ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

রাশিয়া ও ইরান সত্যিই কতটা মিত্র

এ বছরের শেষ দিকে মস্কোতে ইরান ও রাশিয়া কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি করতে চলেছে। দুই যুগ ধরে দেশ দুটি কখনো মিত্র, আবার কখনো শত্রু ধরনের সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। রাশিয়া ও ইরান দুই পক্ষই সেই সম্পর্ককে সময়ে সময়ে নবায়ন করেছে। এখন দুই দেশই চাইছে তাদের চুক্তিতে বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতাগুলো আরও ভালোভাবে যেন প্রতিফলিত হয়।

ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার সঙ্গে গোটা পশ্চিমের সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব বাস্তবতা এরই মধ্যে মস্কোর সঙ্গে তেহরানের সম্পর্ক জটিল করে তুলেছে।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, রাশিয়া ইরানের হাতে সংবেদনশীল প্রযুক্তি দিতে সব সময়ই সতর্ক থেকেছে। এর বড় কারণ হলো রাশিয়া মনে করে, সেটা দিলে পশ্চিমাদের কাছ থেকে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তাতে আসবে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ সেই প্রেক্ষাপটটা বদলে দিয়েছে।

মস্কো এখন খুব আন্তরিকভাবে এশিয়ায় পা রাখছে। মস্কোর ভূরাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসে ইরান কেন্দ্রীয় একটি রাষ্ট্র। রাশিয়ার ওপর কঠোর যে নিষেধাজ্ঞা, তাতে দেশটির পক্ষে ভারত মহাসাগর ও পূর্ব আফ্রিকা পর্যন্ত পৌঁছানো কঠিন। সে কারণেই যত দিন গড়াচ্ছে, ততই মস্কোর প্রধান একটি অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে ইরান।

হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন পরিস্থিতি খুব একটা পরিবর্তন ঘটাবে বলে মনে হয় না। যদিও মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা প্রকৃতপক্ষেই সম্ভব। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের কারণে বড় কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। 

ইরানের সঙ্গে চুক্তির কারণে রাশিয়া অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে পড়বে। ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের ওপর আরও বেশি চাপ তৈরি করবে। এ কারণেই তেহরান মস্কোর সঙ্গে আরও বড় সামরিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়তে চাইছে। মস্কো ও তেহরানের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি কেমন হবে, তার বিস্তারিত রূপরেখা প্রকাশ্যে আসছে না। তবে দুই দেশের কর্মকর্তাদের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা যে বেশ কয়েকটি জায়গায় বাড়বে, সেটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়।

রাশিয়া-ইরানের কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি অবধারিতভাবে পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে দুর্বল করতে এবং বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা গড়তে যৌথ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। ব্রিকস, সাংহাই কো–অপরারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) মতো অ–পশ্চিমা উদ্যোগগুলো তারা এগিয়ে নেবে।

চুক্তিটিতে সম্ভবত ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য করার বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে। কারণ, দুই দেশের মধ্যে সম্প্রতি বাণিজ্যের পরিমাণ কমেছে। এ ছাড়া চুক্তিতে আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহন করিডর প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও থাকতে পারে। এই করিডর রাশিয়াকে ইরান ও ভারতের বন্দরগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করবে।

রাশিয়া সম্ভবত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হোক, এমন কিছু করতে আগ্রহী নয়। ইসরায়েলের সঙ্গে রাশিয়ার বিশেষ সম্পর্ক আছে। রাশিয়া-ইরান সম্পর্কে পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধের ওপর নির্ভরশীল। দুই দেশের সম্পর্ক যেমন বাস্তবতার ওপর প্রতিষ্ঠিত, আবার সেখানে প্রতিযোগিতাও আছে।

দ্বিপক্ষীয় সামরিক ও কৌশলগত সহযোগিতার জায়গাটিও গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। কেননা ইরান রাশিয়াকে স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও সামরিক ড্রোন দিয়েছে। অক্টোবর মাসে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এটা নিশ্চিত করেন যে চুক্তিতে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

দক্ষিণ ককেশাসে আঞ্চলিকতাবাদ ধারণাটি প্রতিষ্ঠার জন্যও মস্কো ও তেহরান একসঙ্গে কাজ করছে। এই অঞ্চলে দুই দেশেরই সীমান্ত আছে। ফলে তারা সেখান থেকে অ-আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের (বেশির ভাগই পশ্চিমা) বের করে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা লালন করছে।

এই চিন্তার গোড়া হলো ৩ যোগ ৩ উদ্যোগ, যেটা ইরান ও রাশিয়া যৌথভাবে সমর্থন করে। রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে তুরস্ক এবং দক্ষিণ ককেশাসের তিন দেশ আর্মেনিয়া, আজারবাইজান ও জর্জিয়া এর অন্তর্ভুক্ত। 

সবকিছু বিবেচনায়, রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিশ্চিত করেই সহযোগিতা বাড়াবে। কিন্তু সেটা আনুষ্ঠানিক জোট হবে না। 

প্রকৃতপক্ষে রাশিয়া ও ইরান—দুই দেশের কোনোটাই কম শক্তিশালী নয় যে তারা তাদের পররাষ্ট্রনীতির গতিপথকে সংকুচিত করে ফেলবে। এখন পর্যন্ত দেশ দুটি কোনো একক প্রতিদ্বন্দ্বী অথবা কোনো ক্রীড়নকের দিকে তাদের ভূরাজনীতিকে কেন্দ্রীভূত রাখেনি। সামরিক খাতে সহযোগিতার মাত্রা বাড়া সত্ত্বেও রাশিয়া-ইরান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে উত্তেজনাও আছে। যেমন ধরা যাক রাশিয়া এখন পর্যন্ত ইরানকে এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান দেয়নি। তার কারণ হলো রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য শক্তিধর দেশ, যেমন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে চায়। এই দেশগুলো আবার মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাবের বিরোধিতা করে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিরোধের জায়গা হলো আঞ্চলিক অবকাঠামো। রাশিয়া সম্প্রতি জেংজার ঝাংজেগুর করিডর নির্মাণের প্রতি তার সমর্থন জানিয়েছে। প্রস্তাবিত এই যোগাযোগ অবকাঠামো আজারবাইজানের সঙ্গে আর্মেনিয়া হয়ে নাকচেভান ছিটমহলের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবে। ইরান এই করিডরের বিরোধিতা করে আসছে। কারণ, তারা মনে করে, এতে তেহরানের আঞ্চলিক আধিপত্যের ওপর হুমকি তৈরি হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাশিয়া সম্ভবত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হোক, এমন কিছু করতে আগ্রহী নয়। ইসরায়েলের সঙ্গে রাশিয়ার বিশেষ সম্পর্ক আছে। 

রাশিয়া-ইরান সম্পর্কে পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধের ওপর নির্ভরশীল। দুই দেশের সম্পর্ক যেমন বাস্তবতার ওপর প্রতিষ্ঠিত, আবার সেখানে প্রতিযোগিতাও আছে।

এমিল অ্যাভিলিয়ান্ডি জর্জিয়ার ইউরোপিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত