চীনের জনসম্পদ বুড়িয়ে যাচ্ছে। এতে তাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনের সক্ষমতা কমছে
চীনের জনসম্পদ বুড়িয়ে যাচ্ছে। এতে তাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনের সক্ষমতা কমছে

চীনের অর্থনৈতিক ইঞ্জিনের জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে

এ মাসের গোড়ার দিকে অর্থনৈতিক রেটিং এজেন্সি মুডিস চীনের সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিংকে ঋণাত্মক হিসেবে দেখিয়েছে। এর মাধ্যমে চীনের সম্পদ ঘাটতি গভীরতর হওয়া এবং প্রবৃদ্ধির দীর্ঘমেয়াদি মন্দার ঝুঁকি প্রকাশিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, মুডিস ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, চীনের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২৪ এবং ২০২৫ সালে ৪ শতাংশ কমে যাবে। পরবর্তী এক দশকে প্রবৃদ্ধি গড়ে ৩.৮ শতাংশ কমবে। ২০৩০ সালের মধ্যে সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি ৩.৫ শতাংশ পাবে। চীনের এই মন্দার একটি প্রধান কারণ ‘দুর্বল জনসংখ্যা’।

চীনের চতুর্দশতম অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন বিষয়ক পাঁচসালা পরিকল্পনা ঠিক করতে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করেছিলেন। সেই সিম্পোজিয়ামে বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রধান অর্থনীতিবিদ জাস্টিন ইফু লিনসহ বহু অর্থনীতিবিদ হাজির হয়েছিলেন। সেখানকার আলোচনার ভিত্তিতে সি চিন পিং সেখানে ঘোষণা করেছিলেন, আগামী ১৬ বছরে চীনের মাথাপিছু জিডিপি দ্বিগুণ করা ‘সম্পূর্ণভাবে সম্ভব’। লিন এই আশাবাদী পূর্বাভাসের পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন।

২০১৯ সালে চীনের মাথাপিছু জিডিপি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্তরের মাত্র ২২ দশমিক ৬ শতাংশ (জনগণের ক্রয়ক্ষমতা–সংক্রান্ত সমতার ভিত্তিতে করা হিসাব অনুযায়ী)। ১৯৪৬ সালে জার্মানি, ১৯৫৬ সালে জাপান এবং ১৯৮৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়া একই স্তরে ছিল এবং তাদের অর্থনীতি পরবর্তী ১৬ বছরে গড়ে যথাক্রমে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, ৯ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

লিন তাঁর আলোচনার উপসংহার টেনেছিলেন: জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি পড়ে যাওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রযুক্তি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পরও ২০১৯–২০৩৫ সময়কালের বার্ষিক সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ এবং ২০৩৬–২০৫০ সময়কালের বার্ষিক সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ অর্জন ধরা হয়েছে, যা খুব সহজেই প্রকৃত বার্ষিক প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ৬ শতাংশ ও ৪ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। এই পূর্বাভাস অনুসারে, চীনের জিডিপি ২০৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে এবং ২০৪৯ সালের মধ্যে তা দ্বিগুণ হবে। তত দিনে চীনা নাগরিকদের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের চার গুণে গিয়ে দাঁড়াবে।

লিন তারও বেশ আগে আরও বেশি আশাবাদ মেশানো ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ২০০৫ সালে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ২০৩০ সাল নাগাদ চীনের অর্থনীতি আমেরিকার অর্থনীতির দেড় থেকে দুই গুণ বড় হবে এবং চীনের জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় পাঁচ গুণ হবে।

২০০৮ সালে তিনি সম্ভবত আরও ‘নির্বোধ’ ছিলেন। সে সময় তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে চীনের অর্থনীতি আমেরিকার অর্থনীতির আড়াই গুণ হবে। ২০১১ সালে আবার তিনি আগের অবস্থানে ফিরে গিয়ে বলেছিলেন, চীনের অর্থনীতি ২০৩০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ হবে। এরপর ২০১৪ সালে তিনি তাঁর ২০০৫ সালের পূর্বাভাসে ফিরে গিয়ে বলেন, এই সময়কালে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের দেড় থেকে দুই গুণ বড় হবে। বছরের পর বছর ধরে চীনের নেতারা তঁাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং শাসনের মডেলের এক ধরনের প্রমাণ হিসেবে লিনের দেওয়া এসব পূর্বাভাসকে গ্রহণ করে এসেছেন। লিনের এসব ভবিষ্যদ্বাণী চীনা নেতাদের কাছে যত আকর্ষণীয়ই হোক না কেন, সেগুলো চরমভাবে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অন্ততপক্ষে জনসংখ্যাগত ধারণা থেকে লিন যে অগ্রগতির কথা বলেছিলেন, তা একেবারেই ভুল।

যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীনের মাঝ বয়সী এবং ৬৪ বছরের বেশি বয়স্ক লোকের সংখ্যার উচ্চ অনুপাত প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক দিক নির্দেশ করছে। চীনের বুড়িয়ে যাওয়া নাগরিকের সংখ্যাধিক্য বলে দিচ্ছে লিন যে তিনটি দেশের (জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র) সঙ্গে চীনের অর্থনীতির তুলনা করেছিলেন, তাদের সবগুলোর চেয়ে চীন অনেক বেশি খারাপ করছে।

জার্মানির মাথাপিছু জিডিপি যখন যুক্তরাষ্ট্রের ২২ দশমিক ৬ শতাংশের সমান ছিল, তখন জার্মানির নাগরিকদের গড় বয়স ছিল ৩৪ বছর। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার গড় বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর। পরবর্তী ১৬ বছরের শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির পর তিনটি দেশে গড় বয়স দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৩৫, ৩০ ও ৩২ বছর। সে তুলনায় ২০১৯ সালে চীনের গড় বয়স ছিল ৪১ এবং ২০৩৫ সালে তা ৪৯ বছরে দাঁড়াবে।

একইভাবে, ১৬ বছরের সময়কালের শুরুতে (যেন যেমনটি উল্লেখ করেছিলেন) জার্মানি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ৬৪ বছরের বেশি বয়সী লোকের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৮ শতাংশ, ৫ শতাংশ ও ৪ শতাংশ যা ১৬ বছর শেষে যথাক্রমে ১২ শতাংশ, ৭ শতাংশ ও ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সেই তুলনায় চীনে ২০১৯ সালে ৬৪ বছরের বেশি মানুষের সংখ্যা ছিল ১৩ শতাংশ আর ২০৩৫ সালে এই সংখ্যা ২৫ শতাংশে পৌঁছাবে।

অর্থাৎ চীনের জনসম্পদ বুড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনের সক্ষমতা কমেছে এবং কমছে। কেউ যদি চীনের অর্থনীতিকে একটি বিমান হিসেবে কল্পনা করেন, তাহলে বুঝতে পারবেন, ১৯৭৮ সালে যে সংস্কার নীতির পথ ধরে বিমানটির উড্ডয়ন শুরু হয়েছিল, সেটির জ্বালানি ছিল তরুণ শ্রমিকেরা। তিন দশক ধরে সেই জ্বালানি তীব্র গতিতে চীনকে উড়িয়ে নিয়েছে। কিন্তু ২০১২ সালে এসে সেই জ্বালানিতে টান পড়া শুরু হয়েছে। ফলে বিমানটি এখন গতি হারাতে বাধ্য হচ্ছে।

● উই ফুজিয়ান উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগবিদ্যার একজন সিনিয়র বিজ্ঞানী ও বিগ কান্ট্রি উইথ এম্পটি নেস্ট বইয়ের এর লেখক

ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট