মতামত

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন।

দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তারা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছে এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারের বেশি পরামর্শ তাদের কাছে জমা পড়েছে। 

নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তা স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন।

এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার অধিকারসহ সব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ফিরে পাওয়া। এই অধিকারগুলো ফিরে পেতে নাগরিকদের ক্ষমতায়ন ও তার সুরক্ষা প্রয়োজন।

নাগরিকের অধিকার যখন কেউ বা রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান লঙ্ঘন করেছে, তখন তাদের সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থাও কাজ করেনি। যেমন আদালতও মৌলিক অধিকার রক্ষায় তাঁর কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারেননি। আর ক্ষমতা আয়ত্ত করা ক্ষমতাধরেরা জবাবদিহির ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন। 

সংবিধান সংস্কারে নাগরিকদের এই ক্ষমতায়ন বাড়ানো এবং তার সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এটা নানাভাবেই হতে পারে। সুইজারল্যান্ডে নাগরিক ক্ষমতায়নের একটি মডেল হচ্ছে সরকারের আইন প্রস্তাবের ওপর গণভোট। সরকার যেসব আইন তৈরি করতে চায়, তার খসড়া প্রকাশের ১০০ দিনের মধ্যে যদি এক লাখ নাগরিকের গণস্বাক্ষরে গণভোট দাবি করা হয়, তবে সেই প্রস্তাবের ওপর গণভোট বাধ্যতামূলক। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের চর্চা এই গণভোটে সুইসরা দীর্ঘদিন ধরে অভ্যস্ত। বছরে একাধিকবার গণভোটের আয়োজন আমাদের দেশের জন্য কঠিন ও ব্যয়বহুল হতে পারে বলে তা সম্ভবত শিগগিরই কার্যকর করা যাবে না। 

কিন্তু নাগরিকের ক্ষমতায়ন ও জনপ্রতিনিধির জবাবদিহির আরেকটি মডেল বেশ সফলভাবেই কার্যকর হয়েছে যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে। যুক্তরাজ্যে কোনো এমপি নৈতিক স্খলনজনিত অভিযোগে দণ্ডিত হলে (সেটি কারাদণ্ড না হয়ে জরিমানা বা পার্লামেন্টের অধিবেশন থেকে ১০ কার্যদিবস বা তার চেয়ে বেশি দিনের জন্য বারিত হওয়াও হতে পারে) তাঁর সদস্যপদ বাতিল বা আসনটি শূন্য ঘোষণার আবেদন ওই আসনের ভোটারদের গণস্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত হয়।

ওই নির্বাচনী এলাকার ১০ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরে আসনটি শূন্য হয় এবং সেখানে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর তিনি যদি আদালতে ১২ মাসের বেশি মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন, তাহলে এমনিতেই তাঁর সদস্যপদ খারিজ হয়ে যায়। 

যুক্তরাজ্যে রিকল পদ্ধতি অপেক্ষাকৃত নতুন সংযোজন। এমপিদের ভুয়া ভাতা কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পটভূমিতে ২০১০ সালে আইন করে এ ব্যবস্থা চালু করা হয়। জাপান, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডরসহ বেশ কয়েকটি দেশে চালু আছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতেও গভর্নরের বিরুদ্ধে রিকল ভোট হয়েছে, যদিও তাতে গভর্নর টিকে গেছেন। ভারতে পঞ্চায়েত–ব্যবস্থায় এবং বেশ কয়েকটি রাজ্যে স্থানীয় সরকার অর্থাৎ পৌর মেয়র ও নগরকর্তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা বহুদিন ধরে কার্যকর রয়েছে। 

এমপিদের অপসারণের এই ‘রিকল’ পদ্ধতি তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার একটি কার্যকর উপায় এবং এতে ভোটারের ক্ষমতায়ন হয়। আমাদের সংবিধানে এই রিকল পদ্ধতির বিধান প্রয়োজন। রিকলের জন্য আবেদনকারী রেজিস্টার্ড ভোটারের সংখ্যা অবশ্য ২০ শতাংশেও নির্ধারণ করা যায়, যাতে কোনো সংসদ সদস্য শুধু বড় প্রতিদ্বন্দ্বী দলের একতরফা বিদ্বেষের শিকার না হন। 

ক্ষমতাধরদের জবাবদিহির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে সংবাদমাধ্যম, যেখানে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করাই হচ্ছে সাংবাদিকতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সুইস সংবিধানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরে একটি আলাদা অনুচ্ছেদ আছে, যাতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন এবং অন্যান্য মাধ্যমে তথ্য প্রকাশ ও সম্প্রচারের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হলো। এতে সেন্সরশিপ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি (সংবাদের) সূত্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথাও রয়েছে। আশা করি, আমাদের সংবিধানেও এ রকম একটি অনুচ্ছেদ যোগ করা যাবে। 

যেকোনো গণতন্ত্রে শাসনব্যবস্থা পরিচালনায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকাই যে প্রধান, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব (নির্বাচিত অথবা অনির্বাচিত) জনপ্রতিনিধিদের নিজ নিজ এলাকার ভোটারদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য করতে পারেন না। আমরা জানি, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোয় সাংগঠনিক গণতন্ত্রের কোনো চর্চা নেই। নেতা ও দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহীরা দলের তৃণমূলের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হন না। কিন্তু তাঁরাই দলের স্বার্থ নির্ধারণ করেন এবং দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সেই স্বার্থ রক্ষায় ভোট দিতে বাধ্য করেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সেই ব্যবস্থাই নির্দেশিত আছে। 

রাজনীতিকেরা অতীতে সরকারের স্থিতিশীলতার দোহাই দিয়ে এই অনুচ্ছেদের সাফাই গেয়েছেন। ফলে কোনো সংসদ সদস্য তাঁর নির্বাচনী এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার কোনো নীতি বা আইন প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেও তাঁরা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে সংসদে ভোট দিতে পারেন না। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণের প্রস্তাবের ক্ষেত্রে বহুবার এ রকম দেখা গেছে। অথচ অর্থ বিলে স্বাধীনভাবে ভোট দিলে এসব সংসদ সদস্যের অনেকেই হয়তো দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতেন।

ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়ে বাছাই কমিটিতে সংসদ সদস্যরা যে মতামত দিয়েছিলেন, পরে এর বিরুদ্ধেই তাঁরা ভোট দিতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে পরবর্তী সময়ে কেউ কেউ দাবি করেছেন। এমনকি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংসদ সদস্যও রাষ্ট্রধর্মের বিরোধিতা করে ভোটদানে বিরত থাকতে পারেননি। 

অতীত থেকে আমরা জানি, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছালে সব সংকটেরই নিরসন ঘটেছে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রচলন—এসবই হয়েছে জাতীয় সমঝোতার মাধ্যমে। সুতরাং সংবিধান পুনর্লিখন বা সংশোধন-সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবই দিক না কেন, তা নিয়ে একটি সর্বদলীয় সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে আরেকবার একটি জাতীয় সমঝোতায় উপনীত হওয়া একবারে অসম্ভব কিছু নয়।

এই অনুচ্ছেদ একেবারেই তুলে দেওয়া উচিত। সংসদ সদস্যরা তাঁর নির্বাচকমণ্ডলী অর্থাৎ এলাকাবাসীর প্রতিনিধিত্ব করেন এবং সে কারণে তাঁর নির্বাচনী এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের ভিত্তিতে তাঁরা সংসদে ভোট দেবেন, সেটাই প্রত্যাশিত। যদি তিনি দলনেতার নির্দেশ অমান্য করে সংসদে ভোট দেন কিংবা দল থেকে বহিষ্কৃতও হন, তাহলেও তিনি কেন স্বতন্ত্র হিসেবে তাঁর এলাকাবাসীর প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না?

আর দলত্যাগ করে অন্য কোনো দলে যোগ দিলে তাঁর জন্য উপনির্বাচনে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার বিধানও যোগ করা যায়। দলবদলের পরিণতিতে উপনির্বাচনের বিধান যোগ করা হলে সংসদ সদস্যদের কথিত কেনাবেচা (হর্স ট্রেডিং) বন্ধ হবে; নিদেনপক্ষে কমবে। সরকারের স্থিতিশীলতার চেয়ে ভোটারদের প্রতি আনুগত্য ও তাঁদের কাছে জবাবদিহির গুরুত্ব কোনোভাবেই কম হতে পারে না। 

সংবিধানে রিপাবলিকের বাংলা করা হয়েছে প্রজাতন্ত্র, যা কার্যত নাগরিকদের প্রজায় রূপান্তরিত করেছে। পিপলস রিপাবলিকের আক্ষরিক অনুবাদের সঠিক-বেঠিক বিচার না করে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সবাই তার যে মর্মার্থ বুঝেছিল, সেই জনগণের গণতন্ত্র বা জনগণতান্ত্রিক বিশেষণ ব্যবহারেই দেশবাসীর গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার যথার্থ প্রতিফলন ঘটে বলে আমাদের বিশ্বাস।

বিতর্ক হচ্ছে সংবিধান সংশোধন নাকি পুনর্লিখন। এই বিতর্কের আগে বোধ হয় আমাদের সবার স্বীকার করা প্রয়োজন যে ৫৩ বছরে এই সংবিধান কোনো রাজনৈতিক সংকটেরই সমাধান দিতে পারেনি; বরং অন্তত ছয়বার রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান হয়েছে। একবার হয়েছে রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থান এবং আরও কয়েকবার সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে দুবার—১৯৯০ ও ২০২৪ সালে। এ ছাড়া রক্তক্ষয়ী আন্দোলন, দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা রাজনৈতিক সংকটে দেশে স্থিতিশীলতার নামে চেপে বসেছিল স্বৈরশাসন। সাংবিধানিকতা ও আইনের শাসনের কথা বলে নাগরিকদের বশ্যতা আদায়ের চেষ্টায় অবিশ্বাস্য রকমের শক্তি প্রয়োগ ও নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।

কুক্ষিগত ক্ষমতাকে স্থায়ীকরণে ত্রয়োদশ সংশোধনীতে সংবিধানের একটা বড় অংশকে যে অপরিবর্তনীয় করা হয়েছে, তা কার্যত নাগরিকদের চিরতরে ক্ষমতাহীন করে ফেলার নামান্তর। সংবিধানকে প্রায় ধর্মগ্রন্থের সমতুল্য করে ফেলার বদলে নমনীয় রাখাই শ্রেয়, যাতে প্রয়োজনে গণভোটের মাধ্যমে তার সংশোধন সম্ভব হয়। 

অতীত থেকে আমরা জানি, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছালে সব সংকটেরই নিরসন ঘটেছে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রচলন—এসবই হয়েছে জাতীয় সমঝোতার মাধ্যমে। সুতরাং সংবিধান পুনর্লিখন বা সংশোধন-সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবই দিক না কেন, তা নিয়ে একটি সর্বদলীয় সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে আরেকবার একটি জাতীয় সমঝোতায় উপনীত হওয়া একবারে অসম্ভব কিছু নয়।

কামাল আহমেদ সাংবাদিক