গত কয়েক দিনে বাংলাদেশে যা ঘটল, জানি না তাকে এককথায় কী বলা যাবে। তবে ২০২৪ সালের মধ্য জুলাইয়ে যা ঘটে গেল তা অভূতপূর্ব, নজিরবিহীন। কারফিউ দিয়ে সেনাসদস্যদের নামিয়ে, ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে সরকারকে। রাস্তায় রাস্তায় ধ্বংসচিহ্ন এখন দৃশ্যমান। বাজেট বরাদ্দ দিয়ে সেই সব ধ্বংসচিহ্নকে হয়তো মুছে ফেলা যাবে। একদিন সেটা মুছেও যাবে।
কিন্তু যে মায়েদের বুক খালি হলো, যে শিশুরা বাবা হারাল, যে বোনেরা তাঁদের ভাইদের হারালেন, যে কিশোর-তরুণদের সামনে থেকে তাঁদের বন্ধুরা মারা গেলেন, সেসব স্বজনহারা, বন্ধুহারা মানুষের ক্ষতচিহ্ন কেউ কখনো কি নিরাময় করতে পারবে?
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ-সহিংসতায় প্রথম আলোর সর্বশেষ হিসাবে ২০৯ জন মারা গেছেন (যদিও এ তথ্য পূর্ণাঙ্গ নয়)। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। এদের মধ্যে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অন্ধ হওয়া মানুষ যেমন আছেন আবার অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গু হওয়া মানুষও আছেন। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, ১৯৪৭ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত কোনো আন্দোলনেই মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে এত প্রাণহানি আর হয়নি।
কোটা সংস্কারের মতো নিরীহ একটা দাবির আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দেশজুড়ে কেন এমন অভাবনীয় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল, সেটা নিশ্চিতভাবেই সমাজবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় হবে। তবে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও পুঞ্জীভূত ক্ষোভ—দুইয়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এ আন্দোলনে।
যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের একটা বড় অংশ শিক্ষার্থী ও তরুণ; রয়েছে শিশু-কিশোরেরাও। তাঁরা যে সবাই মিছিলে গিয়ে, বিক্ষোভ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন, তা নয়। কেউ পড়ার টেবিলের পাশের জানালায় দাঁড়িয়ে, কেউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে, কেউবা আবার ক্রেতার বাসায় দুধ পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন।
জীবন যাদের এখনো শুরুই হয়নি, তারাও আজ নির্মমতার শিকার হয়ে আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেল। ঢাকার মিরপুরের ১১ বছরের শিশু সাফকাত সামিরের কথাই ধরা যাক। ১৯ জুলাই দুপুরে মিরপুরে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘাত চলছিল। বিক্ষোভকারীদের ঠেকাতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। সেই ধোঁয়া ঘরের মধ্যে ঢুকলে জানালা বন্ধ করতে যায় সামির। গুলি এসে তার চোখ ফুঁড়ে মাথায় বিদ্ধ হয়। সামির তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান।
তৃতীয়ত ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হলো, ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে একটা নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, যারা ধ্যানধারণা ও যোগাযোগে সর্বজনীন এবং প্রবলভাবে আত্মমর্যাদাবান ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী। ২০০০ সালের পরে জন্ম নেওয়া এই জেনজিদের মধ্যে এই সংহতি গড়ে দিয়েছে ইন্টারনেট। নিশ্চিতভাবেই আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র, সরকারের যাঁরা নীতিনির্ধারক, তাঁদের সঙ্গে এই প্রজন্মের শুধু বয়স নয়, আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নে ফারাক বিস্তর। ফলে বলপ্রয়োগ, উপহাস, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তাদের দমিয়ে দেওয়া যাবে না। ২০১৮ সালের আগস্টের পর ২০২৪ সালের জুলাই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাল, অনেক বেশি জোরালোভাবে।
নারায়ণগঞ্জের সাড়ে ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ। দুপুরে খাওয়ার পর খেলতে গিয়েছিল ছাদে। বাড়ির সামনে সংঘর্ষ বাধলে বাবা দীপক গোপ দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে ছাদ থেকে আনতে যায়। ভয় পাওয়া শিশুটিকে কোলে তুলে নিতেই বুলেট এসে বেঁধে তার মাথায়। তিন দিন হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে মৃত্যুর কাছে হেরে যায় শিশুটি। মা-বাবার কোল তো শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। সেখানেই জীবন শুরু না করা একটা শিশু কেন গুলি খেয়ে মারা যাবে। রিয়াও তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। প্রথম আলোয় রিয়ার গত জন্মদিনের একটা ছবি ছাপা হয়েছে। কেকের সামনে না জ্বলা কিংবা নেভানো একটা মোমবাতি। এর চেয়ে নির্মম প্রতীক আর কি হতে পারে!
কিশোর মোবারক ঢাকার পান্থপথের বক্স কালভার্ট এলাকায় গরুর খামার বস্তিতে মা-বাবার সঙ্গে থাকত। চারটা গাভি ছিল তাদের। সেই গাভির দুধ বিক্রি করেই সংসার চলত। ক্রেতাদের বাসায় দুধ পৌঁছে দিতে গত রোববার (২১ জুলাই) দুপুরের পর বের হয়েছিল মোবারক। গ্রিনরোডের ওইখানটায় সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মাথায় গুলি লাগে তার। মাত্র তেরোতেই থেমে গেল তার জীবন।
দশম শ্রেণির নাইমা সুলতানা। ঢাকার মাইলস্টোন কলেজে পড়ত। উত্তরার ৫ নম্বর সড়কের ভাড়া বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ গুলি এসে বিদ্ধ হয় নাইমার মাথায়। নাইমার মা আইনুন্নাহারের প্রশ্ন, ‘আমার বুকের ধনটারে কে এমনে মারল? কী কারণে মারল? আমি অনে কী নিয়া বাঁচুম?’ ঘর মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। সেখানেই কেন প্রাণ হারাতে হলো মাত্র ১৫ বছরের কিশোরীকে?
ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ফারহান ফাইয়াজ, যে তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছিল, ‘এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ মনে রাখে।’ ২০০৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর আলোয় চোখ রাখা ফারহানের বয়স আঠারোও হয়নি। মুখ ও বুকে রাবার বুলেটের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে হারিয়ে গেছে ফরহান।
যত দিন গড়াচ্ছে পত্রিকার পাতায় একের পর এক বিয়োগান্ত ঘটনা সামনে আসছে।। সেই সব ঘটনা পড়ছি আর শোকে, বিহ্বলতায়, হতাশায়, ভয়ে আমরা মুষড়ে পড়ছি, আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে। জুলাই আন্দোলনে সারা দেশে যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে তাতে কতজন শিশু ও ছাত্র নিহত হয়েছে তার পৃথক কোনো পরিসংখ্যান এখনো জানা যাচ্ছে না।
তবে শুধুমাত্র ১৯ জুলাই প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকায়, দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও সহিংসতায় ২৭ জনের মৃত্যুর যে খবর দিয়েছে, সেখানে ১১ জনই ছাত্র। এর মধ্যে নরসিংদীতে যে দুজন শিক্ষার্থী পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন, তাঁদের মধ্যে তাহমিদ তামিমের বয়স মাত্র ১৫ বছর, ইমন মিয়ার বয়স ২২ বছর। একই দিন মাদারীপুরে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ধাওয়ায় পুকুরে ডুবে নিহত শিক্ষার্থী দীপ্ত দের বয়স ২১ বছর।
জুলাই-আন্দোলন এ রকম অসংখ্য মৃত্যু অসংখ্য পরিবারের জন্য অন্তহীন ট্র্যাজেডি হয়ে থাকবে। এভাবে শিশু ও ছাত্রের নিহত হওয়ার ঘটনা যে যে ব্যক্তি-পরিবার ছাপিয়ে সামাজিক ট্র্যাজেডিও হয়ে ওঠে এবং সেটা যে সামষ্টিক বিক্ষোভে রূপান্তরিত হয়, এবারের আন্দোলন তার ধ্রুপদি উদাহরণ।
জানি না, বিশ্বের আর কোথাও কিশোরদের ও ছাত্রদের বিক্ষোভ প্রশমনে এমন বাড়াবাড়ি রকম বলপ্রয়োগ ও নির্বিচারে গুলি করা হয় কি না, এমন করে পেটোয়া বাহিনীকে মাঠে নামিয়ে শত শত শিক্ষার্থীকে রক্তাক্ত করা হয় কি না। কেননা, সোম, মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবারের (১৫ জুলাই থেকে ১৮ জুলাই) আন্দোলন ছিল কার্যত শিক্ষার্থীদের আন্দোলন।
প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে সোজা করার জন্য সারা ঢাকা থেকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের পেটোয়া বাহিনী আনা হয়। তারা লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক, দা, পিস্তল নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নারী শিক্ষার্থীদের বেপরোয়াভাবে পিটিয়ে আহত করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর ব্যাপক, বেপরোয়া হামলার খবর, ছবি ও ভিডিও অনলাইনের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য ঘিরে সৃষ্ট হওয়া বিতর্কের পর এই হামলা এবারের আন্দোলনের দ্বিতীয় টার্নিং পয়েন্ট। এর ফলে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সংহতি তৈরি হয়। ফলে মাসখানেক আগে জন্ম নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে ঢাকার অভিজাত এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সারা দেশের গ্রাম-মফস্বলের স্কুলের শিক্ষার্থীরাও রাস্তায় নেমে আসে, প্রতিবাদে শামিল হয়।
এর পেছনে অন্তত তিনটি কারণ চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর ছাত্রলীগ-যুবলীগ যে বেপরোয়া হামলা করেছে, সেই অন্যায়ের প্রতিবাদে তাঁরা রাস্তায় নামেন।
দ্বিতীয়ত, এখন যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সেই প্রজন্ম ২০১৮ সালে ইতিহাসের নজিরবিহীন নিরাপদ সড়ক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সে সময় স্কুলপড়ুয়া ছাত্রদের সেই নিরীহ ও ন্যায়সংগত দাবিকেও হেলমেট বাহিনী ও পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে দমন করা হয়েছিল। সেই ক্ষত তাদের বুক থেকে নিশ্চয়ই শুকিয়ে যায়নি।
তৃতীয়ত ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হলো, ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে একটা নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, যারা ধ্যানধারণা ও যোগাযোগে সর্বজনীন এবং প্রবলভাবে আত্মমর্যাদাবান ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী। ২০০০ সালের পরে জন্ম নেওয়া এই জেনজিদের মধ্যে এই সংহতি গড়ে দিয়েছে ইন্টারনেট। নিশ্চিতভাবেই আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র, সরকারের যাঁরা নীতিনির্ধারক, তাঁদের সঙ্গে এই প্রজন্মের শুধু বয়স নয়, আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নে ফারাক বিস্তর। ফলে বলপ্রয়োগ, উপহাস, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তাদের দমিয়ে দেওয়া যাবে না। ২০১৮ সালের আগস্টের পর ২০২৪ সালের জুলাই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাল, অনেক বেশি জোরালোভাবে।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাত্র আবু সাঈদের বুকে খুব কাছ থেকে রাবার বুলেট বিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি এ আন্দোলনের তৃতীয় এবং সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট। রাস্তার মাঝে একা দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদের বুকে রাবার বুলেট লাগার ছবিটা নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের শক্তিশালী প্রতীক হয়ে থাকবে।
রংপুরের একেবারে গরিব পরিবারের ছেলে আবু সাঈদের মৃত্যু সারা দেশের মানুষের মধ্যে গড়ে দেয় অভূতপূর্ব এক সংহতি। খেটে খাওয়া সাধারণ লুঙ্গিপরা লোকেরা নেমে আসেন রাস্তায়। মাসের পর মাস ধরে চলতে থাকা উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সীমাহীন দুর্নীতি ও বৈষম্য, জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে যাওয়া, ভোট দিতে না পারা, তরুণদের বেকারত্ব, বস্তি থেকে উচ্ছেদ, হকারি করতে গিয়ে চাঁদাবাজির শিকার হওয়া খেটে খাওয়া মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে মিলে যায়। ২০২০ সালের করোনা মহামারি থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত দেশের গরিব, নিম্ন আয় ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষেরা কী দুর্বিষহ ও লাঞ্ছনার জীবন যাপন করছেন, তা কি কারও অজানা।
পরিস্থিতি থিতু হয়ে আসতে শুরু করায় সরকারের তরফ থেকে মূলত ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ সামনে আনা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, নাশকতা, সহিংসতা করার জন্য কোনো গোষ্ঠী যখন পরিকল্পনা করেছে, প্রস্তুতি নিয়েছে, তখন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কী করেছে? ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর ‘রহস্যের উদ্ঘাটন’ শেষবিচারে কোনো অর্থ বহন করে কি? এলাকা ঘিরে ব্লক রেইড আর গণগ্রেপ্তারই তখন সরকারের কাছে একমাত্র সমাধান হয়ে দাঁড়ায়।
মনোজ দে, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী