মণিপুরের পর সিকিমের দিকে নজর যাচ্ছে সবার

গত ৪ মে এটিএসইউএমের ডাকে ‘আদিবাসী সংহতি পদযাত্রা’র সময় ইম্ফলে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
ছবি: এএনআই

মূলধারার ভারতীয় মিডিয়া সচরাচর উত্তর-পূর্ব জনপদের অসন্তোষের খবর যত দূর পারা যায় আড়াল করে। মণিপুরের চলতি জাতিগত দাঙ্গা সেই আড়ালেরও ফল। দুই–তিন মাস আগে থেকে সেখানে সামাজিক অসন্তোষ ছিল।

তাৎক্ষণিকভাবে সেটা জাতীয়ভাবে জানাজানি হলে এবং প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হলে চলতি ‘গণঅগ্নিকাণ্ড’ হয়তো এড়ানো যেত। সিকিমের অবস্থাও তা–ই। সেখানে এ মুহূর্তে অসন্তোষের প্রাথমিক পর্যায় চলছে। তবে যেকোনো সময় তার অনাকাঙ্ক্ষিত বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

সাত ভগ্নির ছোট ভাই ভালো নেই

সিকিমকে সাধারণত ভারতীয় ‘সাত ভগ্নি’ পরিচয়ে যুক্ত করা হয় না। এর কারণ, উত্তর-পূর্ব ভারতীয় সাত রাজ্যের সঙ্গে তার সরাসরি সীমান্ত নেই। কিন্তু মানুষ, প্রকৃতি ও রাজনৈতিক ইতিহাসের বিচারে সিকিমও সাত ভগ্নির মতো। সে কারণে তাকে ‘সাত ভগ্নির ছোট ভ্রাতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ মুহূর্তে যখন মণিপুরের সংঘাতের আঁচ লেগেছে পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতে—তখন সিকিমও তার বাইরে নেই। তবে সাত হাজার বর্গকিলোমিটারের এই ছোট রাজ্যে মণিপুরের আগে থেকে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে ভিন্ন এক ইস্যু।

যে জনপদে কর দিতে হয় না

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সিকিমের পরিচয় দিতে গিয়ে মজা করে বলা হয়, ‘যে জনপদে কর দিতে হয় না’। দ্য ইকোনমিস্ট একবার ‘আ ল্যান্ড উইদাউট ইনকাম ট্যাক্স’ নামে প্রতিবেদনও করেছিল সিকিম নিয়ে।

ভারতের ১৯৬১–এর আয়কর আইনে সবার জন্য রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। সংবিধানের ৩৭২-এফ অনুচ্ছেদের আলোকে সিকিমিরা এই নিয়ম থেকে রেহাই পেয়েছে। তারা নিজেদের ১৯৪৮ সালের ‘ট্যাক্ট ম্যানুয়েলে’র চলে—যাতে কেন্দ্রকে আয়কর দিতে হয় না। এমনকি শেয়ারবাজারের আয়ও তাদের করমুক্ত।

সিকিমিদের এই সুবিধা বিশ্বের অন্যত্র অনেকের কাছে লোভনীয় হলেও তাদের যে আয়কর দিতে হয় না, সেটা এই রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাসে আনন্দভরা কোনো অধ্যায় নয়। ১৯৭৫ সালে স্বাধীন অবস্থান ছেড়ে ভারতভুক্তির সময় সেখানকার নাগরিকদের এই ‘সুবিধা’টুকু দেওয়া হয়েছিল। এ রকম কিছু ‘বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা’ দিয়েই ওই সময় সিকিমকে ভারত ইউনিয়নে আনা হয়।

সম্প্রতি গ্যাংটকে মিছিল-মিটিং করে সিকিমিরা জানাচ্ছে, তাদের এত দিনকার সেই বিশেষ মর্যাদা গুরুতর আঁচড় লেগেছে। গ্যাংটকের এসব নাগরিক অসন্তোষের খবর দক্ষিণ এশিয়ার কম মানুষ জানেন। যেভাবে তাঁরা এক সপ্তাহ আগে মণিপুরের মৈতি বনাম জো জাতির অসন্তোষের কথাও কম জানতেন। রক্তপাতের আগে প্রান্তিক মানুষদের কোনো বেদনাই যেন ‘খবর’ হওয়ার মতো নয়।

মণিপুর রাজের বিভিন্ন জেলায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

উচ্চ আদালতের রায় সিকিমকে যেভাবে বদলে দিল

উত্তর-পূর্ব ভারতীয় ‘সাত কন্যা’র তুলনায় সিকিমের জনজীবন বরাবরই অধিক শান্ত। একে ঘিরে কিছু স্পর্শকাতর আড়ালও আছে সেটা ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা জানেন।
সাধারণত সিকিমকেন্দ্রিক খবর জুড়ে থাকে পর্যটন এবং জৈব কৃষির সফলতা। তবে এ বছরের জানুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টের এক রায় ঘিরে প্রথম জন-অসন্তোষের খবর আসতে শুরু করে। ১৩ জানুয়ারির ওই রায়ে সিকিমিবহির্ভূত স্থানীয়দেরও (যেসব ভারতীয় ১৯৭৫–এর ২৬ এপ্রিলের আগে থেকে এখানে স্থায়ীভাবে আছে) আয়কর মওকুফের সুবিধা দিতে বলা হয়। আপাতদৃষ্টে ব্যাপারটা সাধারণ এক অর্থনৈতিক বিষয় হলেও এর মধ্যে লুকিয়ে আছে গভীর এক জাতিগত সংকটের নকশা। অন্তত প্রকৃত সিকিমিরা তা–ই মনে করে।

‘প্রকৃত সিকিমি’ বলতে বোঝানো হয় যাঁদের নাম সেখানকার ১৯৬১ সালের রেজিস্ট্রারভুক্ত—তাঁরা ও তাঁদের বংশধরেরা। তাঁদের বক্তব্য হলো, সংবিধানের যে অনুচ্ছেদ তাঁদের আয়কর থেকে অব্যাহতি দিয়েছে, সেটা অন্যদের বেলায় প্রযোজ্য করার অর্থ দুটি। প্রথমত, অনুচ্ছেদটি আর কার্যকর নেই; দ্বিতীয়ত, করসুবিধায় অন্তর্ভুক্ত ‘নতুন’দেরও পরোক্ষে সিকিমি পরিচয় দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে সিকিমের বসবাসকারী ‘পুরোনো ভারতীয়’রা সিকিমি পরিচয় নিয়ে ক্ষুদ্র এই জনপদের জাতিগত বিন্যাস পাল্টে দিতে পারে। কারণ, প্রকৃত সিকিমিরা সংখ্যায় ৬-৭ লাখ মাত্র।

এ রকম বক্তব্যের ওপর দাঁড়িয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রথমে ‘বন্‌ধ্‌’ বা হরতাল ডেকে অসন্তোষের জানান দেয় সিকিমি নাগরিক সংগঠনগুলো। ১৩ জানুয়ারির রায়ে আদালত কেবল আয়কর না দেওয়ার নিয়মই সম্প্রসারিত করেননি—সিকিমিদের পূর্বপুরুষদের ‘বিদেশি’ (নেপালি) হিসেবেও উল্লেখ করে। স্বভাবত প্রকৃত সিকিমিরা এতে অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ। পরে আন্দোলনের মুখে বলা হয়, রায়ের জাতিগত প্রশ্নটি সংশোধন করা হবে।

১১৮ পৃষ্ঠার রায়ে আদালতের বক্তব্য ছিল, নেপালিভাষী (বিদেশি) পূর্বপুরুষের সন্তান হয়েও যদি সিকিমিরা আয়কর রেয়াত পেতে পারে, তাহলে ১৯৭৫–এর আগে থেকে সেখানে বসবাসকারী ভারতীয়দেরও সেই সুবিধা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

‘সিকিমি’ বনাম ‘ওল্ড সেটেলার্স’

আয়করসংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় সিকিমিদের মধ্যে এতটাই বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে যে বন্‌ধের ডাকে বিরোধী দলের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল সিকিম ক্রান্তিকারী মোর্চাও সমর্থন দিয়েছে। এই রায় সিকিমিদের এককাতারে নিয়ে এসেছে; তাদের মধ্যে প্রতারিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে কেউই চলতি আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে চাইছে না। রাজ্যের একজন মন্ত্রী ইতিমধ্যে রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন।

কিন্তু মুশকিল হলো ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয় এ প্রশ্নে দ্রুত আদালতের রায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা ১৯৭৫-এর আগে থেকে সিকিমে নানান পেশায় থাকা ভারতীয়দের সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ওল্ড সেটেলার্স’ (এওএসএস)-এর প্রতি সহানুভূতিশীল বলে মনে হচ্ছে। সেই অনুযায়ী ২০২৩ সালে আর্থিক বিলে ‘সিকিমি’র সংজ্ঞা পাল্টানো হবে।

এওএসএস ২০১৩ সালে সিকিমিদের মতোই করসুবিধা চেয়ে আদালতে আবেদন জানিয়েছিল। তারই রায় হলো এক দশক পর। স্বভাবত তারা এতে সন্তুষ্ট। সিকিমের ব্যবসাজগতের ৭০ শতাংশ এই ‘ওল্ড সেটেলার্স’রাই নিয়ন্ত্রণ করে। এই ওল্ড সেটেলার্সদের অতীতে সিকিম রাজা তাদের ভারতীয় পাসপোর্ট ছেড়ে সিকিমের নাগরিক হয়ে যেতে বললেও তারা তখন সেটা করেনি। কিন্তু এখন সিকিমিদের দেওয়া বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদার সুযোগ নিয়ে তারা বিপুল আর্থিক সুবিধা আদায় করে নিল।

পর্যটন অর্থনীতির ওপর মোটাদাগে নির্ভরশীল এই রাজ্যটির ৮০ শতাংশ মানুষ ১৯৬১ সালের রেজিস্ট্রারভুক্ত সিকিমি বা তাদের বংশধর। কিন্তু ভারতীয় বংশজাত ব্যবসায়ীদের হাতে রয়েছে অর্থবিত্তের মুখ্য উৎসগুলো। কর রেয়াত–সুবিধার পর তারা রাজ্যের রাজনীতিতে সিকিমি সেসব শক্তিকে মদদ দিতে পারে, যারা তাদের প্রতি বাড়তি সহানুভূতিশীল।

যখন ভূরাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ার বিন্যাস পাল্টাচ্ছে

আন্তর্জাতিক মানচিত্রে যাঁরাই সিকিমের অবস্থান দেখবেন, তাঁরাই বুঝবেন জনপদটা ভূরাজনৈতিকভাবে অতিগুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। এই গুরুত্বের ভার বহন যে স্থানীয় রাজনীতির জন্য সহজ নয়, সেটা ইতিমধ্যে ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ১৩ জানুয়ারির রায়ও তার সেই বিপজ্জনক গুরুত্বের সঙ্গে যুক্ত বিষয় হয়ে থাকতে পারে বলে অনেকের অনুমান।

ভুটানের আশপাশে চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত দ্বন্দ্ব শুরুর পর থেকে সিকিমকে ঘিরে ভারতীয় প্রশাসন ও নীতিনির্ধারকেরা অতিসতর্ক। রাজ্যটির অভ্যন্তরীণ বিন্যাসে পরিবর্তনের আলাপ হয়তো সেই পটভূমিতেই আসছে। রাষ্ট্রীয় রাজস্ব কমে যাবে জেনেও সিকিমে বাড়তি মানুষকে আয়কর থেকে রেহাই দেওয়ায় কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আগ্রহের বিষয়ও সেভাবে বিবেচনা করা যায়।

সিকিমিদের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদার মতোই কাশ্মীরেরও বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা ছিল, যা বিজেপি সরকার বাতিল করেছে। সিকিমিরা হয়তো এসব নজির থেকে উদ্বেগে ভুগে থাকতে পারে। এই উদ্বেগ রাজ্যটিতে যে চাপা উত্তেজনা তৈরি করেছে, তা এখনই বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। অদূর ভবিষ্যতে সিকিমিদের চলতি অসন্তোষের পরিণতি কী হবে, সেটা অনুমান করা না গেলেও ২০২৪-এর বিধানসভা নির্বাচনকালে এর সরাসরি প্রভাব দেখা যাবে।

পর্যটন অর্থনীতির ওপর মোটাদাগে নির্ভরশীল এই রাজ্যটির ৮০ শতাংশ মানুষ ১৯৬১ সালের রেজিস্ট্রারভুক্ত সিকিমি বা তাদের বংশধর। কিন্তু ভারতীয় বংশজাত ব্যবসায়ীদের হাতে রয়েছে অর্থবিত্তের মুখ্য উৎসগুলো। কর রেয়াত–সুবিধার পর তারা রাজ্যের রাজনীতিতে সিকিমি সেসব শক্তিকে মদদ দিতে পারে, যারা তাদের প্রতি বাড়তি সহানুভূতিশীল।

এভাবে সিকিম তার অস্তিত্বের নতুন এক বিন্যাসে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ভূরাজনীতিই নীরবে এই পালাবদল ঘটাচ্ছে। যেভাবে মণিপুরের রক্তপাত ঘটাল মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ।

  • আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক