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া মানে অর্ধেক কথা বলা। গত বছরও শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ছিল, ইংল্যান্ড ও তুরস্কের বেশ কয়েক গুণ বেশি আমাদের চেয়ে। কেবল পাকিস্তানেরই কম।
‘গ্রামগঞ্জের কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামাকাপড় আছে। আমি মনে করি না, আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি’—স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের এ কথার পিঠে তাই কোনো কথা আসে মুখে! যদিও ১০ আগস্ট করা তাঁর ওই মন্তব্যের ব্যাখ্যাও দিতে হলো তাঁকে। ১৩ আগস্ট তিনি বলেন, ‘আগে তো খেতে পায়নি, এখন খেতে পায়। এখন আপনারা-আমরা ৩২ হাজার টাকা বেতন পাই, কিন্তু পরিবার চালাতে কষ্ট হচ্ছে।’
দেশের কমবেশি ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত, যেখানে ধরাবাঁধা বেতন-ভাতা নেই বললেই চলে। তৈরি পোশাকসহ কয়েকটি শিল্পে ন্যূনতম যে মজুরি, তা ৩২ হাজার টাকার ধারেকাছে কি না, মন্ত্রীর বলার জন্যই তোলা থাকল।
‘বেহেশতে আছি’ ও ‘খুব খারাপ অবস্থায় নেই’ বিষয়ে সাংবাদিকসুলভ কেতায় ওই নারীর মন্তব্য জানতে চাইলাম। প্রশ্নটা করেই বুঝলাম ভুল করেছি! তাঁর অভিব্যক্তির তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না, তাঁর মুদ্রাদোষটা কেবল উবে গেল। নখ খোঁটা বন্ধ করে একটু ম্লান হাসলেন, চোখ দুটো আগের মতোই টলটল করছিল। রবীন্দ্রনাথ এই জন্যই বুঝি লিখেছিলেন, ‘মানুষ কাঁদিয়া হাসে, পুনরায় কাঁদে গো হাসিয়া।’
ওহ্! তাঁর নামটা বলা হয়নি। রিক্তা, মোসাম্মৎ রিক্তা। তাঁর নামটাও কি কাকতাল?
হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
hello.hasanimam@gmail.com