প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৪ আগস্ট তাঁর দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকের সময় বলেছিলেন, বিরোধী দল বিক্ষোভ করলে, সমাবেশ করলে তাঁদের যেন ‘ডিস্টার্ব’ করা না হয়। সেই মর্মে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের বিরোধী দল একটা সুযোগ পাচ্ছে, তারা আন্দোলন করবে, করুক। আমি আজকেও নির্দেশ দিয়েছি, খবরদার, যারা আন্দোলন করছে, তাদের কাউকে যেন গ্রেপ্তার করা না হয় বা ডিস্টার্ব করা না হয়। তারা প্রধানমন্ত্রীর অফিসও ঘেরাও দেবে, আমি বলেছি, হ্যাঁ আসতে দেব।’ (প্রথম আলো, ১৪ আগস্ট ২০২২)। এই নির্দেশ তিনি কাকে দিয়েছিলেন তা আমরা জানি না, তবে অনুমান করা যায়, সেই নির্দেশ ছিল পুলিশ এবং সিভিল প্রশাসনের উদ্দেশে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। রাষ্ট্রীয় ভবনে অনুষ্ঠিত দলের সভায় তাঁর এই নির্দেশ দেওয়ার কথা কেন উল্লেখিত হলো, সেটা নিশ্চয়ই আমাদের বিবেচনা করা দরকার।
বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকের সভা-সমাবেশের অধিকার নিরঙ্কুশভাবে দেওয়া আছে। আলাদা করে কেন নির্বাহী বিভাগের প্রধানকে এই নির্দেশ দিতে হবে, সেটা নিশ্চয়ই নাগরিকদের প্রশ্ন করার অধিকার আছে। ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণের, এক ব্যক্তির শাসনের এটি হচ্ছে একটি উদাহরণমাত্র। এ ধরনের উদাহরণ এখন প্রতিদিনই পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর তাঁর দলের নেতা-নেত্রীরা ক্রমাগত হুমকি দিয়েছেন যে তাঁরা দেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপিকে ‘রাজপথ দখল করতে’ দেবেন না। এতে করে এমনই প্রতীয়মান হয় যে বিরোধী দলকে মোকাবিলা করার দায়িত্ব তাঁরাই নিয়েছেন।
এই সব আলোচনার প্রেক্ষাপট হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং নাগরিকদের অভাবনীয় দুর্ভোগ। এক বছরের বেশি সময় ধরে ক্রমাগতভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ার কারণে দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন এবং তার অনুগতরা এক জৌলুশময় জীবন যাপন করছেন। দেশের অর্থ পাচারে রেকর্ড হয়েছে। লুটপাটের মাত্রা আগের যেকোনো সময়কে ছাড়িয়ে গেছে। এ সময় লোডশেডিং, জ্বালানির অব্যবস্থাপনা ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটতে শুরু করে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণে ৩১ জুলাই ভোলায় বিএনপির মিছিলে গুলিতে মারা যান দুই কর্মী। অন্যত্রও বিক্ষোভ ঘটে, সব বিরোধী দলই এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি দিতে শুরু করে। সে সময় সরকার অকস্মাৎ জ্বালানির দাম বাড়ায় ৫ আগস্ট মধ্যরাতে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে নাটকীয়ভাবে। এই দুর্বিষহ অবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের প্রেক্ষাপটে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সমাবেশ, মিছিলের ডাক দেওয়া হয়। দেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিও সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের সমাবেশের আয়োজন করে। সেই সব সমাবেশে পুলিশের হামলা, কর্মীদের আটকের ঘটনা ঘটতেই থাকে। এই প্রেক্ষাপটেই প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বলেছিলেন, তাঁর সরকার বিরোধীদের ‘ডিস্টার্ব’ করবে না।
গত দুই সপ্তাহের ঘটনা দেখায়, কী করে নাগরিকের অধিকার শক্তির মাধ্যমে দমানো হচ্ছে। এসব হামলা বিএনপির বিরুদ্ধে হচ্ছে বলে যাঁরা মনে করছেন যে এগুলো নিয়ে কথা না বলাই ভালো, যেহেতু তিনি বিএনপি করেন না, তাঁরা আদৌ নাগরিকের অধিকার বোঝেন কি না সেটাই ভাবার বিষয়। নাগরিকের অধিকার ‘দেওয়া-থোয়ার’ বিষয় নয়, কোনো একক দলেরও বিষয় নয়।
কিন্তু গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে সারা দেশে যা ঘটছে, তা প্রায় অভাবনীয়। বিএনপির সমাবেশ বা মিছিলেই শুধু যে হামলা হয়েছে, তা–ই নয়, নেতাদের বাড়িঘরে, তাঁদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলা হয়েছে। আটকের সংখ্যা হিসাবের উপায় নেই। এসব হামলায় পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত আছেন আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা, যাঁদের কেন্দ্রীয় সংগঠকদের গণভবনে ডেকে নিয়ে দলের নেত্রী বলেছিলেন তিনি ‘ডিস্টার্ব’ না করার নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশের মর্মবাণী পুলিশ এবং কর্মীরা বুঝতে পেরেছেন বলেই যদি অনুমান করি, তবে তা ভুল হবে কি? অন্যথায় গত দুই সপ্তাহে এই পরিস্থিতির সূচনা হতে পারে কি না, সেটা চিন্তা করতে পারেন।
সংবাদপত্রের হিসাব অনুযায়ী ২২ থেকে ২৭ আগস্ট সারা দেশে বিএনপির অন্তত ১৯টি সমাবেশে হামলা হয়েছে। আট জায়গায় বিএনপি নেতাদের বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। অন্তত ৬ জায়গায় পুলিশ বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেয়নি। এগুলো হচ্ছে যা জানা গেছে। অনেক জায়গায় হামলার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জে বিএনপি আয়োজিত মিছিল পুলিশ ভেঙে দিতে চাইলে সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে শাওন প্রধান নামের এক তরুণ নিহত হয়েছেন, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ২৬ জন। গণমাধ্যমের সূত্রে পাওয়া সংবাদে দেখা যায়, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি নিক্ষেপ করেছে এবং তাতে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়েই শাওন মারা গেছেন।
বিএনপির এসব সমাবেশে হামলার পাশাপাশি অন্যদের ওপরও হামলা হচ্ছে। সংবিধানে যে অধিকার দেওয়া আছে, তা গত কয়েক বছরে অপসৃত; সভা, সমাবেশ ও মত প্রকাশের অধিকার এখন ‘দেওয়ার বিষয়ে’ পরিণত হয়েছে। নির্বাহী বিভাগের প্রধান নির্ধারণ করেন, তিনি কোন অধিকার দেবেন আর কোন অধিকার দেবেন না। বিভিন্ন ধরনের চাপের মুখে সরকার এখন দেখাতে চাইছে যে দেশে সমাবেশের অধিকার আছে, সরকার সম্ভবত এটাও দেখাতে চান যে আগামী বছর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মতো অবস্থা দেশে আছে।
কিন্তু গত দুই সপ্তাহের ঘটনা দেখায়, কী করে নাগরিকের অধিকার শক্তির মাধ্যমে দমানো হচ্ছে। এসব হামলা বিএনপির বিরুদ্ধে হচ্ছে বলে যাঁরা মনে করছেন যে এগুলো নিয়ে কথা না বলাই ভালো, যেহেতু তিনি বিএনপি করেন না, তাঁরা আদৌ নাগরিকের অধিকার বোঝেন কি না সেটাই ভাবার বিষয়। নাগরিকের অধিকার ‘দেওয়া-থোয়ার’ বিষয় নয়, কোনো একক দলেরও বিষয় নয়।
বিরোধীদের দমনের জন্যে শক্তি প্রয়োগের এই ভয়াবহ প্রবণতার সূচনা আজকে হয়নি। কয়েক বছর ধরেই এমন এক অবস্থার সূচনা করা হয়েছে, যেখানে সরকারের বিরোধিতাকে একধরনের অপরাধ বলেই গণ্য করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই বৈধ ও আইনানুগ কার্যক্রমকে ক্ষমতাসীনরা ‘ষড়যন্ত্র’ বলে বর্ণনা করেন। সরকারের বিরোধিতাকে রাষ্ট্রবিরোধী বলে বর্ণনা করা তো এখন হরহামেশাই ঘটছে। এ রকম একটা প্রেক্ষাপটে এই অব্যাহত হামলা কেবল বিএনপির জন্য বার্তা নয়, এই বার্তা সব রাজনৈতিক দলের সব কর্মীর জন্য। আজও তার বিরুদ্ধে কথা না বলার, নিষ্ক্রিয়তার একটাই পরিণতি হবে। তা থেকে কেউ বাদ যাননি, যাবেন না।
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট