ভোটের ফলাফল জেনেও ভোট দেওয়ার পেছনে কী

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। সাধারণ ধারণা ছিল ভোটকেন্দ্রে ভোটার হুমড়ি খেয়ে পড়বে না। ভোটার লাইন দীর্ঘ হবে না। সাঁওতাল ঝলং মাঝি বাটি হাতে নির্বাচনী কেন্দ্রে চা খেতে আসবেন না। গ্রামের মা-বোনেরা শাড়ির ভাঁজ ভেঙে সিঁথি কেটে গরুর গাড়িতে চড়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। কচিকাঁচাদের হট্টগোলে ভোটকেন্দ্রের আশপাশ ভরে উঠবে না। কিছু ভোটার আসবেন, ভোট দিয়ে চলে যাবেন।

ভোটের ফলাফল জেনেও অনেকে ভোট দেবেন। কেন? ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে কি কোনো বাধ্যবাধকতা তৈরি হলো?

 নির্বাচন এখন এক জটিল বিষয়, কখনো তা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, কখনো বা রাতে অনুষ্ঠিত হয়, কখনো বা ভোটারবিহীন।

বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচন, শিক্ষক সমিতির নির্বাচন, ব্যবসায়ীদের বিজনেস ক্লাবের নির্বাচন, স্বর্ণকার ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচন, ড্রাইভার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনসহ আরও কত শত রকমের নির্বাচনের খপ্পরে পড়েছে বাংলাদেশ।

নির্বাচন ছাড়া বুঝি বাংলাদেশের আর কোনো পথ নেই! কিন্তু বাস্তবতা হলো নির্বাচন তাকে মুক্তি দিচ্ছে না বরং করছে শৃঙ্খলিত।

রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের রাজনৈতিক সমঝোতার সংযোগ ঘটে ভোটাধিকার চর্চার মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্র হলো জনগণের সিদ্ধান্তের এক সমষ্টি বিশেষ। ভোটাধিকার হরণ হলে রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের খোলসের মধ্যে নাগরিক থাকেন, কিন্তু থাকেন মূল্যহীন ও অসাড় হয়ে।

বাংলাদেশ আজ এ রকম অবমূল্যায়িত জনসমষ্টির আঁধার। হাজার হাজার মানুষের স্বাধীন মতামত দুমড়েমুচড়ে শাসকগোষ্ঠী পছন্দসই মতামত উৎপাদন করে চলেছে। নাগরিক নাগরিক না থেকে হয়ে উঠছে কেবল প্রশ্নহীন সম্মতি প্রদানের প্রতিভূ।

ভোটার উপস্থিতির পরিসংখ্যান দেখে বলা যায়, এতে জনগণের কৌশলগত ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের সঙ্গে জনগণের এ এক কৌশলগত অভিযোজন, তার হার যা-ই হোক না কেন, ২৭.১৫, ৪০ বা ৪১.৮ ভাগ।

বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় জনগণ কৌশলী হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া জনগণের সামনে উন্নত কোনো বিকল্পও নেই। কারণ, প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা আজ নড়বড়ে। শাসকের ইচ্ছাই আইন ও তা চূড়ান্ত। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ সম্ভাবনা নয়, সুরক্ষা খোঁজে। শাসকের ইচ্ছায় প্রাবল্য বাড়ালে কর্তৃত্ববাদ পোক্ত হয়ে ওঠে।

নির্বাচনের অন্তর্নিহিত বিষয় হলো অনেকগুলো বিকল্প থেকে সবচেয়ে উত্তম বিকল্পটি বেছে নেওয়া। যেখানে পছন্দের সুযোগটি সংকুচিত বা বাধ্যতামূলক, তা কার্যকর নির্বাচন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় মুক্ত-অবারিত, স্বাধীন ভোটের পরিবেশ তৈরি হলো নাকি আয়োজিত, বাধ্যতামূলক ভোট প্রদানের খপ্পরে পড়ল?

এটা সত্য, প্রজ্ঞাপন দিয়ে বাধ্যতামূলক ভোটের সংস্কৃতি চালু করা হয়নি। তবে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, ভোট যে দিতে হবে, এমন পরিস্থিতি অনেকের কাছে তৈরি হয়েছে। ভোট দেওয়া না-দেওয়ার অধিকারের সীমারেখা ক্ষীণ হয়ে আসছে। কার্যত ভোট দিতে হবে, এমন একটি মনোভঙ্গি শহরের তুলনায় গ্রামে জোরালো হয়েছে। কারণ, গ্রাম ও শহরের রাজনীতি এক নয়।

গ্রামের রাজনীতির নেটওয়ার্ক ও সমীকরণে রয়েছে ভিন্ন মাত্রা। গ্রামের মানুষ একে অপরের সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক দুই ধরনের সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। শহরের ক্ষেত্রে তা কিছুটা আলাদা। গ্রামের সম্পর্কটি নিবিড় এবং শহরেরটি কিছুটা নমনীয়।

গ্রামে ব্যক্তির রাজনৈতিক স্বাধীন সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে, শহরের ক্ষেত্রে হয়তো তা এতটা প্রবল নয়। তাই শহর যত সহজে অবস্থান নিতে পারে, গ্রাম তা পারে না। যেমন রাজশাহী-০২ সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় ভোটের হার শতকরা ২০ ভাগের মতো, অন্যদিকে গ্রাম নিবিষ্ট অন্যান্য পাঁচটি নির্বাচনী এলাকায় তা ৪০ ভাগ বা কোথাও-বা ৫৩ বা ৫৪ ঠেকেছে।  

কর্তৃত্বশালী গোষ্ঠীর প্রতি গ্রামের মানুষের রাজনৈতিকভাবে নির্ভরতা বেড়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে ব্যক্তির জীবন-জীবিকা, নিরাপত্তা, ব্যবসা-বাণিজ্য, আয়রোজগার ও  সামাজিক মানমর্যাদার গভীর সম্পর্কে যে কৃষক হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ছেলেকে মাস্টার্স পাস করালেন, যার একটি চাকরি দরকার, তাকে ভোটের সিদ্ধান্ত নিতে হয় প্রবহমান ধারার সঙ্গে সংগতি রেখে।

ভোটের পর গ্রামের পাশের স্কুলে নিরাপত্তা প্রহরীর নিয়োগ হবে, একজন তরুণ ভোটার যার চাকরি প্রয়োজন, এমন পরিস্থিতিতে তার ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত সরল নয়। ভোটের আগে গ্রামের গভীর নলকূপের অপারেটর কে হবেন, তা নিয়ে কথা উঠলে চিন্তায় পড়েন একজন অপারেটর পদপ্রত্যাশী ভোটার। অনাকাঙ্ক্ষিত মামলায় জড়িয়ে যাওয়া পরিবারের পক্ষে স্বাধীনভাবে ভোটের সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়। কারণ, জেলহাজতে থাকা ছেলেটির জামিন শুনানি আছে ভোটের পরে।

যখন শাসক দলের সমর্থকেরা জুমার নামাজ শেষে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে অনুরোধ করেন বা বাসায় ভোটের নম্বরসহ স্লিপ ধরিয়ে দেন, তখন যে কিছুটা শঙ্কা বা ভয় কাজ করে না, তা তো অস্বীকার করা যাবে না। পরে কিনা খবর নেই।

ভোটের সিদ্ধান্ত এখন শর্তযুক্ত সিদ্ধান্ত-আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অভিযোজনের মোক্ষম দাওয়ায়। নির্মোহ বা যুক্তিশীল সিদ্ধান্ত বলে বিশেষ কিছু নেই। ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত যতটা বস্তুনিষ্ঠ ও যৌক্তিক, তার চেয়ে অনেক বেশি স্বার্থ ও নিরাপত্তাবোধ-প্রসূত।

ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বাধীন চিন্তার বহিঃপ্রকাশ গ্রাম পরিসরে বিশেষ অবশিষ্ট নেই। কাঠামোগতভাবে তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বাধ্যতামূলক ভোট প্রদানের জন্য আলাদাভাবে নির্দেশনা লাগছে না। কারণ, বাধ্যতামূলক ভোট প্রদানের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শাসকগোষ্ঠীর প্রতি জনগণের এ নির্ভরতা কর্তৃত্ব জিইয়ে রাখতে কাজে লাগছে। অন্যদিকে এমন পরিস্থিতি কর্তৃত্ববাদী শাসনের উপজাত।

চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সমাজে এক অনুগত শ্রেণি তৈরি করেছে। এ অনুগত শ্রেণি মূলত তাদের স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। তারা ছোটখাটো বিষয়ে সমাজে বিভক্তি তৈরি করছে ও জনজীবন বিষিয়ে তুলছে, সুবিধা তুলে নিচ্ছে। ঘটে যাওয়া বাধ্যতামূলক ভোট প্রদান পরিস্থিতি সমাজকে ঘামিয়ে তুলছে।

জনগণ জানে ভোটের ফলাফল কী হবে, তারপরও তাঁরা ভোট দিচ্ছেন, কেউ তা দিচ্ছেন বিশেষভাবে উৎসাহ নিয়ে। ভোট যেন ‘নষ্ট’ না হয়, এমন পরামর্শ আসছে হরহামেশাই। যে নির্বাচনে ফলাফল নির্ধারিত, সেখানে প্রতিটি ভোটই মূলত নষ্ট ভোট। কারণ, এ প্রক্রিয়ায় একই দলের হয় আমি না হয় ডামি জিতবে। একই দল একসঙ্গে জিতবে আবার হারবে। জয়-পরজয়ের মধ্য দিয়ে এত বড় জয় অর্জিত হবে, যা হজম করা সহজ হবে না।

পঙ্কিল রাজনীতির যে কালো ছায়া পড়েছে তা সরিয়ে শঙ্কাহীন, অবারিত ও মুক্ত ভোটের পরিবেশ তৈরি সহজ কাজ নয়। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

নির্বাচন মূলত নির্বাচন কমিশনের সীমানার বাইরে চলে গেছে। ভোটের প্রচার-প্রচারণায় সবার সমান সুযোগের মধ্যে স্বাধীন ভোট প্রদানের বিষয় সীমিত নেই। নেই ভ্রাম্যমাণ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের মধ্যে। ব্যক্তির স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার ইতিমধ্যে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

কেবল ভোটপূর্ব বা ভোট চলাকালীন ভোটারের নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভোট-পরবর্তী দীর্ঘ মেয়াদে স্বস্তি ভোটারের কাছে সবচেয়ে অগ্রগণ্য। কোনো জটিল পরিস্থিতির মুখে পড়লে কে এগিয়ে আসবেন, তা ভোটারদের ভাবতে হচ্ছে, বিশেষত গ্রামের ভোটারদের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষের পাশে প্রতিষ্ঠান নেই, আছে কেবল ব্যক্তি সম্পর্ক। আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সম্পর্কগুলো রক্ষার ব্যাপারে গ্রামের মানুষ খুব যত্নশীল হয়ে উঠছে। নানা ধরনের সম্পর্ক রক্ষায় বড় একটা সময় কাটাতে হচ্ছে।

নির্বাচনের অন্তর্নিহিত বিষয় হলো অনেকগুলো বিকল্প থেকে সবচেয়ে উত্তম বিকল্পটি বেছে নেওয়া। যেখানে পছন্দের সুযোগটি সংকুচিত বা বাধ্যতামূলক, তা কার্যকর নির্বাচন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় মুক্ত-অবারিত, স্বাধীন ভোটের পরিবেশ তৈরি হলো নাকি আয়োজিত, বাধ্যতামূলক ভোট প্রদানের খপ্পরে পড়ল?

আজকের এ পরিস্থিতির দায় সরকারি দল, বিরোধী দল ও জনগণ কেউ এড়াতে পারে না, পারে না সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। স্বাধীনতার ৫০ বছরে মুক্ত ও স্বাধীন ভোটের পরিবেশ তৈরি হলো না। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র পরিচালনার উত্তম কৌশলের মূল ভিত্তি হলো জনগণের মতের প্রকৃত প্রতিফলন।

  • খান মো. রবিউল আলম যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও লেখক