সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

মতামত

কার অধিকার আদায়ে তরুণদের এ মিছিল

অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক আন্দোলনের ঢেউ কি ইথারে ভেসে এল বাংলাদেশেও?

উত্তর হলো—‘না’। কারণ, ২০২৪-এর ঢাকার ছাত্র-শিক্ষক বিক্ষোভগুলো মোটেও পরার্থপরতার বিক্ষোভ নয়।

পশ্চিমে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণেরা প্রতিবাদ করছেন গাজায় ইসরায়েলের বর্বর হত্যাকাণ্ডের, যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধনীতির নিন্দায়।

আর আমাদের এখানকার বিতর্কিত পেনশন-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষকদের কিংবা সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন হলো তাঁদের নিজেদের স্বার্থের আন্দোলন। এখানে জাতীয় সংগ্রামের কোনো ব্যাপার নেই।

যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যত্র নামকরা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাম্প্রতিক এই প্রতিবাদের অগ্রভাগে আছেন জেন-জি (জেনারেশন জুমার্স) খ্যাত তরুণেরা।

তাঁদের চেতনা ও স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল আমাদের ছাত্রজীবনের কথা মনে করিয়ে দেয়।

১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদকে হটিয়ে ভোটাধিকারসহ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত আন্দোলনে কারফিউ ভাঙাটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রজন্ম এখনো সঠিক কাজ বলেই মনে করে।

‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ বলেই একসময় যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান দখলের প্রতিবাদ হয়েছে এ দেশে।

উঠতি বয়সের টগবগে রক্ত অন্যায় ও তাচ্ছিল্য সহ্য করতে পারে না বলেই নিষ্পাপ কিশোর ও তরুণেরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করেছিলেন ২০১৮ সালে।

তারও আগে (২০১৫ সালে) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে রাস্তায় নামেন।

কয়েক দফায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা সিভিল সার্ভিসে সংরক্ষিত আসনব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করেছেন, যেমন এখন করছেন। তাঁরা যথেষ্ট শ্রেণি-স্বার্থ সচেতন!

সে তুলনায় ১৯৭০, ’৮০ ও ’৯০-এর দশকের তরুণেরা নিজেদের নিয়ে অনেকটাই উদাসীন এবং আন্দোলনের ইস্যুতে উন্নাসিক ছিলেন। ধান্দাবাজির গুরুত্ব তাঁরা খুব একটা বুঝে উঠতে পারেননি, অন্তত কর্মজীবনের অনেকগুলো বছর সংকটে না কাটানো পর্যন্ত।

সে সময় পরিবার ছোট রাখার পক্ষে একটি বিজ্ঞাপনে কথক বলেছিলেন ‘আছিলাম বোকা, অইলাম বুদ্ধিমান’।

সেই ‘বুদ্ধিমত্তা’ যদি শতকরা ১০০ ভাগ সফল হতো, তাহলে ব্যাপক তরুণ জনগোষ্ঠীর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যে জনমিতির সুবিধা (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) ভোগ করছে, সেই সুবিধা হয়তো ভোগ করা হতো না।

তবে জনমিতির সুবিধা থেকে তথা মেধাবী তরুণ জনগোষ্ঠীর সুবিধা বঞ্চিত হওয়ার সব আশঙ্কা অবশ্য অন্যভাবে তৈরি হয়ে গেছে এরই মধ্যে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানসম্মত শিক্ষার অনুপস্থিতিতে উচ্চশিক্ষার্থে ও চাকরির সন্ধানে বিদেশমুখী মিছিল বিমানবন্দরে।

দেশে বেকার মানুষ অনেক, অথচ চাকরিতে দক্ষ লোকের অভাব। যেকোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়মিত ঘটনা।

এসব কি জাতীয়ভাবে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সদ্ব্যবহারের প্রমাণ?

আমাদের জেনারেশন এক্স যদি বেশি আদর্শিক এবং কিছুটা সেকেলে হয়ে থাকে, ধরে নিয়েছিলাম পরেরটি (মিলেনিয়াল এবং পরবর্তী প্রজন্ম) আরেকটু চালাক-চতুর ও সৌভাগ্যবান হবে।

অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং নব্বইয়ের গণতন্ত্রায়ণের সুফল তারা পাবে বলেই আশা করেছিলাম।

পৃথিবীতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে স্মার্ট জনগোষ্ঠী জেন জি বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিতে এক অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতায় বেড়ে উঠছে। তাদের ক্যাম্পাসজীবন জাতীয় অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দৃষ্টান্তহীন।

আজকে তাঁদের আন্দোলনে নামানো হয়েছে বিসিএস পরীক্ষায় ন্যায়সংগত সুযোগ পাওয়ার দাবিদাওয়ার পর্যায়ে!

‘যবে অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না...আমি সেই দিন হব শান্ত’-বিদ্রোহী তরুণের সেই কণ্ঠস্বর কোথায়?

কিসের দেশ গড়ার সংগ্রাম, তাঁরা অবসন্ন আসন্ন ভোগবাদী জীবনযুদ্ধে কী করে টিকে থাকা যাবে, সেই ভাবনাচিন্তায়! জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় সংসারাভিজ্ঞ হওয়ার আগেই সংসারের উদ্বেগ তাঁদের মরিয়া করে ফেলেছে।

একটি চাকরিই যেন জীবনের সব।

আশপাশের বৃহত্তর বাস্তবতার দিকে তাকানো এবং পরিবর্তন ঘটানোর ফুরসত ও সাহস নষ্ট করা হয়েছে তাঁদের তারুণ্যেই।

কে বলবে এই যে চাকরির অভাব, বিনিয়োগে মন্দাভাব, বাজার ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, চাঁদাবাজি, অর্থ পাচার, ডলার-সংকট, কর্মকর্তাদের সীমাহীন দুর্নীতি, ভিন্নমতের মিছিলবিহীন ক্যাম্পাস এবং জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের পরিবেশ না থাকা—সবই একসূত্রে গাঁথা।

আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা কি একবার ভেবে দেখেছেন, তাঁদের ইস্যুটির সঙ্গে দেশের শিক্ষা, গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং জাতীয় স্বার্থের কোনো সম্পর্ক আছে কি না। তাঁদের দাবিও এমন এক ব্যবস্থার কাছে, যা মানুষকে সুশাসন ও ন্যায়বিচার না দিয়ে সমস্যা জিইয়ে রেখেছে, বাড়িয়েছে।

আশির দশকে এক রেডিও নাটকে শুনেছিলাম, নায়ক অধ্যাপকের ঘরের আয়না বিকৃত প্রতিচ্ছবি দেখানোয় তিনি তা থেকে মুক্তি পেতে চান এবং হাতুড়ি দিয়ে আয়না ভেঙে ফেলেন। আয়নাটি ছিল সমাজকে দেখার একটি রূপক অনুসঙ্গ।

বিকৃত ছবি দেখানো আয়না ভেঙে শহরে বের হতেই অধ্যাপক দেখেন, রাস্তায় মিছিল হচ্ছে এবং সে মিছিলে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, ‘আয়না ভাঙা, আয়না ভাঙা, চলবে না! চলবে না!’

কিছুটা বিচলিত হলেও সমাজের পরিবর্তন চাওয়া অধ্যাপকটি তখন উপলব্ধি করতে পারেন, প্রচলিত অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করাটা সমাজ চট করে গ্রহণ করবে না, কিন্তু কাউকে না কাউকে প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিজেদের পেনশন-ব্যবস্থায় ব্যত্যয় ঘটানোর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে দেখে বড়ই মায়া লাগছে।

সমাজের বৃহত্তর অন্যায় ঠেকাতে উপযুক্ত মানুষ গড়ার কারিগরদের কী দশা! এসব অধ্যাপককে ১৯৯০-এর আন্দোলনে পেয়েছিলাম আমাদের ঠিক সামনেই।

আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা কি একবার ভেবে দেখেছেন, তাঁদের ইস্যুটির সঙ্গে দেশের শিক্ষা, গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং জাতীয় স্বার্থের কোনো সম্পর্ক আছে কি না। তাঁদের দাবিও এমন এক ব্যবস্থার কাছে, যা মানুষকে সুশাসন ও ন্যায়বিচার না দিয়ে সমস্যা জিইয়ে রেখেছে, বাড়িয়েছে।

তরুণদের চিন্তা না করে উপায় নেই, এ দেশে কেন আজকের অবস্থা তৈরি হয়েছে। এও ভাবা দরকার, তাঁরা যা চান, তার খণ্ডিত সমাধান আদৌ সম্ভব কি না।

দায়িত্ব ও নেতৃত্ব নিয়ে তাঁরা কি আগামীর নায়ক হতে চান, নাকি শুধু নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ উদ্ধারে মিছিলে যেতে চান।

  • খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক