সরকার এতটা ‘হার্ডলাইনে’ কেন?

ঢাকায় সমাবেশকে ঘিরে নানা নাটকীয়তার মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ
ঢাকায় সমাবেশকে ঘিরে নানা নাটকীয়তার মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ

বিএনপির আগামীকালের সমাবেশটি নিয়ে সরকার যে কঠোরতম অবস্থান বা হার্ডলাইন নীতি নিয়েছে, তাতে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই। একটি রাজনৈতিক সমাবেশ ঠেকাতে সরকার কতটা মরিয়া, তার প্রমাণ মেলে জনসভার এক দিন আগে মাঝরাতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আটক এবং পরে পুলিশের ওপর হামলার পরিকল্পনা ও উসকানি দেওয়ার অভিযোগে কারাগারে পাঠানোর মধ্য দিয়ে।

ঢাকায় ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ আয়োজনের কাজটি যে বিএনপির জন্য সহজ হবে না, সেটা বেশ কিছুদিন ধরেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। এর আগে ৯টি বিভাগীয় সমাবেশ আয়োজনও দলটির জন্য সহজ ছিল না। কিন্তু সেই বাধাগুলো সহনীয় ছিল এবং একেবারে কোণঠাসা অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় মরিয়া বিএনপির কাছে সেগুলো তেমন কোনো বাধাই মনে হয়নি। বরং সেসব বাধা কাটিয়ে সমাবেশ আয়োজন করতে পেরে দল হিসেবে বিএনপি বেশ উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। দলের কর্মী-সমর্থকেরা তাই এই সমাবেশটির জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। ঢাকা সমাবেশটির তারিখ অনেক আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল এবং এটি ১০টি বিভাগীয় সমাবেশের শেষ কর্মসূচি।

নয়াপল্টনে দলের অফিসের সামনে বিএনপি বিভিন্ন সময়ে সমাবেশ করেছে। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের ঘোষিত স্থানও ছিল সেটি। কিন্তু সমাবেশের সময় যত এগিয়ে আসতে থাকে, স্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা তত বাড়তে থাকে। বিএনপি সমাবেশ আয়োজন করতে চেয়েছে নয়াপল্টনে, আর পুলিশ অনুমতি দিয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। দেওয়া হয় ২৬টি শর্ত। যেগুলো পালন করা দলটির জন্য কঠিন। সব মিলিয়ে সমাবেশের স্থান ও শর্ত বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দীর নিয়ন্ত্রিত স্থানে জনসভা করাকে তারা ফাঁদ বলে মনে করেছে। এ নিয়ে অনেক দেনদরবার চলেছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সমাবেশের স্থান নিয়ে সেই যে অচলাবস্থার শুরু, তার একটি সুরাহার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে জনসভার আগের দিন বিকেল পর্যন্ত। বিএনপির জনসভাস্থল এখন গোলাপবাগ মাঠ।

এ সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের মুখে আমরা নানা কথা শুনেছি। কিছু তাঁরা বলেছেন অন রেকর্ড, আর কিছু সংবাদমাধ্যমকর্মীদের বলেছেন অব দ্য রেকর্ড। সেখান থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি সরকার বিএনপির এই সমাবেশকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। বিএনপির সমাবেশকে কীভাবে ঠেকানো যায়, তার নানা কৌশল নিয়েও দলের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। পাল্টা সমাবেশ করা, পাড়ায়-মহল্লায় নিজেদের কর্মীদের জমায়েত রাখা, ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে অবস্থান নেওয়া, এমন নানা কর্মসূচি এ পরিকল্পনার কথায় শোনা গেছে। বলা হয়েছে, বিএনপির সমাবেশ সফল হতে দেওয়া হবে না।

আর পুলিশ যুক্তি দিয়ে চলেছে, সড়কে তারা কোনো সমাবেশ করতে দেবে না, কারণ এতে জনগণের দুর্ভোগ হয়। আমরা জানি ঢাকা শহরে বড় দলগুলোর রাজনৈতিক সমাবেশ মানেই জনদুর্ভোগ, তা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা যেখানেই হোক না কেন। এমনকি ভিভিআইপি, ভিআইপিদের চলাচলও জনদুর্ভোগ তৈরি করে। নয়াপল্টনে অফিসের সামনে বিএনপিকে জনসভা করতে না দেওয়ার পেছনে জনদুর্ভোগের দোহাই তাই যুক্তি হিসেবে খোঁড়া।

সরকার যেহেতু নিজেরা ক্ষমতায় থেকে আরেকটি নির্বাচন করতে চায়, তাই দেশের জনগণ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তার এটা বোঝানো উচিত যে তাদের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। দেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি রয়েছে, বিরোধীদের সভা-সমাবেশের অধিকার রয়েছে এবং সরকার দমন-পীড়নের নীতি থেকে সরে এসেছে, এমন ধারণা প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলো অনুষ্ঠিত হওয়ায় বা সরকার সেগুলো করতে দেওয়ায় মনে হয়েছিল যে সরকার সম্ভবত নির্বাচনের আগে সেই পরিস্থিতিই সৃষ্টি করতে চাইছে।

সরকারের কর্মকাণ্ডে পর্যায়ক্রমে এটা স্পষ্ট হতে থাকে যে সরকার বিএনপিকে এই সমাবেশটি করতে দিতে চায় না। এটা করতে সরকার যে কৌশল নিয়েছে বলে মনে হয়, তা হচ্ছে সময়ক্ষেপণের কৌশল। শেষ সময় পর্যন্ত বিএনপিকে অপ্রস্তুত রাখা। ১০ তারিখ যে জনসভা, তার স্থান ঠিক হয়েছে ৯ তারিখ বিকেলে, মানে একটি জনসভা অনুষ্ঠানের জন্য দলটি ২৪ ঘন্টা সময়ও পাবে না। আমরা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মুখে একদিকে শুনেছি জনসভার স্থান নিয়ে সমঝোতার আশ্বাস, অন্যদিকে চলল বুধবার বিএনপি অফিসে পুলিশের অভিযান। নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি কর্মীদের সংঘাতে প্রাণ গেল একজনের। বৃহস্পতিবার রাতে বিএনপি প্রতিনিধিদের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠকের পর ডিবিপ্রধানের মুখে শুনলাম জনসভার স্থান নিয়ে অচলাবস্থা কেটে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি, আর এরপরই মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হলো গভীর রাতে। শেষ পর্যন্ত মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হলো। মহাসচিকে কারাগারে রেখে বিএনপির পক্ষে একটি জনসভা সফল করা কতটুকু সম্ভব? মির্জা ফখরুলকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে যে আগামীকালের জনসভার ব্যাপারে সরকারের অবস্থান কতটা কঠোর। সরকার এ নিয়ে আর কোনো রাখঢাক করার জায়গায় নেই।

নির্বাচনের আর মাত্র বছরখানেক বাকি আছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন দুটি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি এবং কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এই দুটি নির্বাচনে মানুষ তার ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। আগামী নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তাই একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং দেশের মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে, সেই পরিস্থিতি নিশ্চিত করা। এ জন্য যে রাজনৈতিক সমঝোতা দরকার, তা হয়নি। আওয়ামী লীগ চায় ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে, আর বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাওয়ার এখন পর্যন্ত অনমনীয়। সরকার যখন তার দীর্ঘদিনের নিয়ন্ত্রণমূলক ও দমন-পীড়নের কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসে বিএনপিকে বিভাগীয় সমাবেশগুলো করতে দিয়েছে, তখন অনেকেই মনে করেছেন যে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার পথ তৈরি হতে পারে।

সাধারণ যুক্তি বলে, সরকার যেহেতু নিজেরা ক্ষমতায় থেকে আরেকটি নির্বাচন করতে চায়, তাই দেশের জনগণ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তার এটা বোঝানো উচিত যে তাদের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। দেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি রয়েছে, বিরোধীদের সভা-সমাবেশের অধিকার রয়েছে এবং সরকার দমন-পীড়নের নীতি থেকে সরে এসেছে, এমন ধারণা প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলো অনুষ্ঠিত হওয়ায় বা সরকার সেগুলো করতে দেওয়ায় মনে হয়েছিল যে সরকার সম্ভবত নির্বাচনের আগে সেই পরিস্থিতিই সৃষ্টি করতে চাইছে।

কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, যে বিবেচনা বা চিন্তা থেকে সরকার বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলো হতে দিয়েছে, সেই অবস্থান থেকে সরকার সরে এসেছে। এর কারণ কী হতে পারে? সম্ভাব্য কিছু দিক উল্লেখ করছি। প্রথমত, সরকার সম্ভবত মনে করেছে, দীর্ঘদিন ধরে তারা পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর যে কঠোর নিয়ন্ত্রণ বাজায় রেখেছে, ঢাকার সমাবেশ সেই নিয়ন্ত্রণকে আলগা করে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, ৯টি সমাবেশ করে বিএনপি যে শক্তি-সামর্থ্যের প্রমাণ রেখেছে, সরকারের বিবেচনায় তা উদ্বেগজনক মনে হয়েছে, অর্থাৎ সরকার সত্যিই ভয় পেয়েছে। অথবা, তৃতীয়ত, সরকারবিরোধী যেকোনো আন্দোলন কঠোর হাতে দমন করার যে ঐতিহ্য সরকার গড়ে তুলেছে, সেখানে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়াকে সম্ভবত সরকার কৌশল হিসেবে ভালো মনে করছে না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মাঝে সরকারের তরফে যে নমনীয় অবস্থান লক্ষ করা গিয়েছিল, তা থেকে আবার এই যে উল্টো যাত্রা বা হার্ডলাইন নীতি গ্রহণ, তার ফলাফল কী হতে পারে?

রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতা ছাড়া তো সামনে কিছু দেখা যাচ্ছে না।

  • এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক