সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের তরুণদের মধ্যে অভিবাসনের ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে দেখা গেছে। অনেক সময় বিপজ্জনক পথে বিদেশে যেতে গিয়ে অনেককে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। এই ছবিটি ২০২১ সালের জুলাই মাসের। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির পর উদ্ধার হওয়া মানুষের মধ্যে অনেক বাংলাদেশি শরণার্থী ছিলেন। এই বাংলাদেশি তরুণদের তিউনেশিয়ার আশ্রয় কেন্দ্রে দেখা যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের তরুণদের মধ্যে অভিবাসনের ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে দেখা গেছে। অনেক সময় বিপজ্জনক পথে বিদেশে যেতে গিয়ে অনেককে প্রাণ হারাতে হচ্ছে।  এই ছবিটি ২০২১ সালের জুলাই মাসের। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির পর উদ্ধার হওয়া মানুষের মধ্যে অনেক বাংলাদেশি শরণার্থী ছিলেন। এই বাংলাদেশি তরুণদের তিউনেশিয়ার আশ্রয় কেন্দ্রে দেখা যাচ্ছে।

এক কোটির বেশি ‘নিষ্ক্রিয়’ তরুণ নিয়ে কী করে এগোবে বাংলাদেশ?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক প্রকাশনা ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস, ২০২২’ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, বাংলাদেশে বর্তমানে এক কোটির বেশি তরুণ ‘নিষ্ক্রিয়’ অবস্থায় আছেন।

দেশের সর্বশেষ জনশুমারি থেকে প্রাপ্ত এই তথ্য আমাদের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগজনক। এই ‘নিষ্ক্রিয়তা’র অর্থ মূলত এই যে, দেশে ১৫-২৪ বছর বয়সীদের একটি বড় অংশ কোনো প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ, দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ গ্রহণ কিংবা পেশাগত দায়িত্ব পালনের সঙ্গে যুক্ত নন।

তরুণদের এই নিষ্ক্রিয়তা আমাদের সমাজ ও অর্থনীতির সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিতের পথে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

জনশুমারি ও গৃহগণনা রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী, দেশে ১৫-২৪ বছর বয়সী তরুণদের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ১৬ লাখ। দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখের ১৯ শতাংশের বেশি এই বয়স-শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।

এই তরুণদের প্রায় ৪১ শতাংশ যদি সঠিক সময়ে যথাযোগ্য পেশাদারি বা কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকায় যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে উদাসীনতা প্রকাশ করেন, সেটি কোনোভাবেই বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক নয়।

এ চিত্রটি হওয়ার কথা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ, ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ জনমিতিক লভ্যাংশের সুবিধা ভোগ করছে, যেটি ২০৪০ সালের মধ্যেই দেশের আর্থসামাজিক প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হয়ে উঠবে বলে আমাদের প্রত্যাশা ছিল।

দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশের বেশি হওয়া সত্ত্বেও এই সম্ভাবনাময় জনশক্তির উপযোগিতা অনুধাবন ও তাঁদের যথাযথ উপায়ে কাজে লাগানোর ব্যর্থতা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক পরিণাম বয়ে আনতে পারে।

রিপোর্টটি প্রকাশের পর থেকেই বিশেষজ্ঞ ও গবেষকেরা এর কারণ অনুসন্ধানে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করছেন। খাতসংশ্লিষ্টদের আলোচনায় দারিদ্র্য, লিঙ্গবৈষম্য, বাল্যবিবাহ, হাতে-কলমে শিক্ষার অপ্রতুলতাসহ বিভিন্ন সমস্যা উঠে এসেছে।

এ ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি কারণ বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়, যেমন শুধু পাঠ্যপুস্তকনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা, পাঠ্যপুস্তক প্রদত্ত জ্ঞান ও বাজার চাহিদার তফাত এবং মেধাবী তরুণদের যোগ্যতা ও চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চাকরির অভাব।

একই পটভূমিতে ‘ব্রেন ড্রেইন’ বা মেধা পাচার প্রসঙ্গেও আলোকপাত করা প্রয়োজন। কারণ, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের তরুণদের মধ্যে অভিবাসনের ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে দেখা গেছে।

বিগত ১৫ বছরে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা তিন গুণ বেড়েছে, যা একদিকে বর্তমানের তরুণদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপের পরিচয় দিলেও একই সঙ্গে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতের ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনীয়তাকেও তুলে ধরছে।

জনমিতিক লভ্যাংশের যে সুবিধার কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে, তা ভোগ করার জন্য আমাদের এমন তরুণ জনগোষ্ঠী প্রয়োজন, যাঁদের মধ্যে দক্ষ মানবসম্পদ হয়ে ওঠার তাগিদ রয়েছে।

নিজেদের পছন্দসই বিষয় নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি প্রায়োগিক দক্ষতা অর্জনে জোর দিয়ে দেশের তরুণেরা স্থানীয় শ্রমবাজারে গতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেন।

গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে আমরা দেখেছি, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে তরুণদের এই নিষ্ক্রিয়তার হার কম, অন্যদিকে স্বল্প আয়ের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই হারের সামঞ্জস্য রয়েছে।

অর্থাৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত পশ্চাৎপদতা তরুণদের নিরুৎসাহের একটি বড় কারণ। আমরা যদি তরুণদের সামনে বিশ্বমানের শিক্ষার সুযোগ গড়ে তুলতে পারি, যদি বিশ্বনাগরিক হিসেবে তাঁদের ক্যারিয়ারে আরও বড় পরিসরে চিন্তার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের চর্চাকে উৎসাহিত করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মও দেশকে আরও অনেক বেশি সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবে।

এই লক্ষ্য অর্জনে আমাদের দেশের শ্রমবাজারে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে হবে এবং ভিন্ন ভিন্ন পেশা ও ধারার মানবসম্পদের জন্য সমান অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরিতে গুরুত্ব দিতে হবে। বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে আমাদের বৃহত্তর মানবপুঁজির সঠিক প্রয়োগ ও বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে আমাদের তরুণদের নিজস্ব মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কারণ, বিশ্বায়নের এই সময়ে ইন্টারনেট ও ডিজিটালের সুবিস্তৃত পরিসরে তরুণদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব চিন্তাধারা ও ঝোঁক গড়ে উঠছে, যার প্রচ্ছন্ন প্রভাব তাঁদের ক্যারিয়ারের পরিকল্পনাতেও দেখতে পাওয়া যায়।

আমাদের এই পরিবর্তন সহজভাবে নিতে হবে এবং তরুণদের ওপর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও ব্যাংকার হওয়ার চাপ তৈরির পরিবর্তে তাঁদের ঝোঁক ও সহজাত দক্ষতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ দিতে হবে।

প্রক্রিয়াটি সহজ নয়, কিন্তু এর ফলাফল হতে পারে অভাবনীয় ও সুদূরপ্রসারী।

তরুণদের জন্য শিক্ষার অভিজ্ঞতা উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষাপদ্ধতি প্রচলন আমাদের মূল্যবান জনমিতিক লভ্যাংশের সদ্ব্যবহারের সেরা উপায় হতে পারে।

সেই সঙ্গে বাজারমুখী শিক্ষা অর্থাৎ প্রায়োগিক দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া শিক্ষা তাঁদের নিরাপদ ও সচ্ছল ভবিষ্যৎ গড়তে আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে।

তরুণদের নিষ্ক্রিয়তা একটি আর্থসামাজিক সমস্যা, যার ভিন্ন ভিন্ন উৎস বা কারণ থাকতে পারে। জাতিসংঘ নিজেদের এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট) লক্ষ্যমাত্রার অধীনে এই সমস্যা নিরসনে জোর দিয়েছে এবং তরুণদের জন্য টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থান নিশ্চিতের লক্ষ্যে সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে।

সুতরাং বাংলাদেশের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষাপ্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত সবাইকে, সেই সঙ্গে শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদেরও নিজেদের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনতে হবে।

জনমিতির লভ্যাংশ রীতিমতো একটি আশীর্বাদ, যেটিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের উদাহরণ প্রতিনিয়ত তৈরি করেছে। বাংলাদেশকেও এই সুবিধা দ্রুত ও কার্যকরী উপায়ে কাজে লাগানোর দিকে মনোযোগী হতে হবে।

স্থানীয় শ্রম বাজারকেন্দ্রিক পরিকল্পনার ঊর্ধ্বে উঠে আন্তর্জাতিক পরিসর ও বৈশ্বিক বাজারের জন্য মানবসম্পদ তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়। লিঙ্গবৈষম্য বা বাল্যবিবাহের মতো সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে নারী ও কিশোরীদের জন্য আলাদাভাবে আর্থিক ও সামাজিক প্রণোদনা সুবিধা প্রদানের ব্যাপারে ভাবতে হবে।

একই সঙ্গে গোটা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়নে জোর দিতে হবে। দেশের সীমারেখার মধ্যেই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষার সুবিধা নিশ্চিতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ ক্ষেত্রে আরও বেশি বেশি আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব গঠন করে স্থানীয় মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্বনাগরিক হয়ে ওঠার পথ সুগম করতে হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখের কাছাকাছি। একই সঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দেশে শিক্ষিত বেকারের হার প্রায় ৪৭ শতাংশে ঠেকেছে অর্থাৎ কাগজে-কলমে পর্যাপ্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরিপ্রার্থী তরুণদের প্রায় অর্ধেক কর্মহীনতার গ্লানি বহন করছেন।

দেশে কিশোর ও তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অপরাধপ্রবণতা, মাদকাসক্তি, হতাশা, অবসাদ ও আত্মহত্যার হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ার পেছনে এটিও একটি বড় কারণ বলে মনে করেন সমাজবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।

তরুণদের নিজেদের অন্তর্নিহিত সক্ষমতার গুরুত্ব বোঝানো না গেলে, তাঁদের নিজেদের মেধা ও দক্ষতা চর্চায় অনুপ্রাণিত করে তোলা না গেলে, এই সমস্যাগুলো আরও প্রকট আকার ধারণ করবে।

জনমিতির লভ্যাংশ রীতিমতো একটি আশীর্বাদ, যেটিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের উদাহরণ প্রতিনিয়ত তৈরি করেছে। বাংলাদেশকেও এই সুবিধা দ্রুত ও কার্যকরী উপায়ে কাজে লাগানোর দিকে মনোযোগী হতে হবে।

স্থানীয় মানবসম্পদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের পথ তৈরি করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুযোগ্য বিশ্বনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই।

  • মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন, ডিন অব একাডেমিক অ্যাফেয়ার্স, ইউনিভার্সাল কলেজ বাংলাদেশ (ইউসিবি)