মতামত

ওএমএসের চালের জন্য ১৮ ঘণ্টা অপেক্ষা ও বেতাল রাজনীতি

সকাল নয়টা থেকে শুরু হয় ওএমএসের পণ্য বিক্রি। পণ্য কিনতে সকাল সাড়ে সাতটা থেকে অপেক্ষা করছেন এই ক্রেতারা। ২৬ নভেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার আরামবাগ মহল্লায়।
ছবি আনোয়ার হোসেন

এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সংগঠিত-অসংগঠিত চারটি জনস্রোত। এর মধ্যে তিনটি স্থায়ী। একটি অস্থায়ী। অস্থায়ী জনস্রোতের কথাটিই আগে বলে নিই। বিশ্বকাপ ঘিরে পাড়ায় পাড়ায় উন্মাদনা চলছে। অনেকে আয়োজন করে বড় পর্দায় খেলা দেখছেন। পছন্দের দল জয়ী হলে উল্লসিত হন তাঁরা। পরাজিত হলে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। বিশ্বকাপ শেষ হলে এই জনস্রোত আর থাকবে না।

বাকি তিনটি জনস্রোত স্থায়ী বলে মনে হয়। একটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো এই জনস্রোতে শামিল হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা সম্মেলন-সমাবেশ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, এটাই আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি। তিনি নৌকা মার্কায় ভোট চাইছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ঘিরে যে আরেকটি জনস্রোত আছে, তারাও সংগঠিত হচ্ছে। নানা বাধাবিঘ্ন ডিঙিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা  ৮টি সমাবেশ করেছেন। আগামী ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে ও ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ করার কথা তাঁদের। সমাবেশের আগেই রাজশাহীতে উত্তপ্ত অবস্থা। পরিবহনমালিকেরা জানিয়েছেন, সমাবেশের আগে ধর্মঘট চলবে। নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলারও অভিযোগ আছে। এদিকে ঢাকার সমাবেশের স্থান নিয়ে বিবাদ দেখা দিয়েছে। সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দিয়েছে। বিএনপি বলছে, নয়া পল্টনে দলীয় অফিসের সামনেই সমাবেশ হবে।

সরকারি হিসাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে ২০ শতাংশ মানুষ। দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি হলে সেই সংখ্যা দাঁড়ায়  প্রায় সাড়ে ৩ কোটি। এই যে বিশাল জনস্রোতের খোঁজ কতটা রাখে  ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ? কতটা রাখে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো? দেশের বৃহত্তর জনস্রোত অর্থাৎ গরিব-দুঃখী মানুষের সঙ্গে  রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। সরকারের সব উন্নয়ন নীতি ও পরিকল্পনায়ও তারা অনুপস্থিত।  

এই দুই জনস্রোতের বাইরে আরেকটি নীরব জনস্রোত দেখা যাচ্ছে ওএমএসের দোকানের সামনে। দরিদ্র ও অভাবী মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন কম দামে চাল ও আটা পাওয়ার আশায়। কম দামে মানে একদা ‘সরকার-প্রতিশ্রুত’ ১০ টাকা কেজি দরের চাল নয়। কম দাম মানে ৩০ টাকা কেজি দরে চাল। আর ২৪ টাকা কেজি দরে আটা। বাজারে ৫৫ টাকার নিচে কোনো চাল নেই। আটার দাম ৬৫ টাকা। যাঁরা গরিব ও স্বল্প আয়ের মানুষ, তাঁদের পক্ষে এই দামে চাল-আটা কেনা সম্ভব নয়। এই গরিবের সংখ্যা কত? সরকারি হিসাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে ২০ শতাংশ মানুষ। দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি হলে সেই সংখ্যা দাঁড়ায়  প্রায় সাড়ে ৩ কোটি। এই যে বিশাল জনস্রোতের খোঁজ কতটা রাখে  ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ? কতটা রাখে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো? দেশের বৃহত্তর জনস্রোত অর্থাৎ গরিব-দুঃখী মানুষের সঙ্গে  রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। সরকারের সব উন্নয়ন নীতি ও পরিকল্পনায়ও তারা অনুপস্থিত।  

সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ। এখানে এক দল ক্ষমতায় গিয়ে সবকিছু নিজের দখলে রাখে। আবার কেউ কেউ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজপথ গরম করেন। কিন্তু দেশের দিন আনা দিন খাওয়া কোটি কোটি মানুষের খোঁজ রাখেন না কেউ। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখন জনসভার স্থান নিয়ে ঝগড়া করছে, তখন দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা খারাপ থেকে আরও খারাপ হচ্ছে।  নেতা-নেত্রীরা বাসে-ট্রেনে চলেন না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে চড়েন। ঢাকা শহরের মোড়ে মোড়ে তাদের গাড়ি যখন সিগনালে থেমে যায়, তা্রা কি কাচ নামিয়ে একটু দুই পাশে তাকিয়ে দেখেছেন, রাস্তায় হঠাৎ ভিক্ষাপ্রার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। নেতা-নেত্রীরা গরিব মানুষকে গ্রামে গিয়ে কাজ করার সুপরামর্শ দেন। কিন্তু গ্রামে যদি কাজের সুযোগ না থাকে, তা্দের না খেয়ে মরতে হবে। এ কারণেই ওএমএসের দোকানের সামনে লম্বা লাইন। এ কারণেই রাস্তার মোড়ে মোড়ে নিরন্ন মানুষের ভিড়।

২৬ নভেম্বর প্রথম আলোর চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেনের প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার আরামবাগ মহল্লায় ওএমএসের চাল-আটা নিতে নারীদের মধ্যে কেউ কেউ ১৮ ঘণ্টা অপেক্ষার পর (বুধবার বিকেল থেকে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা পর্যন্ত) পেলেন শুধু আটা। চাল না পেয়ে কষ্ট নিয়েই বাড়ি ফিরেছেন অনেকে। অনেকে আবার চাল বা আটা কোনোটাই পাননি। ওই এলাকার ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধ মাজিয়া বেগম বলেছেন, ‘আগের দিন বিক্যাল থাইক্যা লাইনে দাঁড়ালছিনু। সারা রাত জাইগ্যা মশার কামড় খাইয়্যা পরদিন দুপুর ১২টার দিকে পাঁচ কেজি আটা পাইয়্যাছি। চাল পাইনি। যারা আগেই লাইনে ছিল, তারা কেহু কেহু চাল-আটা দুটাই প্যাইয়্যাছে। বাড়িতে বেটির্জা জালসা শুনতে আসবে। তাই এ আটার মধ্যে থাইক্যা আরেকজনকে আড়াই কেজি আটা দিয়্যা আড়াই কেজি চাল বদলাইয়্যা লিয়্যাছি। এতে দুদিন চালাইতে হবে।’ লাইনে দাঁড়ানো কেউ কেউ চাল পেয়েছেন, কেউ আটা পেয়েছেন। আবার কেউ শূন্য হাতে ফিরে গেছেন।

আরামবাগ মহল্লায় কাঁসা-পিতলশিল্পের শ্রমিকদের বসবাস বেশি। গত বৃহস্পতিবার সকাল নয়টায় ওই মহল্লায় ওএমএসের চাল-আটা বিক্রি করার কথা। তা কিনতে স্বল্প আয়ের মানুষ বুধবার বিকেল থেকে লাইনে দাঁড়ান। শীতের মধ্যে সারা রাত লাইনে থেকে সকালে নানা ঝক্কিঝামেলার পর সরকার নির্ধারিত ৩০ টাকা কেজি দরে চাল ও ২৪ টাকা কেজি দরে আটা কেনেন তাঁরা। নারীরা আগের দিন বিকেলে বা রাতে ওএমএসের লাইনে এসে দাঁড়াচ্ছেন। বুধবার রাত সোয়া ১০টার দিকে আরামবাগ মহল্লায় গিয়ে ওএমএস ডিলার নুরুল ইসলামের গুদামের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে রাস্তার ওপর খোলা জায়গায় বসে বিভিন্ন বয়সী নারীদের বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল। শীত মোকাবিলায় তাঁরা গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে ছিলেন।

এই হলো ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশ। এই চিত্র কেবল চাঁপাইনবাবগঞ্জের নয়, সারা দেশের। কোথাও ৬ ঘণ্টা, কোথাও ১২ ঘণ্টা মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন কম দামে ওএমএসের চাল বা আটা পেতে। শেষের তিনটি জনস্রোত বিশ্লেষণ করলে আমরা কী দেখতে পাই? প্রথম জনস্রোত; অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মনে করেন, ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা তাঁদের দায়িত্ব। দ্বিতীয় জনস্রোতের নেতা-কর্মীদের দাবি, ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ।’ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করতে হবে।

কিন্তু এই যে দুই জনস্রোত, এদের কারও সঙ্গেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের বা দেশের অন্যান্য স্থানে টিসিবির ডিলারের দোকানের সামনে ওএমএসের লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর সম্পর্ক নেই। প্রথম দুই জনস্রোত যখন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা ও ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য চূড়ান্ত যুদ্ধ বা ফাইনাল খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন ওএমএসের দোকানের সামনে নারী-পুরুষ বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। কোথায় কত সম্মেলন করল, কে সমাবেশ করল, তা নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির নেতা-কর্মীদের কাছে ওএমএসের চালের জন্য লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর কোনো দাম নেই। আগে পাঁচ বছর পরপর ভোটের জন্য তাঁদের কাছে  নেতা-নেত্রীরা যেতেন, এখন তারও প্রয়োজন হচ্ছে না।

২৬ নভেম্বর সহকর্মী মনোজ দে লিখেছেন, ‘ফুটবল উন্মাদনার দিনে ওএমএস লাইনে অসহায় মুখের মিছিল।’ ফুটবল উন্মাদনা চলে গেলেও এই মিছিল থাকবে। আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাঁদের কেবল সংখ্যা হিসেবে দেখে, মানুষ হিসেবে নয়।
বাংলাদেশ সব মানুষের রাষ্ট্র কবে হবে?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি