সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

যেখানে ব্যতিক্রম ও অনন্য সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সাহিত্যের ছাত্র, কিন্তু সরাসরি সাহিত্য রচনার সংখ্যা বেশি নেই। এমনকি সাহিত্য বিষয়ে তাঁর রচনাও গতানুগতিক সমালোচনা অতিক্রম করে গদ্য সাহিত্যে বা প্রবন্ধ সাহিত্যে রূপ নিয়েছে।

কবিতার তুলনায় গদ্য রচনার ভুবন অপেক্ষাকৃত বিশাল ও দিগন্তবিস্তারী, ফলে গদ্য রচনার অর্থই যেমন সাহিত্য নয়, তেমনি সব গদ্য রচনাই সাহিত্য পদবাচ্য নয়, সে বিষয়ে নিশ্চিত। যেসব গদ্য রচনা সাহিত্য, সেখানেও কবিতার অনুরূপ মানের অনুরূপ নয়।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গদ্য রচনার ক্ষেত্রে এটা অনেক বেশি উল্লেখযোগ্য এ কারণে যে তাঁর অধিকাংশ লেখা সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি সম্পর্কযুক্ত, এখানে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর হাতে যা উচ্চমানের সাহিত্য হয়েছে, অপর কোনো দুর্বল ক্ষমতাহীন লেখকের হাতে তা কখনো সাংবাদিকতা, পাঠ্যপুস্তক, গতানুগতিক সমালোচনা গ্রন্থ, বিষয়ভিত্তিক নোট বই হয়ে উঠতে পারে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ব্যতিক্রম এখানেও এবং এ জন্য যে তাঁর বক্তব্যগুলো মৌলিক, সৃষ্টিশীল, প্রকাশশৈলী উচ্চ মানের শৈল্পিকতামণ্ডিত, অবশ্যম্ভাবী নিজস্ব রূপে, এরূপ দ্বিতীয় আর কোনো দৃষ্টান্ত এখানে নেই, এখনো নেই। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্রাটের মতো তাঁর নিজস্ব ভুবনে, তাঁর এ অবস্থান এবং অর্জন এখনো বিকল্পহীন।

দৃশ্যত কোনো বিষয়বস্তু এবং তা নিয়ে লেখা যেখান থেকেই শুরু হোক না কেন, বিভিন্ন মাত্রায় সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি সেসবের সঙ্গে ক্রমেই এসে যুক্ত হয়, সব বিষয়ের মিলিত রূপে তা একধরনের মৌলিকত্ব প্রাপ্ত হয়, সেভাবে তুলনাহীন অনিন্দ্য উপসংহারও সৃষ্টি করে তোলে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রচনায় সমাজ গুরুত্ব পেয়েছে তা ঠিক, তবে সমাজ প্রসঙ্গের কথা বলা হচ্ছে আসলে একে প্রকাশ করার জন্য এবং পাঠকের উপলব্ধির সুবিধার জন্য, প্রকৃতপক্ষে তাঁর লেখাগুলো আর্থসামাজিক একপ্রকার চিন্তাভুবনের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়।

বিশেষ অর্থে তা হলো ইহজাগতিক মানুষের কথা, এ মানুষ একাকী নিঃসঙ্গ বাস করে না বলে, বিভিন্ন মানুষের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এ মানুষের বিকাশ সম্পূর্ণতা পায় বলে একে পারিভাষিকতা দিয়ে সমাজ বলা হচ্ছে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রচনায় এভাবে মানুষ এসেছে, ইহজাগতিক মানুষ এসেছে এবং মানুষের কথাই প্রধান হয়েছে বলে তাকে একত্রে সে মানুষের বিকাশের ক্ষেত্র সমাজের কথা বলা হচ্ছে। এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত প্রসঙ্গ হলো সংস্কৃতি, এ সমাজ যেমন এ ইহজাগতিক মানুষের অস্তিত্বের প্রকাশ, তেমনি এ সংস্কৃতিও হলো সে রূপ সামাজিক মানুষের ইহজাগতিক আত্মপ্রকাশের কথা, পারস্পরিক সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়ার কথা, একত্রে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রচনায় এরপরেই নিবিড়ভাবে আসে রাজনীতির কথা, একমাত্র তাঁর লেখাতেই রাজনীতির তাত্ত্বিকতাপূর্ণ সমগ্রতা এভাবে এসেছে। তাঁর রচনায় রাজনীতির একটি বিশেষায়িত দিক আছে, যা অন্য কারও সঙ্গে মেলে না, প্রকৃতই মেলে না।

সুতরাং ইহজাগতিক মানুষ আছে বলে সমাজ আছে, সমাজ আছে বলে সংস্কৃতি এসেছে, এ সমাজ ও সংস্কৃতি হলো ইহজাগতিক সামাজিক মানুষের সামগ্রিক আত্মপ্রকাশের কথা, সম্মিলিতভাবেই।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রচনায় এরপরেই নিবিড়ভাবে আসে রাজনীতির কথা, একমাত্র তাঁর লেখাতেই রাজনীতির তাত্ত্বিকতাপূর্ণ সমগ্রতা এভাবে এসেছে। তাঁর রচনায় রাজনীতির একটি বিশেষায়িত দিক আছে, যা অন্য কারও সঙ্গে মেলে না, প্রকৃতই মেলে না।

সাধারণভাবে রাজনীতির ভুবনটি বেশ বড়, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতির সব ভুবনই অত্যন্ত বড়, তবে রাজনীতির কথাগুলো হয়তো আরেকটু বড় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নিজের মতো করে নিয়ে।

এক হিসেবে রাজনীতি হলো অনেকটা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জীবনকেন্দ্রিক, তাদের নিবিড় উপলব্ধিকেন্দ্রিক, সেখান থেকে প্রসারিত হয়ে সমাজ ও জীবনের বিভিন্ন প্রান্তিকে পৌঁছে যায়।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখায় রাজনীতি হলো তাঁর উপলব্ধিকৃত সমাজ–সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে, এর ফলে তাঁর পূর্ণ উপলব্ধি ভুবনের সঙ্গে তা যুক্ত হয়ে তাঁর ঈপ্সিত মানুষের কাছে, আরও বিশেষায়িত রূপে প্রলেতারীয় মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।

সে অর্থে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সমগ্র সৃষ্টিকর্মে রাজনীতির বাণীরূপ আসলে প্রলেতারীয় মানুষের জন্য এবং মার্ক্সীয় শ্রেণিসংঘাতের বা শ্রেণিদ্বন্দ্বের ওপর ভিত্তি করে মানুষের বিজয়ের কথা সেখানে আছে, এ মানুষ কোথাও কখনো ধর্ম, বর্ণ, ভাষা এবং অন্য কোনো সীমাবদ্ধতার মধ্যে বন্দী হয়ে নেই।

তাঁর রচনায় কখনো নৈরাশ্য নেই, ব্যক্তিগত জীবনের চূড়ান্ত দুঃখের দিনের দুঃখের কথার মধ্যেও কখনো তাঁর আশাবাদ নিঃশেষিত হয়ে যায়নি। ট্রাডিশনাল রাজনীতিকথার এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিকতার সঙ্গে এগুলো মিলবে না। এ কারণে কখনো কারও কাছে তা হয়তো ইউটোপীয় বলে মনে হয়েও থাকতে পারে, কিন্তু প্রকৃতই তা নির্বস্তুক অসম্ভবতার মধ্যে নিঃশেষিত হয়ে যায় না, কখনো হতাশা একে আচ্ছন্ন করে না, কিংবা ঢেকে দেয় না।

এগুলো তাঁর গভীরমূল বিশ্বাস এবং উপলব্ধির অন্তর্গত, এখানেও যে তিনি সমকালীন প্রথাবদ্ধ রাজনীতির এবং অন্যান্য মঞ্চে নিজেকে বিলীন করে দেননি, নিজস্ব কিছু অপরূপ বৈশিষ্ট্য কিংবা ব্যতিক্রম সর্বত্রই বিদ্যমান রেখেছেন। এ কারণেও রাজনীতির বিভিন্ন টানাপোড়েনের মধ্যে, সুযোগ–সুবিধার বিকিকিনির মধ্যে তাঁকে কোথাও কখনো পাওয়া যায়নি, এরূপ ব্যতিক্রম এখানেও হয়তো বিরল, হয়তো আর নেইও।

সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিষয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর উপলব্ধির ভুবন তাঁর নিজস্ব, কেবল যে সমকালীন মানুষকে তিনি কিছু দিয়ে গেলেন, তা–ই নয়। এ কথা বিশ্বাস করতে খুবই আগ্রহ জন্মে যে একদিন এরূপ ভুবনের সমগ্রতার মধ্যেই এ মানুষের আত্মজাগরণ ঘটবে।

সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির এ মিলিত রূপের মধ্যে আছে এ ভুবনের পূর্ণ উত্তরাধিকার, বাঙালি মানুষের, হয়তো পূর্ব বাংলার, একালের বাংলাদেশের মানুষের বেশি করে, হয়তো সম্পূর্ণরূপেই। এ দেশের মাটিতে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আছেন এবং থাকবেন, তাঁর মতো এরূপ বিরল দৃষ্টান্তময় উপস্থিতি আর হয়তো নেই।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রচনারীতি তাঁর সমগ্র বিষয়বস্তুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এবং তাঁর মতো করেই, এরূপ আর নেই। তাঁর রচনারীতির মধ্যে নতুন নতুন বর্ণ সংযুক্ত হয়েছে অনেক, বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, রচনারীতি নিয়ে তাঁর বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্যে কখনো ছন্দপতন হয়নি।

তাঁর রচনারীতির দুটি দিক, এক. শব্দের ব্যবহার, দুই. বাক্যের গঠন, দুইয়ে মিলে পূর্ণতার দিকে নিয়ে এক অপরূপ ভুবন গড়ে তোলে। তাঁর ব্যবহৃত শব্দ ট্রাডিশনাল, কিন্তু সেসবের ব্যবহার কিংবা প্রায়োগিকতা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভুবন থেকে, এখানেই তাঁর অপরূপ বৈশিষ্ট্য এবং অন্যের সঙ্গে তাঁর মিল নেই।

এ পর্যন্ত বাংলা ভাষার ব্যবহৃত, এবং ব্যবহৃত একই শব্দ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর হাতে তাঁর ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এবং তাঁর নিজস্ব ভুবনে এসে কী সমৃদ্ধ হতে পারে তা এখানে, তার প্রায় সব রচনাতেই পাওয়া যাবে।

সব বড় প্রতিভাই বিকল্পহীন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বিকল্প যে হতে পারেনি, এতেই তাঁর প্রকৃত সৃষ্টির ভুবন সুচিহ্নিত হয়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর লেখালেখির সঙ্গে একত্রে সৃষ্টি হয়ে আছে, একটি বর্ণাঢ্য সময় এবং ভুবনকেও তিনি সৃষ্টি করে তুলেছেন। সৌভাগ্য যে আমাদের মধ্যে, আমাদের কাছে, আমাদের সামনে তাঁকে আমরা পেয়েছি।

২৩ জুন অসামান্য সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৮৯তম জন্মদিনে তাঁর প্রতি অফুরন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জ্ঞাপন করছি।

  • ড. বদিউজ্জামান বাংলা একাডেমির গবেষণা বিভাগের সাবেক পরিচালক