মতামত

খাদ্য আমদানিতে বাংলাদেশ কেন তৃতীয়?

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) গত ২৩ ডিসেম্বর ঘোষণা করেছে, বিশ্বে খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে চীন ও ফিলিপাইনের পর বাংলাদেশের অবস্থান। জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ জনসংখ্যার এই দেশ বড় জনসংখ্যার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। লুক্সেমবার্গ ও সিঙ্গাপুরের মতো সিটি স্টেটকে বাদ দিলে। তাই মনে হতে পারে, এ খবরের মধ্যে অবাক হওয়ার কিছু নেই। 

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ইউরাল আলেক্সিস জনসন নামের যুক্তরাষ্ট্রের একজন কূটনীতিক বাংলাদেশ ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন। তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের তদানীন্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তাতে সায় দিয়েছিলেন। এই অপমানজনক অভিধা প্রদানের জন্য সমালোচকদের দোষ দেওয়া যাবে না। কারণ, তখন বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের ঘাটতি ছিল। ওই সময় আমাদের চাল লাগত ১ কোটি ৫৫ লাখ টন, কিন্তু আমরা উৎপাদন করতে পারতাম মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন। বাকি ৪৫ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায় ঘাটতি পূরণের জন্য বিশ্বের দাতাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে খাদ্য সাহায্যের জন্য ভিক্ষার হাত পাতা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। 

বিংশ শতাব্দীর সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের এহেন খাদ্য সাহায্যনির্ভরতা মারাত্মক পর্যায়ে ছিল। ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে আমরা ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিলাম প্রথমবারের মতো, কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আওয়ামী লীগের কৃষিনীতি পরিত্যাগ করে। দেশে আবার খাদ্যঘাটতি দেখা দেয়। উপরন্তু বিএনপি-জামায়াত সরকারের খাদ্য মজুত মারাত্মকভাবে কমিয়ে ফেলার ভুল নীতির কারণে ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশ মারাত্মক খাদ্যঘাটতির ঝুঁকিতে পড়ে গিয়েছিল। ওই সময় সরকার মরিয়া হয়ে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করার প্রয়াস চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ, কোনো দেশ সম্ভাব্য ঘাটতি সৃষ্টির ভয়ে খাদ্যশস্য রপ্তানি করতে রাজি হয়নি। 

দেশে ওই সময় প্যানিক বায়িং (আতঙ্কিত হয়ে কেনাকাটা) পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও কোনোমতে দুর্ভিক্ষাবস্থা এড়ানো গিয়েছিল। এরপর ২০০৯ সালে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দুই বছরের মধ্যে দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছিল ২০১১ সালে। এরপর গত ১২ বছরের মধ্যে ২ বছর ছাড়া ১০ বছর দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে চলেছে কিংবা উদ্বৃত্ত ধান উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছে। 

আরেকটি সাধারণ ধারণা রয়েছে, গুঁড়া দুধের ওপর আমাদের নির্ভরতাও কমানো যাবে না। গুঁড়া দুধকে শিশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহারের সংস্কৃতি এখনো দেশে গেড়ে বসে আছে, মায়ের দুধ না খাওয়ানো মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় ‘ফ্যাশনে’ পরিণত হয়েছে। ‘মিষ্টি সংস্কৃতি’ একটি অপসংস্কৃতি।

কৃষি খাতের এই সাফল্য বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস বইয়ে দিচ্ছে। বলতে গেলে দেশে একটি কৃষিবিপ্লব চলমান। গত ৫০ বছরে ধান উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৯২ লাখ টনে, ভুট্টা ও গমের উৎপাদন যোগ করলে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ টন। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছেছে। শাকসবজি, হাঁস-মুরগির, মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এখন প্রায় প্রতিবছর মোটা ধান উদ্বৃত্ত হচ্ছে আমাদের (অবশ্য প্রতিবছর আমরা ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টন গম আমদানি করি)। দুধ উৎপাদনে দেশে এখনো ঘাটতি রয়ে গেলেও গরু-মহিষের মাংস উৎপাদনে আমরা স্বয়ম্ভরতার দ্বারপ্রান্তে।

পবিত্র ঈদুল আজহার সময় অতীতে চোরাচালানে আসা ভারতীয় গরু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এখন তার প্রয়োজন হয় না, বরং ২০২৩ সালের ঈদুল আজহার সময় কোরবানির গরু উদ্বৃত্ত ছিল। আম, আনারস, কলা, পেয়ারা ও কাঁঠালের মতো কয়েকটি প্রধান ফল উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। উচ্চফলনশীল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, সেচব্যবস্থার আওতায় আসায় দেশের অধিকাংশ জমিতে বোরো চাষের সম্প্রসারণ, যথাযথ ভর্তুকি প্রদান, কৃষিঋণ পদ্ধতির সহজীকরণ, ফসলের বহুধাকরণ, কৃষির লাগসই যান্ত্রিকীকরণ, উচ্চফলনশীল ফসল, তরিতরকারি, মাছ, হাঁস-মুরগি ও ফলমূল চাষের ব্যাপক প্রচলন, রাসায়নিক সার, বীজ ও কীটনাশকের সহজলভ্যতা ইত্যাদি কৃষি খাতের উল্লেখযোগ্য সাফল্য।

উল্লিখিত সাফল্যগুলোকে খাটো না করেও স্বীকার করতে হবে যে খাদ্য আমদানিতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ আমদানিকারক হওয়া বাংলাদেশের জন্য একান্তই স্বাভাবিক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানাচ্ছে, বাংলাদেশে মোট ৯ কোটি ৩৩ লাখ টন কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদিত হচ্ছে আর ১ কোটি ২৫ লাখ টন খাদ্য আমদানি করছে। 

২০২০ সাল পর্যন্ত খাদ্যের মোট চাহিদার ৯ দশমিক ৩ শতাংশ আমদানি করা হতো, ২০২২ সালে খাদ্য আমদানি চাহিদার ১১ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছে গেছে। জনগণের মাথাপিছু জিএনআই বাড়ার কারণে বাজার থেকে খাদ্য কেনার সক্ষমতা এই তিন বছরে বেড়েছে, তেমনি দেশের খাদ্য আমদানির আর্থিক সক্ষমতাও বেড়েছে। 

আমরা গম, ভোজ্যতেল ও গুঁড়া দুধ আমদানির জন্য সর্বোচ্চ ব্যয় করে থাকি। মসলাপাতি, ডাল ও ফল আমদানি বাংলাদেশে অপরিহার্য। আমাদের গম উৎপাদন বেশি বাড়ানোর সুযোগ নেই, কিন্তু মানুষের আয় বাড়ার কারণে ময়দা থেকে উৎপাদিত বাজারের নানা খাদ্যপণ্য ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। অতএব, ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টন গম আমদানি করতে হচ্ছে আমাদের। 

বোরো ধান এখন আমাদের ধান উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশে পৌঁছে গেছে, যা শুষ্ক মৌসুমের ধান। এ কারণে শর্ষের মতো ভোজ্যতেলের বীজ উৎপাদনের জমি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে বোরো ধান উৎপাদনের জন্য। আমাদের শৈশবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান শর্ষে উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল, কিন্তু উচ্চফলনশীল বোরো ধান উৎপাদন ক্রমেই বিস্তৃত হওয়ায় ষাটের দশক থেকে ভোজ্যতেল আমদানির ওপর আমাদের নির্ভরতা বাড়তে শুরু করেছিল। 

এখন আমাদের ভোজ্যতেলের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। মানুষের আয় বাড়ার কারণে ভোজ্যতেলের ব্যবহারও বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। কিন্তু আমি মনে করি, সরকার অগ্রাধিকার দিয়ে প্রণোদনা দিলে আবার শর্ষে উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন অসম্ভব হবে না।

কুমিল্লা, বগুড়া, দিনাজপুর ও যশোরে আমন ধান কাটার পর বোরো ধান লাগানোর আগে শর্ষে চাষের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। এ জন্য বোরো ধান লাগানো ১৫ দিনের মতো পিছিয়ে দিতে হলেও তাতে বোরো ধানের উৎপাদনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এসব জেলায় যদি শর্ষে উৎপাদন কারিগরিভাবে সম্ভব হয়, তাহলে অন্যান্য জেলায় শর্ষে উৎপাদনের জন্য সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসূচি গ্রহণ করছে না কেন? 

আরেকটি সাধারণ ধারণা রয়েছে, গুঁড়া দুধের ওপর আমাদের নির্ভরতাও কমানো যাবে না। গুঁড়া দুধকে শিশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহারের সংস্কৃতি এখনো দেশে গেড়ে বসে আছে, মায়ের দুধ না খাওয়ানো মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় ‘ফ্যাশনে’ পরিণত হয়েছে। ‘মিষ্টি সংস্কৃতি’ একটি অপসংস্কৃতি। অতীতে যখন দেশ দুধ উৎপাদনে উদ্বৃত্ত অবস্থানে ছিল, তখন উদ্বৃত্ত দুধ সংরক্ষণের প্রযুক্তি হিসেবে মিষ্টি উৎপাদন ও ব্যবসার প্রয়োজনীয়তা ছিল। কিন্তু এখন আধুনিক বিদ্যুৎনির্ভর প্রযুক্তি দুধ সংরক্ষণকে সহজলভ্য করে দিয়েছে। তাই এখন মিষ্টি-সংস্কৃতিকে নিরুৎসাহিত করা সমীচীন মনে করি। 

সর্বোপরি, দেশের গরুর উন্নত জাত পালন করাকে অগ্রাধিকার দিলে যে দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব, সেটা সফলভাবে দেখিয়েছে ভারত। আমরা ভারতের মডেলকে গ্রহণ করছি না কেন? 

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক