ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ কি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে বিপদের মধ্যে ফেলবে? প্রভাবশালী বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ট্রাম্প এতই ‘দুর্বল’, জনপ্রিয় হওয়ার জন্য এতটাই মরিয়া ও এতটাই ‘আনস্মার্ট’ যে তাঁর পক্ষে একনায়ক হওয়া সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এমন উদাহরণ খুব একটা নেই।
তবে অন্য দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতা একবার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরলে আরও কঠোর ও দক্ষ হয়ে ওঠে। আর যেন তাদের ক্ষমতা হারাতে না হয়, এ জন্য তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও নিয়মকানুন ধ্বংস করতে শুরু করে।
এর প্রথম উদাহরণ হলেন ভিক্তর ওরবান। তাঁর ফিডেজ পার্টি দুবার হাঙ্গেরি শাসন করেছে। প্রথমবার ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত। ওই সময় ওরবান অর্থনৈতিক রক্ষণশীল নেতা হিসেবে কাজ করেছেন। সে সময় যদিও তিনি গণতান্ত্রিক মানদণ্ডে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন। তবে তিনি ইউরোপীয় মূলধারার বাইরে যাননি।
২০০২ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর ফিডেজ আট বছর বিরোধী দলে কাটিয়েছিল।
২০১০ সালে ফিডেজ পার্টি জেতার সুবাদে ওরবান ক্ষমতায় ফিরে আসেন। তখন তিনি ফিরেছিলেন আর কখনো পরাজিত না হওয়ার সংকল্প নিয়ে। আর তা নিশ্চিত করতে তিনি নির্বাচনী এলাকার মানচিত্র বদলে ফেলেন, ভোটারের যোগ্যতা–সংক্রান্ত নিয়মকানুনে পরিবর্তন আনেন এবং নির্বাচন কমিশন, আদালত ও রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম দখল করে ফেলেন। এর ফলে বিরোধীদের পক্ষে জয়ী হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।
ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কথাই ধরুন। ১৯৮৯ সালে তারা প্রথমবারের মতো বড় একটা জোটের ছোট অংশ হিসেবে ক্ষমতার স্বাদ পায়। ১৯৯৯ ও ২০০৪ সালে তারা ক্ষমতায় আসে প্রথমবারের মতো এককভাবে। সেই সময়ে বিজেপি নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ী অর্থনৈতিক উদারীকরণ এবং পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিয়েছিলেন। সে সময় ‘গেরুয়াকরণ’-এর প্রচেষ্টা ছিল সীমিত।
মাঝখানে একবার ক্ষমতা হারিয়ে পরে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি বিপুল বিজয় লাভ করে। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় তিনি গুজরাটে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সফলভাবে কাজ করেছিলেন। আর ঘটিয়েছিলেন মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা, যাতে নিহত হয়েছিল দুই হাজার মানুষ।
মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়ে অর্থনৈতিক উদারতার গতি বাড়িয়ে দেন। সেই সঙ্গে প্রচারমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ, বিজেপিবিরোধীদের দমন আর মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দু সামাজিক আন্দোলনকারীদের সহিংসতা নিয়ে তাঁর নির্বিকার থাকা সবারই চোখে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা এখন মোদির ভারতকে পূর্ণ গণতন্ত্রের বদলে নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেন।
ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা আছে। তবে তিনি এখন যথেষ্ট প্রতিভা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আগেরবারের শাসন, এবারের আন্দোলন আর ভারত ও হাঙ্গেরির মতো দেশের ডানপন্থী আন্দোলন থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতা মিলিয়ে আরেকটি ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতা ধরে রাখতে অনেক বেশি দক্ষতার পরিচয় দেবে, সন্দেহ নেই।
এ দুই উদাহরণে কিছু মিল পাওয়া যায়। দুই ক্ষেত্রেই পাওয়া যাচ্ছে একজন ক্যারিশমাটিক নেতা। এই নেতা স্বীকারই করেন না যে বিরোধী দলের হাতে ক্ষমতা দেওয়া যায়। পরাজয়ের ভয় থেকেই গণতন্ত্রবিরোধী প্রবণতার জন্ম হয়। যখন একটি স্বৈরাচারপ্রবণতাসম্পন্ন দল দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে, তখন সে জানে কীভাবে সরাসরি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতে হয়।
এ দুই উদাহরণের সঙ্গে ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (মাগা) আন্দোলনের মিল স্পষ্ট চোখে পড়ে। রূপান্তরিত বিজেপি আর ফিডেজের মতো আজকের রিপাবলিকান পার্টি নিজের নিকট অতীতের বিপরীত দিকে রওনা দিয়েছে। বর্তমান রিপাবলিকান পার্টি সম্পূর্ণ ব্যক্তির ক্যারিশমানির্ভর।
ফিডেজ আর বিজেপির মতোই ২০১৬ সালে মাগা আন্দোলন ছিল অনেকটা আনাড়ি। রাষ্ট্রের হাতিয়ারগুলোকে সে ঠিকমতো কাজে লাগাতে জানত না তখন। ট্রাম্প আরেকবার ক্ষমতায় এলে গতবারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে। এবার আর ভুল হবে না। সেই সঙ্গে তাঁর মিত্র প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে তাদের কর্তব্যকর্ম কী হবে, তা ঝালিয়ে নিয়েছে। নির্বাচনে পরাজয়ের কারণে রিপাবলিকান জেদ মোটেই কমেনি। ফিডেজ ও বিজেপির ক্ষেত্রেও তা–ই দেখা গেছে।
ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা আছে। তবে তিনি এখন যথেষ্ট প্রতিভা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আগেরবারের শাসন, এবারের আন্দোলন আর ভারত ও হাঙ্গেরির মতো দেশের ডানপন্থী আন্দোলন থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতা মিলিয়ে আরেকটি ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতা ধরে রাখতে অনেক বেশি দক্ষতার পরিচয় দেবে, সন্দেহ নেই।
● টম গিন্সবার্গ ও আজিজ হক শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত