এভাবে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা সম্ভব?

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আমাদের পরের সমস্যা ডলার রিজার্ভ। আর এই দুই সমস্যা কাটানোর জন্য আমাদের সমাধান হওয়া উচিত ছিল নিজেদের সামর্থ্য বাড়ানো। এই সামর্থ্য বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় দেশীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের নীতিমালা একমুখী হওয়া উচিত। কিন্তু তা না হয়ে গত ১৫ বছরে দেশ আরও আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে এবং আমাদের দেশীয় ব্যবসা চলে গেছে অলিগার্কদের হাতে। আমাদের স্বনির্ভরতার জন্য আসলে কোথায় কোথায় সাহায্য দরকার?

কৃষি খাত

আমাদের কৃষি খাত পুরোপুরি আমাদের কৃষকদের ওপর নির্ভরশীল, আর যাঁরা বেশির ভাগই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর হ্যাঁ, এত দিন পর্যন্ত সফলভাবে তাঁরা করতে পেরেছেন। কিন্তু আমাদের উৎপাদিত দ্রব্যের দাম কেন অন্য দেশের তুলনায় বেশি, এটা নিয়ে কি কোনো গবেষণা হয়েছে?

দেশে কৃষি নিয়ে মন্ত্রণালয় আছে এবং দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আছেন। আছে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা ইনস্টিটিউট। কিন্তু তাদের কাজের কি জবাবদিহি ও সমন্বয় আছে?

আমাদের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মাসে কয়টা গ্রামে গিয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেন? পরিবেশ বদলে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় বদলে যাচ্ছে মাটির গুণাগুণ। দেশে প্রায় ৩৯টি মৃত্তিকা গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে, যাদের কাজ মাটির গুণাগুণ বিশ্লেষণ করে কোন ফসলের উপযোগী জানানো। এই তথ্য কি আমাদের কৃষকদের কাছে আছে? তাঁদের কীভাবে এই সুবিধা নিতে হবে, তা জানানোর কাজ কার? তাঁরা কি মোবাইল অ্যাপ বা ওয়েবসাইট দেখে শেখার মতো? তা–ও যা পয়সা খরচ করে বানানো হয়েছে, তা কি মানসম্পন্ন?

সারা বিশ্বে কৃষিতে অনেক নতুন প্রযুক্তি এসেছে। তার কয়টা আমাদের কৃষকের কাছে যাচ্ছে? এর মধ্যেও কেউ কেউ ফসলের চক্র বাড়িয়ে দুইয়ের জায়গায় তিন থেকে চার ফসল করছেন। কিন্তু তা কত শতাংশ? বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারি ওয়েবসাইটেও কোনো উপাত্ত খুঁজে পাওয়া যায় না।

এ ছাড়া এখন আরও খারাপ হয়ে আসছে—বিদ্যুৎ, সার, কীটনাশকের দাম বাড়ছে এবং বিদ্যুতের অপ্রতুলতা। ফলে ডিজেল দিয়ে সেচ দিতে হচ্ছে। শিক্ষা না থাকার বড় সমস্যা—এই যে এ কারণে যে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, তাও আমাদের কৃষকেরা জানেন না। পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, অতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ সবকিছুরই ক্ষতি করছে। তার থেকে বেশি ক্ষতি করছে ভবিষ্যতের।

বিবিসি বাংলা একটা চমৎকার প্রতিবেদন করেছে যে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম সারির হলেও আমাদের ভারত, মিয়ানমার থেকে মাছ আমদানি করতে হয়। কারণ, খরচ কম পড়ে। তারা কীভাবে কম খরচে উৎপাদন করতে পারে? তাদের আবহাওয়া তো আমাদের মতোই। শেষবার মিয়ানমার ভ্রমণে তাদের কৃষিজাত পণ্যের দাম দেখে মনে হচ্ছিল, দুই স্যুটকেস ভর্তি করে সব নিয়ে এলেও আমার পরের বারের টিকিটের টাকা হয়ে যেত।

এদিকে দুষ্টচক্রের জন্য কৃষকেরা সঠিক মূল্য পাচ্ছেন না। সরকার কিছু হলেই  আমদানি করে। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করার কোনো চেষ্টাই নেই। দেশে বিরোধী দলের কেউ কিছু করলে সরকার জেনে যায়, তাহলে সিন্ডিকেট কারা গড়ে তোলে সেটা তো তাদের অজানা থাকে কি করে?

বাংলাদেশের মন্ত্রীরা মাঝেমধ্যেই দুর্ভিক্ষের কথা বলেন। ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র খাদ্যসহায়তা আটকে দেওয়ায় রেকর্ড উৎপাদন সত্ত্বেও সেই দুর্ভিক্ষ আটকানো যায়নি। খেয়াল করে দেখবেন, এর কারণ পরনির্ভরশীলতা ও তৎকালীন কর্মকর্তাদের ব্যবস্থাপনা ঘাটতি। তা ছাড়া মজুতদারি ভাঙতে না চাওয়া আসলে আমাদের এই ক্ষতির মধ্যে ফেলে।

কৃষি নিয়ে নিয়োজিত কর্মকর্তারা ও গবেষকেরা যদি এসিরুম থেকে বের হয়ে মাঠপর্যায়ে নামতে পারেন তাহলে হয়তো খাদ্য আমদানিকারক দেশ থেকে রপ্তানিকারক হতে আসলে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না।

শিল্প খাত

আমার প্রায়ই আফসোস হয়, এত এত টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেল, ওই সব টাকা যদি দেশে বিনিয়োগ করা যেত, দেশ আজ কোথায় থাকত! এদিকে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দেশে ব্যবসার পরিবেশ নেই। গ্যাস, বিদ্যুতের অপ্রতুলতা, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, সব জিনিসের অতিরিক্ত দাম এবং আমদানি করলে খরচ কম পড়ে, তাই তাঁদের বিনিয়োগে আগ্রহ কমিয়ে দেয়।

২০০৬ সালে যেখানে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের র‍্যাঙ্কিং ছিল ৬৫, এত এত উন্নয়নের পরও এখন তা ১৬৮। ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসা সহজ করার দায়িত্ব কার? পাচার করা টাকাও ফেরত নিয়ে আসার দায়িত্ব কার?

বাংলাদেশের মানুষ যদি দেশের বাইরের পণ্যের বদলে দেশি পণ্য কেনার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হয় সে ক্ষেত্রে জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের পণ্য কি সেই বাজার ধরার জন্য প্রস্তুত? গত দুই মাসে দেশীয় পণ্য উৎপাদনকারীদের ব্যবসা বেড়েছে বলে শোনা যায়।

এই বাস্তবতায় ব্যবসায়ীদের উচিত সেই বাজার ধরে রাখার এবং নিজেদের মার্কেট শেয়ার বাড়ানোর চেষ্টা করা। দেশীয় উৎপাদকেরা যদি দামে কম এবং ভালো মানের পণ্য দিতে পারে তাহলে এই বিশাল বাজার নিতে পারবেন না?

তা ছাড়া বৈধ ও অবৈধভাবে অনেক বিদেশী নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করেন, সেখানে যদি যোগ্য বাংলাদেশীদের নেওয়া যায় এবং বাংলাদেশীদের কর্মীদের যদি দক্ষ ও যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার নীতি নেওয়া যায় তা হলে পর্যায়ক্রমে বিদেশি নির্ভরতা কমানো যাবে। এ ধরণের উদ্যোগ নেওয়া গেলে এখনকার নিশ্চলতাস্ফীতি কমানো ও দেশের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা এবং পরিচালন ব্যয়ও কমানো সম্ভব হবে।

দেশে এত এত বিশ্ববিদ্যালয়, যার প্রায় সব কটিতেই বিজনেস অনুষদ আছে। তাদের কি ব্যবসায় উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা আছে? থাকলেও তা সরকারের মন্ত্রণালয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের কাছ পর্যন্ত আসছে? সরকারের কি শুধু ট্যাক্স–ভ্যাট তোলায় মূল লক্ষ্য, নাকি ব্যবসাকে টেকসই ভিত্তি দেওয়া লক্ষ্য?

চিকিৎসা খাত

এক হতাশার নাম আমাদের চিকিৎসা খাত। সরকার থেকে প্রতিবছর বাজেট বরাদ্দ কমছে। দেশের জনসংখ্যার তুলনায় চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতাল, বেড—সব অপ্রতুল। প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা চলে যায় বিদেশে এই খাতে। যার দুই বছরের টাকা দিয়েই দেশের সব জেলা সদরে স্বয়ংসম্পূর্ণ হাসপাতাল ও চিকিৎসক নিয়োগ করা সম্ভব। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত কারোরই নেই এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা। কারণ, তাঁদের জন্য তো ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর আছে।

পৃথিবীতে যে কয়টি জনবহুল দেশ আছে, এর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র, যে দেশ নিজেদের  নকশা করেছে পরমুখাপেক্ষী করে। এই দেশে নেই খাদ্যনিরাপত্তা, জ্বালানিনিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত দিন দিন নিম্নমুখী, ব্যবসা স্থবির, মানুষ হতাশ। উন্নয়নে কথা শোনা যায়। কিন্তু উন্নয়ন এমন বৈষম্য তৈরি করেছে যে দেশের ৩৪ লাখ মানুষ জানে না পরের বেলায় খাবার জুটবে কি না।

আবার অতিধনী তৈরিতে আমরা আছি শীর্ষে। ব্যর্থতার সব দায় রাজনীতিকদের ওপর গিয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা ঠিকমতো যদি তাঁদের দায়িত্ব পালন করতেন তাহলেও দেশে একটা সহায়ক পরিবেশ গড়ে উঠত। এখন থেকে যদি দেশীয় মাধ্যমে প্রতিবছর ১০ বিলিয়ন ডলার করে উৎপাদন বাড়াতে পারি, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব। সেই জন্য দেশের মানুষ প্রস্তুত হচ্ছে, এখন বাকি আপনাদের এগিয়ে আসা।

  • সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।
    ই–মেইল: contact@subail.com