মতামত

বিরোধী দলের উপনেতা কি সরকারের করুণায় চলেন

১১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা জি এম কাদেরের কঠোর সমালোচনা করেছেন। জিএম কাদের কোথায় ভুল বলেছেন, সেটা তারা বলেননি। তাদের মাথা ব্যথার কারণ হলো সরকারের সব সুযোগ সুবিধা নিয়ে কেন তিনি সরকারের সমালোচনা করবেন। বিএনপির নেতারা সরকারের সমালোচনা করতে পারেন। কিন্তু জি এম কাদের কেন করবেন?

দিনাজপুর-৫ আসনের সরকারদলীয় এমপি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি অবাক হয়ে গেলাম। বিরোধীদলীয় উপনেতা বললেন, দেশ নাকি নীরবেই শ্রীলঙ্কা হয়ে গেছে। আমীর খসরু (বিএনপি নেতা) সে কথা বললে সহ্য হয়। এ কথা ফখরুল (মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর) বললে সহ্য হয়। জি এম কাদের সাহেব বললেন, দেশ নাকি নীরবেই শ্রীলঙ্কা হয়ে গেছে।’

বাংলাদেশ নীরবে শ্রীলঙ্কা হয়ে গেছে, জি এম কাদেরের এমন বক্তব্যের সমালোচনা করেন চাঁদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মুহম্মদ শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা জানতাম বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ‘বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে গেছে’, ‘বাংলাদেশ ফ্যাসিস্ট হয়ে গেছে’; এ রকম অনেক কিছুই বলেন তিনি। সেটা আমরা বুঝি। কিন্তু জি এম কাদের সাহেব যা বললেন, সেটি আমরা বুঝি না। কারণ হচ্ছে, তার দল শেখ হাসিনার কাছ থেকে সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এ ধরনের অসত্য ভাষণ দেবেন, সেটা তো আমরা বুঝি না।’

অবশ্য এই দুই সংসদ সদস্য বলেননি যে, সরকারের কাছ থেকে জি এম কাদের কী কী সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন। এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের উপনেতার কোনো গোপন চুক্তি থেকে থাকলে তাদের উচিত সেটি জনসমক্ষে প্রকাশ করা। আর যদি তাঁরা সংসদের উপনেতা হিসেবে নেওয়া বেতন–ভাতার কথা বলে থাকেন, সেখানে করুণার প্রশ্ন আসে কেন? আইন অনুযায়ী সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা যেমন সম্মানি–ভাতা পাচ্ছেন, বিরোধী দলের সদস্যরাও পাচ্ছেন।

বর্তমান সংসদেই ‘বিরোধীদলীয় নেতা ও  উপনেতা (পারিতোষিক ও বিশেষাধিকার) বিল-২০২১’ পাস হয়। এতে বলা হয়েছে, ‘বিরোধীদলীয় নেতা সরকারের একজন মন্ত্রীর জন্য ধার্য বেতন, ভাতা, অন্যান্য বিশেষাধিকার পাবেন। আর বিরোধীদলীয় উপনেতা একজন প্রতিমন্ত্রীর সমান বেতন, ভাতা ও অন্যান্য বিশেষাধিকার পাবেন।’ সংসদে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। এই আইনের আগপর্যন্ত জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালে জারি করা অধ্যাদেশ বলে বিরোধী দলের নেতা-উপনেতা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পেতেন।

বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সদস্যসংখ্যা এত কম ছিল যে বিরোধী দলের নেতা বা উপনেতা হিসেবে কেউ স্বীকৃতি পাননি। দ্বিতীয় সংসদ বিরোধী দলের নেতা ও উপনেতা ছিলেন যথাক্রমে আওয়ামী লীগের আছাদুজ্জামান খান ও মহিউদ্দিন আহমদ। তৃতীয় জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন শেখ হাসিনা ও উপনেতা আবদুল মালেক উকিল। বিএনপি এই নির্বাচন  বর্জন করেছিল। চতুর্থ জাতীয় সংসদে  বিরোধী দলের নেতা ছিলেন জাসদের আ স ম আবদুর রব। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল এই নির্বাচন বর্জন করে।

নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর গঠিত পঞ্চম সংসদে বিরোধী দলের নেতা ও উপনেতা ছিলেন যথাক্রমে শেখ হাসিনা ও আবদুস সামাদ আজাদ। সপ্তম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন খালেদা জিয়া, উপনেতা বদরুদ্দোজা চৌধুরী। অষ্টম জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনা ও মো. আবদুল হামিদ। নবম জাতীয় সংসদে খালেদা জিয়া বিরোধী দলের নেতা থাকলেও কাউকে উপনেতা নির্বাচিত করা হয়নি। দশম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন রওশন এরশাদ। বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এরশাদ একাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। এরপর বিরোধী দলের নেতা ও উপনেতা হন যথাক্রমে রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের।

বাংলাদেশের সংবিধানে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বা উপনেতার বিষয়ে কিছু বলা ছিল না। এ–সংক্রান্ত কোনো আইনও প্রণয়ন করা হয়নি। পরে ১৯৭৯ সালে ‘বিরোধীদলীয় নেতা বা উপনেতার (পারিতোষিক ও বিশেষাধিকার) অধ্যাদেশ’ জারি করে তাদের পারিতোষিক ও মর্যাদা দেওয়া হয়।

আইনে সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের ভূমিকার কথা স্পস্ট করা আছে। বিরোধী দলের কাজ হলো সরকারের নীতি–পরিকল্পনার সমালোচনা করা, ত্রুটি–দুর্বলতা ধরিয়ে দেওয়া। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে বিরোধী দল ছায়া সরকারও গঠন করে; যারা সংশ্লিষ্ট বিষয় সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি বিকল্প কর্মপরিকল্পনা হাজির করে। সরকারের জবাবদিহি আদায় করার এটি উত্তম কৌশলও বটে। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরাও চান বিরোধী দল শুধু ‘হ্যাঁ’ বলে যাবে, কোনো সমালোচনা করবে না।

আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় সংসদে আইন করেছে, সংসদে সরকারের বিরোধিতাকারী দল বিরোধী দলের স্বীকৃতি পাবে, কিন্তু বিরোধী দলের কেউ সরকারের সমালোচনা করলেই সরকারের করুণা ও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সুযোগ–সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়। সরকারি ও বিরোধী দল মিলে জাতীয় সংসদ বা আইনসভা। সেখানে সরকার বা নির্বাহী বিভাগের করুণার কোনো প্রশ্ন আসে না। সংসদ সদস্য হিসেবে সরকারি দলের সদস্যরা যে সুবিধা পাওয়ার দাবিদার, বিরোধী দলের সদস্যরাও তা পেতে পারেন।

ধারণা করি, দুই সংসদ সদস্যের উষ্মা প্রকাশের কারণ অনুগত বিরোধী দল থেকে জাতীয় পার্টির স্বতন্ত্র অবস্থান নেওয়া। অন্তত দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের সেটি করছেন। এ জন্য একবার তাঁর চেয়ারম্যান পদের ওপর আদালতের স্থগিতাদেশও এসেছিল।

জিএম কাদের মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর হাতে এখন যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা আছে, তাতে সংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দ্বাদশ সংশোধনী পাসের সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মিলেই কাজটি করেছে।

দুই সংসদ সদস্যের কঠোর উষ্মা সত্ত্বেও  জি এম কাদের তাঁর অবস্থান থেকে  সরে গেছেন বলে মনে হয় না। ১২ জুন টাঙ্গাইল জেলা জাতীয় পার্টির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কার মানুষ রাস্তায় নেমেছিল, সে দেশের সরকার যেভাবে ট্যাকেল দিয়েছে, তাতে প্রমাণিত হয়েছে, পুলিশ যে তাদের বন্ধু, সেটাই তারা দেখিয়েছে। সেখানে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেমেছিল। আমাদের দেশের মানুষ এখনো নামেনি, এটাই পার্থক্য।’ সেই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবে সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের এটা ভালো লাগেনি।

সরকারি দলের দুই সংসদ সদস্যের যুক্তি মেনে নিলে স্বীকার করে নিতে হয়, বাংলাদেশে দ্বিতীয় সংসদ থেকে এ পর্যন্ত সব সংসদের বিরোধী দলের নেতা–উপনেতা সরকারের অনুগ্রহ নিয়েছেন। দয়া করে সেই অনুগ্রহের পরিমাণটা জানালে কৃতার্থ হব।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি। ইমেইল:  sohrabhassan55@gmail.com