রক্তাক্ত জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের এক মাস পর বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভেতরে দেখা গেল এক সহিংস ঘেরাও কর্মসূচি। দেখা গেল, জেলা প্রশাসক না হতে পারা এক দল সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তার হতাশার বহিঃপ্রকাশ।
ক্ষুব্ধ জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা আক্রমণ করেন দুজন যুগ্ম সচিবকে, যাঁরা কদিন আগেই বঞ্চিতদের দলে ছিলেন। জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে পদায়নের বিষয় এই দুজনের চূড়ান্ত কর্তৃত্বে ছিল, এমনও নয়।
প্রাপ্তিযোগ-সংক্রান্ত এই অসন্তোষ বিপ্লবের অংশ—এটাও বলা যাবে না। তবু বদলি, পদায়নে কোনো অসামঞ্জস্য হয়ে থাকলে তার ধারাবাহিক সমাধান সম্ভব ছিল এবং আছেও। সহিংসতা যদি দাবি আদায়ের উত্তম পন্থা না হয়ে থাকে, তাহলে এই সমাধান ক্যাডার সার্ভিসের প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে। শান্তিপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমেও এই সমাধানের রাস্তা আছে।
তাহলে জনপ্রশাসনে এই অস্থিরতা কী নির্দেশ করে? বিশেষ করে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী জামানায় পদ-পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে দলাদলি থেকে আমরা কী বুঝব? তাঁদের এসব কর্মকাণ্ড কার পক্ষে যায়?
এখন তো সময় শান্তি ও সুশাসন নিশ্চিত করে সাড়ে ১৫ বছরের জঞ্জাল পরিষ্কার এবং নতুন বাংলাদেশ গড়ার ভিত্তি রচনা করার। রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও পুনর্গঠনের সঙ্গে সঙ্গে একেকজন নাগরিককে যোগ্য, ক্ষমতাবান ও মর্যাদাশীল করে তৈরি করতে পারলেই শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না।
অন্যদিকে দেখুন, সচিবালয়ের এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কাটতে না কাটতেই হাজার দিকে হাজারো দাবিনামা নিয়ে হাজার জন হাজির হচ্ছে। দেখুন তো, এর সঙ্গে শিল্পাঞ্চলে সহিংস আন্দোলনের চেহারার কোনো মিল পাচ্ছেন কি না?
বিপ্লব মানে যাকে তাকে ধরে অপদস্থ করা নয়। আবার আমার সঙ্গে খাতির বা যোগাযোগ আছে বলে স্বৈরাচারী সরকারের অপকর্মের সহযোগীদের পুনর্বাসন করব, সেটাও নয়।
বিপ্লব কেবল একটি আমলাতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষের কাছে বর্গা দেওয়ার জিনিসও নয়। সামাজিক ও রাজনৈতিক মালিকানা ব্যতীত বিপ্লব দীর্ঘমেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় না।
বিপ্লবকে বেহাত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে ছাত্রদের পাশাপাশি দায়িত্বশীল সামাজিক নেতৃত্বের নিয়মিত নজর রাখা দরকার। রাজনীতিকদের সুচিন্তিত বক্তব্য থাকা দরকার। এতে সরকারি কর্মকাণ্ড বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।
পতিত সরকারের রক্ষক, ভক্ষক ও চামচারা পরিষ্কারভাবে চায় ইউনূস সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে। নিদেনপক্ষে কলঙ্কিত করতে। সেটা তাদের প্রতিবিপ্লবের (অপ) চেষ্টা। কারণ, তারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে নৈতিকভাবে পরাজয়বরণ করেছে।
তবে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সরকারের সহযোগী শক্তি এবং জাতির বিবেকেরা কি খেয়াল রাখছেন, দেশের কোন কোন খাতে কারা, কীভাবে, কোথায়, কখন অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে সচেষ্ট রয়েছে?
জনরোষের মুখে পালিয়ে যাওয়া জবরদখলকারী শাসক শেখ হাসিনাকে একটি অডিওতে বলতে শোনা যাচ্ছে, তিনি এখনো দেশের প্রধানমন্ত্রী! তাঁর লোকেরা কৃতকর্মের জন্য কোনো অপরাধবোধ না দেখিয়ে বরং সামাজিক মাধ্যমে বিষ ছড়াচ্ছে, সন্ত্রাসে উসকানি জোগাচ্ছে।
বিপ্লবের সমর্থকদের এক বা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশই যেন ভুলে বসেছেন বিপ্লবের সাধারণ শত্রুকে, নির্বিকার রয়েছেন প্রতিবিপ্লবের শঙ্কা নিয়ে।
ইতিহাসের কিছু ছাত্রও ভুলে যান, প্রতিবিপ্লব শুধু পরাজিত শক্তিরাই সংঘটিত করে না। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, চীনের কমিউনিস্ট বিপ্লব এবং ইরানি ইসলামি বিপ্লবের পর অতি উৎসাহী, সুবিধাবাদীদের ভূমিকা সংশ্লিষ্ট বিপ্লবের ঘোষিত উদ্দেশ্যকে কিছু ক্ষেত্রে লাইনচ্যুত করেছিল।
১৯৭১-পরবর্তীকালে অতি মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়াবাড়ি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং ১৯৯০-এর পর সংঘাতময় রাজনীতি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক যাত্রাকে পথহারা করেছে।
এখন বিপ্লবের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিদের মধ্যে ‘কামড়া কামড়ি’ এবং জনসমক্ষে কুতর্কে লিপ্ত হওয়া শুধু হাসিনা শাসনের দুর্নীতি ও হত্যাকাণ্ডের সাফাই এবং অগণতান্ত্রিক যুক্তিকে শক্তিশালী করবে।
তাই শুধু ইউনূস সরকার নয়, সমাজের যেকোনো গোষ্ঠী ও ব্যক্তির দায়িত্ব আগামী বাংলাদেশ নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। এখন ‘গাঁয়ে না মানলে’ও আপনিই ‘মোড়ল’।
এবারের বিপ্লব একটি মাত্র রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর আদর্শের ভিত্তিতে এবং তার নেতৃত্বে রচিত এবং পরিচালিত হয়নি সত্য। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটি জন ঐক্য একটি পর্বতপ্রমাণ দুঃশাসনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে।
বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, খুনের প্রতিবাদ, পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার মধ্যে আকাঙ্ক্ষার ঐকমত্য গড়ে উঠেছিল যার পেছনে ছিল রাজনৈতিক সমর্থন ও প্রচেষ্টা। অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি, হাসিনা সরকার হঠাৎ এভাবে পড়ে যাবে।
১৯৭০-এর দশকে আলমগীর কবির পরিচালিত ‘সীমানা পেরিয়ে’ ছবিতে ভুপেন হাজারিকার গাওয়া একটি গানের কথা অনেকের পরিবর্তনের স্বপ্নকে ধারণ করত: ‘পুরনো সব নিয়ম ভাঙে অনিয়মের ঝড়/ ঝোড়ো হাওয়া ভেঙে দিল মিথ্যে তাসের ঘর/ নূতন মাটিতে আসে ফসলেরই কাল/ আঁধার পেরিয়ে আসে আগামী সকাল’।
আমাদের বুঝতে হবে, ফ্যাসিবাদী শাসনের মিথ্যা তাসের ঘর ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। সেখানে এখন কেমন ঘর বানাতে হবে তা বাংলাদেশকেই ঠিক করতে হবে।
খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক