ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) খ. মহিদ উদ্দিন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, নিজেদের সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র ও শরীরের নিরাপত্তা নিজেকেই নিতে হবে। এই বক্তব্যের সূত্রে তাঁকে দুটি প্রশ্ন করা যায়—এক. যদি জানমালের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিতে হয়, তাহলে পুলিশের কাজটা কী? দুই. জিনিসপত্র ও শরীরের নিরাপত্তার জন্য সাধারণ মানুষকে কি তবে অস্ত্রপাতি নিয়ে বের হতে হবে?
প্রথম আলো অনলাইনে সংবাদ সম্মেলনের এই খবর গত সোমবার সর্বাধিক আলোচিত ছিল। ওই প্রতিবেদনে একজন পাঠক মন্তব্য করেন, ‘ব্যক্তিগত ও শারীরিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে বিষয়টির ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আমি আশুগঞ্জ রেলস্টেশনে ২০০৭ সালে চারজন ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলাম। মানিব্যাগ, মোবাইল সব ছিনতাই হয়ে যায় চারটি লম্বা চাকুর হুমকির মুখে। এখন বলুন, কীভাবে আমি আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করব? কারণ, অভিযোগ আছে যে ছিনতাই করার জন্য থানায় মাসোহারা দেওয়া হয়। মুষ্টিমেয় কিছু অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীর কাছে বিশাল জনগোষ্ঠী জিম্মি হয়ে আছে। নিজের নিরাপত্তার জন্য কি জনগণকে সশস্ত্র হতে হবে?’
আরেকজন লিখেছেন, ‘নিজের জানমালের নিরাপত্তা যদি নিজেরই করতে হয়, তাহলে জনগণের করের টাকায় উচ্চ বেতন দিয়ে আপনাদের পালন করা লাগবে কেন...’
পুলিশ সদস্য মনিরুজ্জামান ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগে ট্রাফিক কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শেরপুরে ঈদের ছুটি শেষে কর্মস্থলে যোগ দিতে যাওয়ার পথে নিহত হন। এ ঘটনায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ সন্দেহভাজন ছিনতাইকারীকে ধরে ফেলে। পরদিন গ্রেপ্তার হন আরও দুজন। এই ‘অর্জনের’ খবর জানাতে খ. মহিদ উদ্দিন সোমবার সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। সেখানেই এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা জিনিস বুঝতে হবে, পার্সোনাল বিলঙ্গিংস বা ব্যক্তিগত ছোটখাটো জিনিসপত্র ও নিজের শরীরের নিরাপত্তা প্রত্যেককে তাঁর নিতে হবে। রাষ্ট্রের অবশ্যই নিরাপত্তার দায়িত্ব আছে।’
বাংলাদেশে পুলিশ পরিচালিত হয় দ্য পুলিশ অ্যাক্ট ১৮৬১ অনুসারে। আইনে পরিষ্কার বলা আছে, পুলিশের কাজ হলো জনশান্তিকে প্রভাবিত করে—এমন গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও যোগাযোগ করা, অপরাধীদের শনাক্ত করা ও বিচারের আওতায় আনা এবং যারা শঙ্কা তৈরি করে, তাদের গ্রেপ্তার করা। বাংলাদেশ পুলিশ ‘জনবান্ধব’। তাই তারা থানায় থানায় সিটিজেন চার্টারও সেঁটে রেখেছে। এই সিটিজেন চার্টারে একজন নাগরিক পুলিশের কাছ থেকে কী কী সেবা পাবেন, তার ফিরিস্তি দেওয়া থাকে। এর ১ নম্বরে লেখা আছে, বাংলাদেশ পুলিশ জনগণের সেবা প্রদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক শ্রেণিনির্বিশেষে দেশের প্রতিটি থানায় সব নাগরিকের সমান আইনি অধিকার লাভের সুযোগ আছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, ডিএমপির একটি তথ্যভান্ডারে কোন থানায় কতজন ছিনতাই করে, আলাদাভাবে তাদের প্রত্যেকের জীবনবৃত্তান্ত সংরক্ষণ করা আছে। সে হিসাবে ঢাকায় ১ হাজার ৭৩৭ জন ছিনতাইকারী আছে এবং এই মুহূর্তে ঢাকার সবচেয়ে ছিনতাইপ্রবণ এলাকা হলো তেজগাঁও। সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম (এসআইভিএস) নামের একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে এই তথ্যভান্ডার তৈরি করা হয়েছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি ছাপার এক মাস না হতেই কনস্টেবল মনিরুজ্জামান তেজগাঁও থানা এলাকায় নিহত হন। সব তথ্য হাতে থাকার পরও কেন তেজগাঁওয়ে মনিরুজ্জামানকে খুন হতে হলো, সেই প্রশ্নের জবাব কি পুলিশ কর্মকর্তারা দেবেন? এই বাহারি সফটওয়্যার তবে কী কাজে লাগল?
‘নিজের জানমালের নিরাপত্তা যদি নিজেরই করতে হয়, তাহলে জনগণের করের টাকায় উচ্চ বেতন দিয়ে আপনাদের পালন করা লাগবে কেন...’
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের সদস্যও বেড়েছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর সদস্যসংখ্যা দুই লাখের ওপর। ফি বছর বাজেটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য ব্যয় বাড়ছে। এ বছর বাজেটে বাহিনীগুলোর জন্য বরাদ্দ ২৫ হাজার ৬৯৬ কোটি ৭৫ লাখ ১৫ হাজার টাকা। গত অর্থবছরে ছিল ২২ হাজার ৫৭৭ কোটি ৫৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এর আগে বলা হয়েছিল, পুলিশের জন্য বাজেট ব্যয় নয়, বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হয়। যদি নিজেদের জন্য থাকা জিনিসপত্র ও শরীরের নিরাপত্তা নিজেকে নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে এই ‘বিনিয়োগ’–এর সুফলভোগী কারা?
পুলিশ অবশ্য যুক্তি দেখায়, জনসংখ্যা অনুপাতে পুলিশের সংখ্যা কম। কিন্তু দেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে চোর-ছেঁচড় বা ছিনতাইকারী তো হাতে গোনা কয়েকজন। এই সংখ্যা পুলিশ বাহিনীর মোট সদস্য ও জনসংখ্যা অনুপাতে খুবই নগণ্য। এই কয়জনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা ও বিচারের আওতায় আনতেও পুলিশ অক্ষম? যে কারণে জনগণকেই নিজেদের দায়িত্ব নেওয়ার পরামর্শ আসে ডিএমপির একজন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে!
আধুনিক অর্থশাস্ত্রের জনক অ্যাডাম স্মিথ ওয়েলথ অব নেশনস-এ লিখেছিলেন, দরিদ্রদের ক্ষোভ থেকে ধনীদের সুরক্ষায় বিচারব্যবস্থার উদ্ভব। আদিম সমাজে যারা বিচার চাইত, তারা বিচারকাজে জড়িত ব্যক্তিদের নানা উপঢৌকন দিত। পরে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রই সেই দায়িত্ব নেয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের মানি এসকর্ট সার্ভিস আছে। ব্যাংক থেকে বেশি টাকা তোলার আগে থানায় ফোন করলেই বিনা মূল্যে এই সেবা পাওয়া যায়। পুলিশ যেচে এই সেবা দিতে চায়, কিন্তু ধনীদের অনেকেই ঝামেলা এড়াতে এই সেবা নেন না বলে পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।
ছিনতাইকারীর কবলে যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের যদি কোনো তথ্যভান্ডার পুলিশ তৈরি করত, তাহলে তাতে নিশ্চিতভাবেই নাম থাকত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের। বছর তিনেক আগে শরীয়তপুর থেকে অসুস্থ শিশুসন্তানকে নিয়ে শাহ আলম-আকলিমা বেগম দম্পতি ঢাকায় এসেছিলেন। ছিনতাইকারীরা ব্যাগ ধরে টান দিলে তাঁদের সাত মাসের শিশুটি রাস্তায় পড়ে মারা যায়। ধানমন্ডিতে প্রাইভেট কারে বসে রিকশার আরোহী হেলেনা বেগমের ব্যাগ কেড়ে নিয়েছিল ছিনতাইকারীরা। তিনি রিকশা থেকে পড়ে গাড়িচাপায় নিহত হন। ২০১৪ সালে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে চিকিৎসক সানজানা জেরিন আট বছর ধরে অচেতন।
তাহলে কাদের উদ্দেশে পুলিশের এই বাণী? কোলশূন্য মা, মা-হারা সন্তান, নাকি কোনোরকমে বেঁচে থাকা সেই চিকিৎসকের উদ্দেশে?
● শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
ইমেইল: sabiha.alam@prothomalo.com