বছরের অর্ধেক শেষ। এখন পর্যন্ত দেশে এ বছরের সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে, একটি ছাগল। গোটা দেশকে ছাগলটি যেভাবে ‘মাতিয়ে’ রাখল, এ দেশে টাইম ম্যাগাজিন–এর মতো পত্রিকা থাকলে বছর শেষে হয়ত ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে প্রচ্ছদে জায়গা করে নিত। ছাগল কীভাবে ‘পারসন’ হয় তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না, গরু পিটিয়ে মানুষ বানানোর ‘ঐতিহ্য’ এই দেশে রয়েছে!
বড় বাপের পোলায় খাবে বলে কথা! তাই ছাগল খেতে মানে কোরবানি দিতে যে সে ছাগল হলে হবে না, সেই ছাগলকেও হতে হবে এলিট ক্লাসের মানে উচ্চবংশীয়। দেশে এখন এমন বড় বাপের পোলার অভাব নেই। ফলে তাদের শখ–আহ্লাদ পূরণ করতে বা তাঁদের আকৃষ্ট করতে প্রস্তুত আছে উচ্চবংশীয় খামারও। ‘চাহিবামাত্র সাপ্লাই দিতে বাধ্য থাকিব’ এমনই যেন তাদের ব্রত।
সাদিক অ্যাগ্রো নামে এক খামার এবারের ‘বকরি’ ঈদে এমন একটি ছাগল নিয়ে আসে, সেটি নিয়েই যত তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল। ব্যান্ড গানের মতো বলতে হবে—এক ছাগল এসে সব ভেঙে দিয়ে গেল!
পশুপাখি অন্তঃপ্রাণ এক তরুণ ১৫ লাখ টাকার উচ্চবংশীয় সেই ছাগল কিনে নেওয়ার পর ঘটনার শুরু। এরপর টানটান উত্তেজনার এক ওয়েব সিরিজ দেখতে থাকল গোটা দেশের মানুষ। যেখানে বাবা প্রকাশ্যে ছেলেকে অস্বীকার করে। কে বাবা কে মা—পারলে কয়েকটি বাংলা সিনেমা মিলেমিশে জগাখিচুড়ি লেগে যায়। সত্য–মিথ্যার কাঠগড়া বসে যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এরপর তো বেরিয়ে এল—দেশের রাজস্ব বিভাগের ভেতরে দুর্নীতির সাম্রাজ্য তৈরি করা ‘মহামান্য’ মতিউর রহমানের যত কীর্তি। আর ছাগলের এক গুঁতাতেই ধসে গেল তাঁর সেই সাম্রাজ্য।
ছাগলটি প্রথমে মতিউরপুত্র তরুণের বেপরোয়া গাড়িবিলাস প্রকাশ করে দিল। এরপর খেল মতিউরের উপরি ইনকামের সুদীর্ঘ ক্যারিয়ার। অথচ দেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের চার–চারবার অনুসন্ধানেও যিনি ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ পেয়ে পার পেয়ে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকেই কি না ‘মাথা ন্যাড়া’ করে দেশ পর্যন্ত ছাড়াল সেই ছাগল।
তারপর শিক্ষক থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান বনে যাওয়া মতিউরের এক স্ত্রীকেও রেহাই দিল না। প্রকাশ হয়ে পড়ল তাঁরও সম্পদবিলাস ও ক্ষমতাচর্চার নানা ফিরিস্তি। এরপর তাঁদের এক কন্যাকেও ছাড়ল না। কানাডায় তাঁর কোটি কোটি টাকার গাড়ি–বাড়িও কিছুই গোপন থাকল না।
দেশের এত এত সংবাদমাধ্যম কিছুই করতে পারল না, দুদকও ফেইল, আইন ও বিচারব্যবস্থাও চুপ, সরকারেরও কোনো খবর নেই, সেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মূর্তমান প্রতীক হয়ে গেল একটি ছাগল!
শেষে এসে কামড় বসাল নিজের মালিককেও মানে সেই সাদিক অ্যাগ্রোকেও গুঁড়িয়ে দিল একেবারে। খামারটির মালিকের প্রাণী চোরাচালান ও যত সব মাফিয়াগিরিও ফাঁস করে দিল। এরপর মতিউর–কাণ্ডের সুবাদে এনবিআরের আরেক ‘সুবোধ’ কর্মকর্তা কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের আঙুল ফুলে বটগাছ হওয়ার কাহিনিও আমাদের জানা হয়ে গেল।
দেশের এত এত সংবাদমাধ্যম কিছুই করতে পারল না, দুদকও ফেইল, আইন ও বিচারব্যবস্থাও চুপ, সরকারেরও কোনো খবর নেই, সেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মূর্তমান প্রতীক হয়ে গেল একটি ছাগল!
কোরবানির জন্য কেনা হয়েছিল ছাগলটি, নিজেই দিব্যি বেঁচে থেকে কত কত মানুষকে ‘কোরবানি’ দিয়ে দিল! কেউ তাকে উপাধি দিচ্ছে ‘জাতীয় পশু’, কেউ বলছে ‘হুইসেল ব্লোয়ার’। সেই ছাগল জন্ম দিল নতুন নতুন প্রবাদবাক্য বা প্যারোডি—একটি ছাগল সারাজীবনের কান্না, কোটি টাকার সম্পদ খাইল লাখ টাকার ছাগলে, ছাগলের সঙ্গে যাবি বুঝবি শেষে, ছাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না ইত্যাদি।
তবে যাদের ‘সর্বনাশ’ হয়ে গেছে, তাদের কাছে সেই ছাগল এখন অপয়া বা অলক্ষুণে।ছাগলটিকে সরিয়ে এখন রাখা হয়েছে সাদিক অ্যাগ্রোর সাভারের একটি খামারে। সেখানকার ব্যবস্থাপক এক সংবাদমাধ্যমকে বলছেন, ‘এই ছাগলডারে এইহানে আনাই ঠিক অয় নাই। দুনিয়াদারি খাইয়া ছাগলটা অহন এইহানে কার কপাল খায় কে জানে!’
দেশে ফি বছর গরু–ছাগলের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারের এ ‘সাফল্য’ নিয়ে দুর্মুখদের কত হাসাহাসি, ট্রল বা ঠাট্টা–মশকরা। এখন একটি ছাগলই হয়ে গেল গোটা দেশের ‘গর্ব’। কয়েক সপ্তাহ ধরে সরকারি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ঘুম রীতিমতো হারাম করে ছাড়ল। কাকে ধরে আবার কাকে খায়! এমনিতেই কয়েক মাস ধরে দেশজুড়ে ‘জমিদারি’ কায়েম করা সাবেক পুলিশ কর্তাদের নিয়ে হইচইয়ের শেষ নেই। এ নিয়ে জাতীয় সংসদেও আওড়ানো হলো ‘ষড়তন্ত্র তত্ত্ব’।
এক সাবেক মন্ত্রী তো বলেই দিলেন, ‘ইদানীং যেসব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, আমি বিশ্বাস করি, এগুলো একটা ষড়যন্ত্রের অংশ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে হঠাৎ করে কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রচার-প্রপাগান্ডা করা হচ্ছে। দেশের মানুষের সন্দেহ হয়, আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দুর্নীতির বিষয়টি সামনে এসেছে। এটা ষড়যন্ত্রের অংশ; কিন্তু তারপরও এগুলো সত্য।’
বাজেট অধিবেশনে সরকারি দলের আরেক শীর্ষ নেতা বললেন, ‘যাঁরা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকেন, যেমন মতিউরকে দুর্নীতি দমন কমিশন, গণমাধ্যম এমনকি আমরা যাঁরা রাজনীতিক আছি, তাঁরা চিহ্নিত করতে পারিনি। তাঁকে একটি বোবা প্রাণী ছাগল চিহ্নিত করেছে। এমন মতিউর আরও আছে কি না, ভবিষ্যতে ছাগল বা অন্য কোনো বোবা প্রাণী চিহ্নিত করার আগে তাঁদের চিহ্নিত করার প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সংস্থার।’
সংসদ সদস্য মহোদয় উত্তম কথাই বলেছেন। তবে জাতি–রাষ্ট্র–দেশের কল্যাণের জন্য এমন ছাগল আরও দরকার নয় কি? জিডিপির অনুপাতে ফি বছর শিক্ষায় বরাদ্দ কমছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেটও যেমন কমছে, গবেষণার জন্য বরাদ্দও কমছে। শিক্ষকেরাও কে কার আগে ‘দলদাস’ হওয়ার গৌরব অর্জন করবে, সেই দৌড়ে ব্যস্ত। সেখান থেকে দেশের ভবিষ্যতের কান্ডারি বের হওয়া বড্ড দুষ্কর।
শিক্ষার্থীদের অনেকের আবার স্বপ্ন ‘মতিউর’ হওয়া। সে জন্য সেতু-টানেলের পিলারের সংখ্যা বা দৈর্ঘ্য মুখস্থ করতে সারা রাত লাইন ধরে লাইব্রেরিতে সিট ধরার প্রতিযোগিতাতেও আপত্তি নেই তাদের। ফলে সেই সব ভবিষ্যৎ মতিউরকে ধরতে যুগে যুগে এমন ছাগলই তো চাই আমরা।
সেটিই যেন যথার্থ উপলব্ধি করতে পেরেছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ছাগল পালনে তারা ব্যাংকের পাঁচ হাজার কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন তহবিল থেকে কম সুদে ঋণ দেবে। এত দিন সেটি দেওয়া হতো গরু, পোলট্রি, শস্য ও ফসল চাষে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তে নিঃসন্দেহে ছাগল পালন ও উৎপাদন বাড়বে। এর মধ্য দিয়ে আমরা চাইতে থাকব মতিউর–কাণ্ডের মতো আরও ‘আদর্শ ছাগল’ বেরিয়ে আসবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেসব ছাগল আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে। আমাদের শিশুরা কবিতা আউড়াতে থাকবে—আমাদের দেশে হবে সেই ছাগল কবে, ম্যাঁ ম্যাঁ না করে শুধু কাজেও বড় হবে!
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com