মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কৌশল হলো তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কৌশল হলো তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে

একের পর এক গণহত্যা: কতবার পার পাবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারে মিন অং হ্লাইংয়ের জান্তা সরকার যে পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে, সেটি আন্তর্জাতিক চাপ থেকে মুক্তির একটি ফন্দি ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়।

আপাতভাবে মিয়ানমারের সামরিক নেতারা ভেবে নিয়েছেন, একের পর এক জাতিগোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু করে তারা যে মানবাধিকারবিরোধী অপরাধ করে চলেছেন, সেটি তাঁরা নির্বিঘ্নেই চালিয়ে যেতে পারবেন। গণহত্যাসহ অন্যান্য অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ তাঁরা নিষ্ঠুর কৌশল প্রয়োগ করে এড়িয়ে চলেছেন। সর্বশেষ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রহেলিকা সৃষ্টি করে জান্তা সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোকা বানাতে চাইছে।

কিন্তু জার্মানির নাৎসি, ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো ও কম্বোডিয়ার খেমার রুজ শাসকদের পরিচালিত গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে যেভাবে হয়েছে, তাতে মিয়ানমারের সামরিক শাসকেরাও রোহিঙ্গাসহ একাধিক জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার অপরাধের ঘটনায় পার পাবেন না। নাৎসি শাসকেরা ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা-কর্মী, কমিউনিস্ট, জার্মান প্রতিবন্ধী, সমকামী, ইহুদি, রোমা ও সিন্থিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা সংঘটিত করেছিল। ১৯৬০-এর দশকে সুহার্তো সরকার কমিউনিস্ট তকমা দিয়ে ইন্দোনেশিয়ান ও চীনাদের বিরুদ্ধে আর খেমার রুজরা ১৯৭০-এর দশকে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, চ্যাম মুসলিম ও খেমার বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছিল।

মিয়ানমারের সেনারা এখন সংঘাত-কবলিত এলাকায় নিয়মিতভাবে বেসামরিক নাগরিকদের দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করছে। সেসব কাটা মাথা তারা জনসম্মুখে প্রদর্শন করছে। শুধু স্থানীয় বাসিন্দা নয়, অভ্যুত্থানবিরোধী সমস্ত জনগোষ্ঠীকে ভয় দেখানোর জন্য তারা সেসব বিচ্ছিন্ন মাথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে দিচ্ছে। থাইল্যান্ডের সীমানাসংলগ্ন কারেননি ও কারেন অঞ্চলের জাতিগত সংখ্যালঘুদের গ্রামগুলোতে খবার পানির কুয়াগুলোতে বিষও মিশিয়ে দিয়েছে তারা।

আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমার মামলাটির বিচারপ্রক্রিয়া এখন চলমান। কিন্তু মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত মিয়ানমারের সেই একই সামরিক নেতৃত্ব নতুন করে একই ধরনের অপরাধ সংঘটন করে চলেছে। মিয়ানমারের কারেননি, কারেন, কাচিনসহ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেই অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা হলো, কেন্দ্রস্থলের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা অভ্যুত্থানবিরোধী, তাদের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।

মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি জাতিসংঘ প্রকাশ করেছে। জেনেভাতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৫২তম অধিবেশনে সংস্থাটির হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন। সেখানে বলা হয়েছে—
‘মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে একটি কৌশল সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করতে দেখা গেছে। সেটা হলো গ্রামগুলো ও মানুষের বাড়িঘরগুলো পদ্ধতিগতভাবে ও বিস্তৃতভাবে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর গতিবিধির ওপর নজর রেখে জাতিসংঘ প্রতিবেদন বলছে যে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত দেশজুড়ে সামরিক অভিযানে (এর মধ্যে ২০১১ সালে কাচিনের ও ২০১৭ সালে রাখাইনের ঘটনা রয়েছে) অন্তত ৩৯ হাজার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।’

মাত্র পাঁচ বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে যায়। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তারা বাংলাদেশে চলে যায়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যেভাবে শত শত গ্রাম পুরোপুরি জ্বালিয়ে দেয়, তা থেকে জীবন বাঁচাতেই তারা পালিয়ে যান। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর গত দুই বছরে মিয়ানমারের সেই একই সামরিক বাহিনী একই কৌশল প্রয়োগ করে চলেছে। মিয়ানমারের ৮০ শতাংশ এলাকাজুড়ে যে সংঘাত চলছে, সেসব এলাকায় ১৩ লাখের বেশি মানুষ ইতিমধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

ধর্মীয় পরিচয়ে বৌদ্ধ নয় কিংবা জাতিগত পরিচয়ে বর্মিজ নয়, এমন জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জঘন্য ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নৃশংস কর্মকাণ্ডের অভিযোগ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর জন্য নতুন ঘটনা নয়। কয়েক দশক ধরেই তারা এটা করে চলেছে। কিন্তু এবারের সামরিক শাসকেরা নতুন যেটা করছেন, তা হলো ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ব্যাপক অজনপ্রিয় অভ্যুত্থানের সমালোচনা বা বিরোধিতা যেসব গোষ্ঠী করেছে, তাদেরকে তারা ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে।

জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল মিয়ানমার নিয়ে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশের এক সপ্তাহ পর কারেননি ও স্যাগায়িং অঞ্চল থেকে আসা অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলনকর্মীদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। সেখানকার জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের জান্তারা যে ভয়ংকর নৃশংসতা চালিয়েছে, তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী তারা। বিমান থেকে গোলাবর্ষণ, মর্টার সেল নিক্ষেপ ও গণহত্যা করেছে। পুরো গ্রাম ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে।

জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু কারেননিরা বংশানুক্রমিকভাবে থাইল্যান্ডের সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় বাস করে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এই জাতিগোষ্ঠীর বেসামরিক নাগরিক ও তাদের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয়ে উপর্যুপরি হামলা চালায়। এর ফলে তাদের প্রায় অর্ধেক মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মিয়ানমারের বৌদ্ধদের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত স্যাগায়িং দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ের কাছাকাছি অবস্থিত। অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধে অংশ নেওয়ার অভিযোগে সেখানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গণহত্যা ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।

মিয়ানমারের ৮০ শতাংশ এলাকায় বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে

মিয়ানমারের সেনারা এখন সংঘাত-কবলিত এলাকায় নিয়মিতভাবে বেসামরিক নাগরিকদের দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করছে। সেসব কাটা মাথা তারা জনসম্মুখে প্রদর্শন করছে। শুধু স্থানীয় বাসিন্দা নয়, অভ্যুত্থানবিরোধী সমস্ত জনগোষ্ঠীকে ভয় দেখানোর জন্য তারা সেসব বিচ্ছিন্ন মাথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে দিচ্ছে। থাইল্যান্ডের সীমানাসংলগ্ন কারেননি ও কারেন অঞ্চলের জাতিগত সংখ্যালঘুদের গ্রামগুলোতে খবার পানির কুয়াগুলোতে বিষও মিশিয়ে দিয়েছে তারা।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মিয়ানমারের সেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে ৩৯ হাজার বাড়িঘর ধ্বংস করেছে। কিন্তু অন্যান্য বেসামরিক ও ধর্মীয় স্থাপনা যেমন হাসপাতাল, বিদ্যালয়, বৌদ্ধমঠ, চার্চ, মসজিদ, খাদ্য ও ধান সংরক্ষণের গুদাম ও হাটবাজার তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে, সেগুলো এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যে ধরনের জাতিগত নির্মূলের শিকার হয়েছিল, তার সঙ্গেই কেবল চলমান ধ্বংসযজ্ঞের তুলনা চলে।

কিন্তু নানা পরিচয়ের জনগোষ্ঠীর (গণতন্ত্রকামী ও ভিন্নমতালম্বী এবং তাদের জাতিগোষ্ঠী এবং অভ্যুত্থানবিরোধী সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী) বিরুদ্ধে যে জাতিগত নির্মূল অভিযান চলছে, সেটা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হুঁশিয়ারি আমরা শুনছি না। এর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো শীর্ষ মানবাধিকার সংস্থা জানে যে গণহত্যা সনদ অনুসারে গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন।

কিন্তু গণহত্যার সংজ্ঞা নাৎসি গণহত্যার আগে নির্ধারণ করা হয়েছে। পোল্যান্ডের ইহুদি আইনবিশারদ র‌্যাফেল লেমকিন গণহত্যার যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিলেন, তাতে গণহত্যা বলতে শুধু নির্দিষ্ট পরিচয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত ব্যাপক হত্যাকাণ্ড বোঝানো হয়নি। লেমকিনের এই ধারণা যখন আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় গণহত্যাবিষয়ক সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন মাত্র চার ধরনের বিষয় তাতে ঠাঁই পায়। জাতি, বর্ণ, গোত্র ও ধর্মীয় পরিচয়ের গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই গণহত্যার সংজ্ঞাটি প্রযোজ্য। কিন্তু গণতন্ত্রী, ভিন্নমতাবলম্বী, কমিউনিস্ট—এ ধরনের ভিন্ন পরিচয়ের গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য হয় না।

বার্মিজ মানবাধিকারকর্মী ও নির্বাসনবিশেষজ্ঞ হিসেবে এক দশক আগে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত ধ্রুপদি গণহত্যার ঘটনাটি আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রথম ফাঁস করেছিলাম। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি নির্মূল করার জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাদের ওপর তিন বছর ধরে পদ্ধিতগত নিপীড়ন চালিয়েছিল।

অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি শুনে এবং দেশজুড়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে কৌশল প্রয়োগ করছে তার অসংখ্য নথি ঘেঁটে, আমি এই সতর্কবার্তা উচ্চারণ করছি যে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের গণহত্যাকারী সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ যেভাবে অস্বীকার করে চলেছে এবং এ অপরাধের পক্ষে যেভাবে সাফই গেয়েছে, নতুন গণহত্যার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলে তারা সেটার পুনরাবৃত্তি করবে। এ দফায় তারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গণতন্ত্রপন্থী, ভিন্নমতাবলম্বী, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, জাতিগত সংখ্যাগুরু বামার এবং সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে গণহত্যা সংঘটিত করে চলেছে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মনোজ দে
● মং জার্নি যুক্তরাজ্যপ্রবাসী মিয়ানমারের মানবাধিকারকর্মী