পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধে পাবনায় কৃষকদের বিক্ষোভ
পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধে পাবনায় কৃষকদের বিক্ষোভ

মতামত

চাষিদের কি রাজু ভাস্কর্যে আসতে হবে

রাজবাড়ী জেলার এক পেঁয়াজচাষি মুঠোফোনে জানতে চাইলেন, তাঁরা তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে ঢাকায় এলে কোথায় গেলে কাজ হবে? এর আগে ওদিকে গিয়েছিলাম পেঁয়াজের ভুয়া বীজে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের বারোটা বাজার তত্ত্বতালাশ করতে।

সেই সূত্রেই আলিমুদ্দির কল। আলিমুদ্দি ‘ইলিফের’ (রিলিফ, যাকে আজকালের সভ্য ভাষায় প্রণোদনা বলে) বীজ পাননি। তিনি সাড়ে চার হাজার টাকা কেজি দরে বাজারের বীজ কিনে মুড়িকাটা পেঁয়াজের চাষ করেছিলেন। জমি লিজ, অন্যান্য খরচসহ মোট উৎপাদন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার টাকা।

এখন উৎপাদিত পেঁয়াজ আড়তে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা মণ দরে। আবার চার কেজি অতিরিক্ত দিতে হচ্ছে। এতে লিজের খরচই উঠছে না। মোটা অঙ্কের টাকা লোকসান হবে তাঁর। 

বন্যামুক্ত সময়টা চাষি কাজে লাগাতে চান। মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রির লভ্যাংশ থেকেই তাঁরা পরের ধাপে চারা পেঁয়াজ রোপণ করেন। কিন্তু এবার উৎপাদন খরচই উঠছে না। পরের ধাপের পেঁয়াজ আবাদ নিয়ে অনেকে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। এটাই সবচেয়ে বড় আশঙ্কার। চাষি যদি পয়সা ফেরত না পান, তাহলে তাঁরা কী দিয়ে চারা পেঁয়াজের চাষে নামবেন।

মুড়িকাটা পেঁয়াজ কেন গুরুত্বপূর্ণ

রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া ছাড়া মুড়িকাটা পেঁয়াজের ব্যাপক আবাদ হয় পাবনায়। সেখানকার বিভিন্ন হাটে খোঁজ নিয়ে একই ছবি পাওয়া গেল। আতাইকুলার আড়তদার বাহারুল জানান, ‘পাঁচ বছরে এমন পতন দেখি নাই’।

পাবনায় গত বছর এ সময়েই এক মণ মুড়িকাটা পেঁয়াজের দাম উঠেছে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত। এ বছর পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০০ টাকায়। পাশের জেলা রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চাষি জাকির জানান, তিনি ৪০ বিঘা জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ চাষ করেছেন।

বর্তমান বাজারমূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করতে হলে তিনি পথে বসে যাবেন। এমন হলে চাষিরা আগামী বছর আর পেঁয়াজের চাষ করবেন না। আগের বছর লাভ হওয়ায় এ বছর প্রায় দ্বিগুণ খরচ করে মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ করেছিলেন তাঁরা। 

একটু আগে যাঁরা পেঁয়াজ তুলেছিলেন, তাঁরা ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে কিছুটা দাম পেয়েছিলেন। বাজারে তখন চাষিরা বিক্রি করেছেন দুই হাজার টাকা মণ দরে। কিন্তু এ সপ্তাহে প্রতি হাটে দাম আরও কমেছে। আতাইকুলা বাজারে সবচেয়ে ভালো মানের পেঁয়াজও বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। মুড়িকাটা পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায় না। ফলে দাম যা-ই হোক, বিক্রি করে দিতে হয়। মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদন খরুচে বটে, তবে তা কৃষককে শক্তি দেয় রবিশস্য ধরতে।

বন্যামুক্ত সময়টা চাষি কাজে লাগাতে চান। মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রির লভ্যাংশ থেকেই তাঁরা পরের ধাপে চারা পেঁয়াজ রোপণ করেন। কিন্তু এবার উৎপাদন খরচই উঠছে না। পরের ধাপের পেঁয়াজ আবাদ নিয়ে অনেকে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। এটাই সবচেয়ে বড় আশঙ্কার। চাষি যদি পয়সা ফেরত না পান, তাহলে তাঁরা কী দিয়ে চারা পেঁয়াজের চাষে নামবেন।

আমদানি বন্ধ চান চাষিরা

স্মৃতি হাতড়ে আতাইকুলার আড়তদার বললেন, ২০১৯ সালে এ রকম দরপতন হয়েছিল রাতারাতি। সেবার পেঁয়াজের দাম কমাতে বিমানে করে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করেছিল সরকার। খুচরা ও পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকায় সেই সময় জরুরি ভিত্তিতে সরকার পেঁয়াজ আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেয়।

আড়তদার জানান, বাইরে থেকে পেঁয়াজ না এলে আমাদের লোকসান হবে না। বাঘা উপজেলার চাষিরা ইউএনওর কাছে আমদানি বন্ধের দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। চাষিদের দাবি, ভরা মৌসুমে সরকার পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করলে তাঁরা ন্যায্য দাম পাবেন, শক্তি পাবেন পরের চাষে।

ইউএনও বলেন, তিনি সময়মতো সেটা জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠাবেন। তারপর কবে তা ঢাকায় আসবে আর প্রধান উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করা হবে, কে জানে। চাষিদের আমদানির ফাঁদে ফেলার কথা নীতিনির্ধারকদের অজানা নয়।

বিমানে পেঁয়াজ আমদানির সময় তৎকালীন কৃষিসচিবকে প্রশ্ন করা হলে বিবিসিকে তিনি বলেছিলেন, দেশীয়ভাবে উৎপাদিত পেঁয়াজ যখন বাজারে আসে, তখন আমদানি করা পেঁয়াজও বাজারে থাকায় দেশি পেঁয়াজচাষিরা ন্যায্যমূল্য পান না।

সাক্ষাৎকারে তিনি নিশ্চিত করেছিলেন, ‘পেঁয়াজের উৎপাদন মৌসুমে যেন বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা না হয়, তা নিশ্চিত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছি আমরা।’ বলাবাহুল্য, তত দিনে চাষিদের শরীরে আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। সে বছরের মুড়িকাটা পেঁয়াজের ক্ষতির জের টানতে হয় কয়েক বছর। বিতরণ করা হয় পেঁয়াজ ছাড়া সালুনের রেসিপি। 

চাষিরা নিজের চেষ্টায় ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন

মেহেরপুরের চাষিরা নিজেদের গরজে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ সংগ্রহ করে আবাদ শুরু করেন। দেশের পেঁয়াজ চাষের এক নতুন দিগন্ত খুলে যায়। ভ্রান্তনীতির কারণে এবার তাঁরাও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

স্থানীয় সাংবাদিক জানাচ্ছেন, জেলার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ১০ দিন আগেও খুচরা বাজারে পেঁয়াজ ৮০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। গত ২৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে মানববন্ধন শেষে চাষিরা কুষ্টিয়া-মেহেরপুর সড়ক অবরোধ করেন। খবর পেয়ে ইউএনও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। পরে সেনাসদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। 

শুধু কি পেঁয়াজ

আলু-পেঁয়াজসহ সব ধরনের সবজির দাম অবিশ্বাস্যভাবে কমে এসেছে। বাজারে নতুন আলু ২৫-৪০ টাকা, পেঁয়াজ ৩০ টাকা, বেগুন ২০ টাকা, শিম ২০ টাকা, টমেটো ৩০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৩০ টাকা কেজি এবং বাঁধাকপি প্রতিটি ১০ টাকা ও ফুলকপি প্রতি হালি মাত্র ১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এটা দিনাজপুরের চিত্র।

সবজির রাজ্য যশোর সদর উপজেলার চূড়ামনকাটিতে ২ জানুয়ারি ফুলকপি বাজারে না আনতে পাইকারি বাজারে মাইকিং করা হয়েছে। এদিন প্রতিটি ফুলকপি ১ থেকে ৫ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। কিন্তু সেখানকার খুচরা বাজারে ফুলকপি প্রতিটি আট টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঢাকায় ৬ জানুয়ারি বড় ফুলকপি প্রতিটি ১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে লাভ তো দূরের কথা, বাজারজাত করার গাড়িভাড়া ও শ্রমিকের টাকা পরিশোধের কোনো উপায় নেই। কপি ছাগল-গরুকে খাওয়াতে হবে। 

উপায় কি আছে কিছু

পেঁয়াজ আর আলুর ক্ষেত্রে শুধু আমদানিটা হুঁশের সঙ্গে করলেই কাজ হবে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কৃষির মন্ত্রণা কানে না তুললে চাষিরা রাজু ভাস্কর্য আর শাহবাগ চত্বরে ছুটে আসতে দেরি করবেন না। মেহেরপুর ও পাবনায় তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন।

গত ২৮ এপ্রিল ‘কৃষককে কেন দেড় টাকায় শসা, দুই টাকায় বেগুন বেচতে হয়’ শীর্ষক একটি লেখা ছাপা হয় প্রথম আলোয়। কৃষি আর চাষিকে বাঁচানোর ইচ্ছা থাকলে উপদেষ্টারা লেখাটা আমলে নিয়ে কাজ শুরু করতে পারেন। আপনারা শুরু না করলে চাষিরা শেষ হয়ে যাবেন যে!

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

wahragawher@gmail.com