রাশিয়া থেকে তেল আমদানি, আলোচনায় যখন সোয়াপ

তেলের ইউরোপীয় বাজার হারানোর পর রাশিয়ার মরিয়া ভাবই সাশ্রয়ী দামে তেল কেনার জন্য ভারতকে প্রলুব্ধ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়
ছবি : রয়টার্স

দেশে বিদ্যমান ডলার-সংকট মোকাবিলার জন্য রাশিয়া থেকে তেল আমদানির পন্থা বের করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। এদিকে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দেশটি থেকে তেল কেনার পক্ষে নিজেদের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ তেল আমদানিকারক ভারত। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, নিজ দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে যেটি শ্রেয়তর, সেটিই করবে তাঁর সরকার। অর্থাৎ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে পরোয়া করছে না তারা।

রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার পর পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর ওপর ইউরোপের নির্ভরশীলতা বহুগুণ বেড়ে গেছে বলে ভারতকে শরণাপন্ন হতে হচ্ছে রাশিয়ার তেলের ওপর। তেলের ইউরোপীয় বাজার হারানোর পর রাশিয়ার মরিয়া ভাবই সাশ্রয়ী দামে তেল কেনার জন্য ভারতকে প্রলুব্ধ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়।

নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া রাশিয়া থেকে বাংলাদেশের তেল আমদানি করা প্রায়োগিকভাবে অসম্ভব নয়, তবে মূল্য পরিশোধে ডলারকে পাশ কাটিয়ে রুবল ব্যবহারের বিষয়টা জটিল। সোয়াপ পদ্ধতিতে এ লেনদেন সম্ভব। উল্লেখ্য, সোয়াপের শব্দগত অর্থ বিনিময় কিংবা একটির পরিবর্তে অন্যটি বদলাবদলি করা। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং ব্যাংকিংয়ে এ পদ্ধতি প্রধানত ব্যবহৃত হয় সুদের হার ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ঝুঁকি এড়ানোর কৌশল হিসেবে।

তবে বৈদেশিক মুদ্রা সোয়াপ যে কেবল বিনিময় হারের ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যবহার করা হয় তা নয়, ভিনদেশে পুঁজির উৎস সাশ্রয়ী হলে কিংবা দেশের তহবিলে অপর্যাপ্ত বিদেশি মুদ্রার ঘাটতি মেটানোর জন্য অন্য দেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হলেও (যেমন ঘটেছে বাংলাদেশ থেকে শ্রীলঙ্কার ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে) সোয়াপ পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যদি রাশিয়া থেকে সরাসরি টাকা রুবলে বিনিময় করে তেল আমদানি করতে চায়, তার একটা উদাহরণ এ রকম হতে পারে। সোয়াপ চুক্তির অধীন রাশিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি বাংলাদেশি ব্যাংক (ধরা যাক সোনালী ব্যাংক) কোনো রুশ ব্যাংকে একটা রুবল অ্যাকাউন্ট খুলবে। রাশিয়ার সেই ব্যাংকও সোনালী ব্যাংকে একটা টাকা অ্যাকাউন্ট খুলবে। এবার সোনালী ব্যাংক বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) ১০০ কোটি টাকা নিয়ে রুশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে (কিংবা জামানত হিসেবে অন্যত্র) জমা রাখবে। সেই টাকার বিপরীতে সোনালী ব্যাংক রাশিয়ার ব্যাংকটিকে ৬২ কোটি ৫০ লাখ রুবল (১ রুবল সমান ১.৬ টাকা ধরে) কিনে তাদের রুবল অ্যাকাউন্টে জমা করতে বলবে। তারপর বিপিসি রাশিয়ার তেল কোম্পানির অনুকূলে এলসি খুলে তেল আমদানি করতে পারে, যার মূল্য পরিশোধিত হবে মস্কোর ব্যাংকে বাংলাদেশি ব্যাংকটির রুবল অ্যাকাউন্ট থেকে। দুই দেশের মধ্যকার এ লেনদেন সংঘটিত হবে উভয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে সোয়াপ চুক্তির ভিত্তিতে। বাংলাদেশি ব্যাংক ও রাশিয়ান ব্যাংক উভয়ের অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া টাকা ও রুবলের ওপর চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট হারে সুদ পাবে।

এখানে আরেকটি বিকল্প উদ্ভাবন করা যায়। ভারত যেহেতু মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে, ভারতে পরিশোধিত সেই তেল রুপিতে আমদানি করতে পারি আমরা। বিডলারীকরণের অধীন ভারত ইতিমধ্যে সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করার আহ্বান জানিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোকে। এ পথে গেলে সরাসরি রাশিয়া থেকে আমদানির ঝুঁকি নিতে হয় না। বিশ্ববাজারের চেয়ে অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী হলে এ পথে যাওয়াই শ্রেয়তর হবে।

সোয়াপের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানির বিপরীতে রুবলে পরিশোধিত মূল্য জমা করা যায় রাশিয়ায় সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে এবং সোনালী ব্যাংক বাংলাদেশি রপ্তানিকারককে টাকায় রপ্তানিমূল্য পরিশোধ করবে। অন্যদিকে, রাশিয়া থেকে আমদানি করা তেলের দাম পরিশোধ করা হবে রাশিয়ায় রক্ষিত বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অ্যাকাউন্ট থেকে।

এটিই বর্তমানের বহুল আলোচিত সোয়াপ ব্যবস্থা। রাশিয়া থেকে তেল কেনার এ প্রক্রিয়া আপাতদৃষ্টে সহজ ও কার্যকর বলে মনে হলেও এখানে বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। প্রথমত, টাকা ও রুবলের বিনিময় হার কীভাবে নির্ধারিত হবে? ডলার পরিহার করে লেনদেনের (বিডলারীকরণ) পরিপ্রেক্ষিতে এই হার নির্ধারণের একটা পন্থা আবিষ্কার করতে ডলারকে মূল ভিত্তি না ধরে কি আবার স্বর্ণমানে ফিরে যেতে হবে? দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে যে বাণিজ্য-ঘাটতি আছে, তার কারণে আমাদের রপ্তানি আয় রাশিয়া থেকে আমদানি ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম। এমআইটিভিত্তিক তথ্যভান্ডার ওইসির হিসাবে ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮৯ কোটি ডলার, অন্যদিকে দেশটি থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ১৫২ কোটি ডলারের পণ্য।

এই বাড়তি আমদানির মূল্য পরিশোধ কোন পন্থায় হবে? বিশ্বব্যাপী আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম সুইফট থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার পর কীভাবে সম্পাদিত হবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য? যদিও একঘরে হয়ে যাওয়া রাশিয়া সুইফটের ওপর ভরসা না করে ইউক্রেন আক্রমণের বহু আগে এসপিএফএস (সিস্টেম ফর ট্রান্সফার অব ফিন্যান্সিয়াল মেসেজেস) চালু করেছে, যা নিষেধাজ্ঞার পর সুফল দিচ্ছে দেশটিকে। চীনও চালু করেছে সুইফটের বিকল্প সিআইপিএস (চায়না’জ ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম)। এখন রাশিয়া কিংবা চীনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পাদনে ইচ্ছুক যেকোনো দেশ এই দুই মাধ্যমে পারস্পরিক লেনদেন সম্পাদন করতে পারে। সুতরাং বিডলারীকরণের প্রেক্ষাপটে এই দুই বিদ্রোহী পেমেন্ট সিস্টেম রুবল ও ইউয়ান নিয়ে আমেরিকান ডলারের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা যায়।

রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল কিংবা গম আমদানি করার পথে বিশেষ কোনো অলঙ্ঘনীয় বাধা নেই; তবু আমাদের স্মরণে রাখতে হয় ১৯৭৪ সালের ঘটনা। বাংলাদেশ তখনো পিএল ৪৮০-এর অধীন আমেরিকার খয়রাতি খাদ্যসাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। অন্যদিকে, দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের বাজার ছিল সীমিত। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম দিকের বন্ধুপ্রতিম দেশ কিউবায় চটের বস্তা রপ্তানির অপরাধে বাংলাদেশকে পিএল ৪৮০-এর অধীন খাদ্যসাহায্য থেকে বঞ্চিত করে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকে আরও উসকে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, এটি এখন স্বীকৃত সত্য। অথচ সে সময় পিএল ৪৮০-এর অধীন সাহায্য পাওয়া দেশ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল কিউবার কাছে গাড়ি বিক্রি করছিল। ভারত আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়ার সঙ্গে যে বাণিজ্য উদ্যোগ চালু করেছে, সেটি কেবল দেশটির মরিয়া অবস্থানই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিডলারীকরণের পক্ষে একটা বার্তাও বটে। ভারতের সঙ্গে চীনের সদ্ভাব না থাকলেও একটা বিষয় বিবেচনায় আসতে পারে যে চীন, ভারত ও রাশিয়ায় বাস করে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩৮ শতাংশ।

এখানে আরেকটি বিকল্প উদ্ভাবন করা যায়। ভারত যেহেতু মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে, ভারতে পরিশোধিত সেই তেল রুপিতে আমদানি করতে পারি আমরা। বিডলারীকরণের অধীন ভারত ইতিমধ্যে সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করার আহ্বান জানিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোকে। এ পথে গেলে সরাসরি রাশিয়া থেকে আমদানির ঝুঁকি নিতে হয় না। বিশ্ববাজারের চেয়ে অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী হলে এ পথে যাওয়াই শ্রেয়তর হবে।

ফারুক মঈনউদ্দীন লেখক ও ব্যাংকার

fmainuddin@hotmail.com