পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে চান কেন?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মোমেন
ফাইল ছবি

গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মোমেন বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে মতামত চাওয়ার সংস্কৃতি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের নিয়ম-রীতি-আইন অনুযায়ী চলা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ‘দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের বিভিন্ন লোকজন দেশের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে বিদেশিদের মতামত চান। যদিও ওনারা (কূটনীতিক) আমাদের অতিথি, দেশ সম্পর্কে, ইতিহাস প্রসঙ্গে বাংলাদেশিদের চেয়ে তাঁদের জ্ঞান কম আছে। এই সংস্কৃতির (মতামত চাওয়া) পরিবর্তন হওয়া দরকার। তবুও ওনারা (দেশের লোকজন) তাঁদের (কূটনীতিক) কাছে যান। আমরা কিন্তু এখন আর পরাধীন দেশ নই। সেটা তাঁদের (কূটনীতিক) মনে রাখা উচিত।’

বাংলাদেশে যাঁরা কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে আসেন, তাঁদের কূটনৈতিক শিষ্টাচার না জানার কথা নয়। তারপরও পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা সরকারের অন্যান্য নীতিনির্ধারককে তাঁদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হয় কেন? পৃথিবীর কোনো দেশে ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু ভোটের সংজ্ঞা বদলে যায় না। বাংলাদেশে যায়। ফলে কূটনীতিকেরা বিভ্রান্তিতে পড়েন।

জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন চলছে। কয়েক দিন আগে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ আয়োজিত একটি সংলাপে তিনি বলেন, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে দেখতে চায় জাপান। তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে আমরা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কথা শুনেছি, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও শুনিনি। আমি আশা করব, এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না।’

নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে বিদেশ রাষ্ট্রদূত বা কূটনীতিকদের এখনকার বক্তব্যে সরকারের মন্ত্রীরা বেজার হন, ২০০৫ ও ২০০৬ সালে বিএনপির নেতারাও একইভাবে বেজার হতেন। সে সময়ে আওয়ামী লীগ নেতাদেরও বিদেশি দূতাবাসে গিয়ে ধরনা দিতে দেখা গেছে, এখন যেমন বিএনপির নেতারা দিচ্ছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার নসিহত না করে রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেদের ধরনা দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার কথা বললে সেটা স্বাধীন দেশের জন্য অনেক বেশি গৌরবের হতো।

জাপানের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন তাঁর এক কলামে লিখেছেন, ‘স্বাগতিক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা না বলা অবশ্যই কূটনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ। তবে বিষয়টি আমাদের রাজনীতিবিদদের মনে থাকে শুধু তখনই, যখন তাঁরা ক্ষমতায় থাকে। বিরোধী দলে গেলেই কথাটা তাঁরা বেমালুম ভুলে যান এবং যখনই প্রয়োজন মনে করেন, অভিযোগ নিয়ে যান রাষ্ট্রদূতদের কাছে। এমনকি সুযোগ করে দেন বিদেশি কেউ এসে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেওয়ার। অতীতে স্যার নিনিয়ান বা তারানকো মিশনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে।...শক্তিমান দেশের রাষ্ট্রদূতেরা জানেন যে, এরূপ হস্তক্ষেপমূলক বক্তব্য দিলেও তাঁদের কোনো সমস্যা হবে না। তা ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় গণতন্ত্র এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সমর্থন বা সহায়তা দেওয়া পশ্চিমা দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতির অন্তর্ভুক্ত। তাই ভিয়েনা কনভেনশনের পরিপন্থী হলেও এক হিসেবে তাঁরা তাঁদের ম্যান্ডেটই পূরণ করছেন, (প্রথম আলো, ১৯ নভেম্বর ২০২২)।

মানবজমিন পত্রিকার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকদের ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও রীতিনীতি’ মেনে চলার তাগিদ দিয়েছে সরকার। ঢাকার সব দূতাবাস, জাতিসংঘ কার্যালয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিসে এ-সংক্রান্ত অভিন্ন নোট ভারবাল পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। চিঠিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় আমরা সবাইকে সম্মানের সঙ্গে এটা স্মরণ করাতে চাই যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ বা কাজে কূটনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন এবং ১৯৬৩ সালের কনস্যুলার নীতি পুরোপুরি মেনে চলা উচিত।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে চান কেন? এখনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সরকারের অন্যান্য নীতিনির্ধারককে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ক্রসফায়ারের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। আইন করে না হয় সরকার বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করল। কিন্তু বিদেশি সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করবে কীভাবে?

কিন্তু বিদেশি কূটনীতিকেরা এসব নোট ভারবালকে খুব গুরুত্ব দেন বলে মনে হয় না। তারা জানেন যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা তাদের জন্য যতটা জরুরি তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি বাংলাদেশের। বিশেষ করে বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ আছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তারা বিশেষ সহায়তা দিয়ে থাকে। এ রকম অবস্থায় মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে সর্বজনীন সত্য কথা বললে তা কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘিত হয় না। ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে জাপানি রাষ্ট্রদূতের শোনা কথায় যারা উষ্মা প্রকাশ করেছেন, তাদের ২০১৪ এর নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের বক্তব্য স্মরণ করতে বলছি।

গত ৪ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে দেখা করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) ১৪টি দেশের কূটনীতিক। বৈঠকের পর প্রতিনিধিদলের পক্ষে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ড সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনী পরিবেশ দেখতে চাই। এ জন্য নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত, দেশের গণতন্ত্র আরও কার্যকর ও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে যেকোনো প্রকার সহযোগিতা দিতেও আমরা প্রস্তুত।’

মানবজমিন পত্রিকার খবর থেকে আরও জানা যায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার পরপরই ঢাকায় নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত এনি ভন লিউয়েন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন। টুইট বার্তায় ২৪ জুলাইয়ের সেই বৈঠকের বিষয়টি জানান দেন জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার। বৈঠকের ছবি প্রকাশ করে তিনি লেখেন—স্বাগতিক দেশের রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কূটনীতিকদের প্রধান দায়িত্ব। প্রায় অভিন্ন টুইট করেন নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত এনি ভন লিউয়েন

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মোমেন বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে না পেরে নিজ দেশের সাংবাদিকেদের মুখ বন্ধ করতে চাইছেন। তাহলে কি সাংবাদিকেরা রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে চীনা রাষ্ট্রদূতকে কিংবা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে ভারতীয় হাইকমিশনারকেও কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারবেন না? তিস্তার পানিবণ্টন ও রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা দুটোর সঙ্গেই বাংলাদেশের স্বার্থ জড়িত?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে চান কেন? এখনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সরকারের অন্যান্য নীতিনির্ধারককে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ক্রসফায়ারের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। আইন করে না হয় সরকার বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করল। কিন্তু বিদেশি সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করবে কীভাবে?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি