মতামত

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার টাকাও কেন ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়?

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার বাস্তবতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া আর হিমালয়ের চূড়ায় ওঠা একই কথা।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার বাস্তবতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া আর হিমালয়ের চূড়ায় ওঠা একই কথা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার মৌসুম এলেই সংবাদমাধ্যমের খবরের শিরোনাম হয়, ‘ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পেয়েও মেধাবী শিক্ষার্থীর স্বপ্নপূরণ অনিশ্চিত’। এই অনিশ্চয়তার কারণ হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ও পড়াশোনার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, সেটা দেওয়ার সংগতি নেই তাঁদের। পাশাপাশি সম্প্রতি ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে আয় করে, তার ভাগ-বাঁটোয়ারার বিষয়টিও খবরের শিরোনাম হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, ডিনসহ অন্যরা যেভাবে সম্মানী বাবদ আয় ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন, তাতে শুধু যৌক্তিকতার প্রশ্ন ওঠে না, নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়।

কয়েক হাজার টাকা জোগাড় করতে না পারার কারণে কারও কারও জন্য যখন উচ্চশিক্ষার পথই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিনের সংশ্লিষ্টতার জন্য কেউ কেউ সাত থেকে আট লাখ টাকা পারিশ্রমিক নিচ্ছেন। বিপ্রতীপ এই বাস্তবতার ছবি একটু কল্পনা করতে চেষ্টা করুন। বৈষম্য পরিমাপের মাপকাঠি গিনি সহগ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান শূন্য দশমিক ৪৯৯। এর অর্থ হচ্ছে চরম বৈষম্যের দেশ থেকে আর দশমিক ১ অর্জন করা বাকি আমাদের।

কয়েক দিন আগেই বিশ্বব্যাংকের ‘অ্যাটলাস অব সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস ২০২৩’ প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বাংলাদেশের ১২ কোটি ১০ লাখ মানুষের পুষ্টিকর খাদ্য কেনার সামর্থ্য নেই। এটা মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠ হলো অতিধনী বৃদ্ধির দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশ প্রথম। এখানে রাষ্ট্রীয় বা সরকারি বা ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় গোষ্ঠীতন্ত্র সৃষ্টি হয়েছে। ক্রমাগত খাদের কিনারে চলে যাওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠের পকেট থেকে টাকা বের করে ওপরতলার মানুষদের কাছে জমা হওয়ার এই যন্তরমন্তর ব্যবস্থা সবখানেই। এখানে চাল, তেল, ডাল, মাছ, মুরগি, ডিম থেকে শুরু করে কাঁচা লঙ্কা—সবখানেই ব্যতিক্রমহীন একই সূত্র।

বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। শুধু সরকার নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায় থেকে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থায়ন করে। তা দিয়ে নানা ধরনের বৃত্তি চালু থাকে। আমাদের এখানে সেই সংস্কৃতি নেই বললেই চলে। ভর্তি পরীক্ষার ফির টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারার সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। ভর্তি পরীক্ষা কারও কারও অযৌক্তিক আয়ের উপায় হতে পারে না। ভর্তি পরীক্ষার ফি থেকে আসা আয়ের একটা অংশ দিয়ে গড়ে তোলা তহবিল থেকে গরিব শিক্ষার্থীদের ভর্তি ও পড়াশোনার খরচ জোগান দেওয়া যায়। অন্তত এটুকু সামাজিক দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় পালন করতে পারে।

এই ডামাডোলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা কেন পিছিয়ে থাকবেন? পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ কয়েকজন ডিন ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রির টাকা থেকে ‘অযৌক্তিকভাবে’ বেশি টাকা সম্মানী হিসেবে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উপাচার্য হাফিজা খাতুন নিজেই নিয়েছেন ৮ লাখ ৫২ হাজার ৯৯৩ টাকা। আর সহ-উপাচার্য এস এম মোস্তফা কামাল খান ও কোষাধ্যক্ষ কে এম সালাহ উদ্দিন নিয়েছেন ৬ লাখ ৮২ হাজার ৩৮২ টাকা করে। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রি থেকে আয় হয়েছিল ১ কোটি ৯৫ লাখ ৯৪ হাজার ৬০০ টাকা। এর মধ্যে ১৫২ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ১ কোটি ৪১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন। (গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার টাকা ভাগ–বাঁটোয়ারা নিয়ে প্রশ্ন, ২২ জুলাই ২০২৩, প্রথম আলো)

সড়ক কিংবা রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নানা ধরনের রেকর্ড আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সম্মানীর ক্ষেত্রেও রেকর্ডের দাবিদার হতে পারেন পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্যরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় নিজেদের ইচ্ছেমতো ফি তাঁরা নির্ধারণ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বেঁধে দেওয়া নিয়মের তোয়াক্কাও তাঁরা করছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খরচ বাড়ার কথা বলে নিয়ম করেই পরীক্ষার ফি বাড়াচ্ছে।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই সম্মানীর এই চক্ষু ছানাবড়া করা অঙ্ক দেখে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা বলেছেন, জীবনে এত টাকা সম্মানী নেওয়ার কথা কোনো দিন শুনিনি। ইউজিসির নিয়ম অনুযায়ী, ভর্তি ফি বাবদ আয়ের ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু সম্প্রতি উপাচার্যদের সঙ্গে ইউজিসির এক সভায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার ফি আনুপাতিক হারে কমিয়ে ‘যৌক্তিক’ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তখন ঠিক হয়েছিল, ফি কমিয়ে যৌক্তিক করলে আগে যেভাবে ভর্তি ফি বাবদ আয়ের ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দিতে হতো, সেটি দিতে হবে না। ইউজিসির এই সিদ্ধান্তকেই কাজে লাগিয়েছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

এই নজির স্থাপনে তারা যে একমাত্র, তা অবশ্য নয়। গত বছরের অক্টোবর মাসে প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছিল। সে বছর ভর্তি ফি বাবদ বিশ্ববিদ্যালয়টির আয় হয় প্রায় ২০ কোটি টাকা। এর ৪০ শতাংশ, মানে ৮ কোটি টাকা বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে জমা করার নিয়ম থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। বরং সম্মানী বাবদ উপাচার্য নেন ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেন ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। রেজিস্ট্রার নেন ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। শিক্ষকেরা ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা আর কর্মকর্তারা পান ৮২ হাজার ৫০০ টাকা করে।

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার বাস্তবতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া আর হিমালয়ের চূড়ায় ওঠা একই কথা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিটি আসনের বিপরীত ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০, ৬০ আবার কোথাও কোথাও ১০০-এর কাছাকাছি। এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম, যাঁরা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন আর সুযোগ পেয়েছেন। বরং দেখা যায়, ভর্তি পরীক্ষা চলার তিন থেকে চার মাস সময়টার পুরোটাই অনেককে জার্নির ওপরই থাকতে হয়। ফলে পরীক্ষা দেওয়ার পর কোচিং থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তির সঙ্গে বিপুল অঙ্কের টাকাও ব্যয় হয়। ভর্তি পরীক্ষা অভিভাবকদের জন্য যখন বিপুল ব্যয়ের বোঝা, তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্য আয়ের সুযোগ।

বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। শুধু সরকার নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায় থেকে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থায়ন করে। তা দিয়ে নানা ধরনের বৃত্তি চালু থাকে। আমাদের এখানে সেই সংস্কৃতি নেই বললেই চলে। ভর্তি পরীক্ষার ফির টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারার সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। ভর্তি পরীক্ষা কারও কারও অযৌক্তিক আয়ের উপায় হতে পারে না। ভর্তি পরীক্ষার ফি থেকে আসা আয়ের একটা অংশ দিয়ে গড়ে তোলা তহবিল থেকে গরিব শিক্ষার্থীদের ভর্তি ও পড়াশোনার খরচ জোগান দেওয়া যায়। অন্তত এটুকু সামাজিক দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় পালন করতে পারে।

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী