গাইবান্ধায় আটকে গেল আওয়ামী লীগ

নির্বাচনী প্রহসন করে গাইবান্ধায় আওয়ামী লীগের জয়ী হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় আপাতত ছেদ পড়ল
ছবি : প্রথম আলো

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও তার সমর্থকেরা মনে করেছিলেন, যেনতেন ভাবে বিকেল চারটা পর্যন্ত প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের ঠেকিয়ে রাখতে পারলেই কেল্লা ফতে। সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশন প্রথমে বেসরকারি ফল ঘোষণা করবে। পরে গেজেট নোটিফিকেশন হলে আর কে পায়? মাননীয় সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি অন্যদের মতোই জনপ্রতিনিধির সুযোগ-সুবিধাগুলো পেতে শুরু করবেন। কিন্তু বেরসিক নির্বাচন কমিশন ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগেই গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনটি বন্ধ করে দিল।

বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে গাইবান্ধা-৫ আসনের ভোট পর্যবেক্ষণের মনিটরিং সেলে বসে প্রধান নির্বাচন কমিশনার(সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচন বন্ধের ঘোষণাটি দিলেন। কেননা আইন অনুযায়ী যদি নির্বাচন কমিশন মনে করে ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে না তাহলে ভোট বন্ধ করে দিকে পারে। এর আগে দুপুর পর্যন্ত মোট ৫১টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ নানা অনিয়মের কারণে বন্ধ করা হয়।

এর আগে দুপুরে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের জানান, গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তিনি বলেন, ‘আইন ভঙ্গ করে গোপন কক্ষে প্রবেশ করে ভোট দিয়ে দিতে আমরা স্বচক্ষে দেখেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইভিএমেরও কোনো ত্রুটি দেখতে পাচ্ছি না। ওই যে মানবিক আচরণ, আরেকজন ঢুকে যাচ্ছে, দেখিয়ে দিচ্ছে। এটা সুশৃঙ্খল নির্বাচনের পরিপন্থী। এরাই ডাকাত, এরাই দুর্বৃত্ত। যারাই আইন মানছেন না তাদেরই আমরা ডাকাত-দুর্বৃত্ত বলতে পারি। কারণ আইনের প্রতি সকলকে শ্রদ্ধা করতে হবে। সকলে যদি আইন না মানি, নির্বাচন কমিশন এখানে বসে সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে পারবে না।’

ভোট কারচুপি ও জবরদস্তির দায়ে  এর আগে কোনো উপনির্বাচন এভাবে বাতিল করেনি কমিশন। মোহাম্মদ আবু হেনা সিইসি থাকতে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনের গেজেট নোটিফিকেশন আটকে দিয়েছিলেন। তার পদত্যাগের পরই গেজেট নোটিফিকেশন হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন অন্তত নির্বাচন বাতিল করার নজির স্থাপন করেছে।

গাইবান্ধা-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী ২৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার মৃত্যুতে আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। এরপর তফসিল অনুযায়ী শুরু হয় ভোটগ্রহণ। কিন্তু শুরুতেই বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ আসতে থাকে ইসিতে। এ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৭৪৩ জন। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে সব কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ চলছিল। এর আগেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছাড়া বাকি চার প্রার্থী ভোট বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন। নির্বাচনে মোট প্রার্থী ছিলেন পাঁচজন। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বিকল্প ধারার প্রার্থীরা দলীয়ভাবে নির্বাচন করেছেন। বাকি দুজন ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী।

গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের উপনির্বাচনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৯৮ জন। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মাহমুদ হাসান, জাতীয় পার্টির (জাপা) মনোনীত এ এইচ এম গোলাম শহীদসহ উপনির্বাচনে পাঁচজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইভিএমের মাধ্যমে ১৪৫টি কেন্দ্রে ৯৫২টি বুথে ভোট গ্রহণ করা হয়। নির্বাচনের দিন ভোটারদের নিরাপত্তা দিতে কয়েক প্লাটুন র‍্যাব, আনসার সদস্য ছাড়াও ১ হাজার ২৮৫ জন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের ভোটাধিকার রক্ষা করতে পারেননি।

গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনের এই চিত্র ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত মাগুরা-২ উপনির্বাচনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও জবরদস্তির ঘটনা ঘটে। এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি সংবিধানে যোগ করতে বাধ্য হয় বিএনপি সরকার। ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনে বিএনপির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আওয়ামী লীগ। এবারে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বীরা অতটা শক্ত নন। বিএনপি ভোট বর্জন করেছে। জাতীয় পার্টি ও বিকল্প ধারা দলীয়ভাবে প্রার্থী দিয়েছে।

২০১৬ সালের ৯ এপ্রিল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের হালচাল নিয়ে প্রথম আলোয় লিখেছিলাম: ঘরে ঘরে এখন ‘মাগুরা’। বাংলাদেশে সামরিক বা দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার নজির খুবই কম। দু-চারটি উপনির্বাচন বা স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন মোটামুটি ঠিকঠাক হলেও জাতীয় নির্বাচনে এসে তারা কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। নির্বাচন কমিশন কাগজপত্রে স্বাধীন হলেও ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। অনেক সময় তাদের ভাষাভঙ্গির সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ভাষাভঙ্গির আশ্চর্য মিল লক্ষ করা যায়। আবার এই মাজাভাঙা নির্বাচন কমিশনকেই দেখা যায় দলীয় সরকারের বাইরে নির্বাচন হলে অতি ন্যায়পরায়ণ হতে।
সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সামরিক শাসনামলের নির্বাচনের উদাহরণ এখানে টানছি না। কেননা তাঁদের গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যই ছিল ক্ষমতায় থেকে দল করা এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সেই দলকে জয়ী করা। তাঁরা কখনো এমন নির্বাচন দেননি, যাতে হেরে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের পর কীভাবে এরশাদ মিডিয়া ক্যু করে ফল নিজের পক্ষে নিয়েছিলেন, তা নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের নেতারা ভুলে যাননি।

খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় এসেছিলেন। তাঁর আমলে দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনও অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছিল। কিন্তু এরপর উপনির্বাচনগুলোতে দলীয় নেতা-কর্মী ও মাস্তানদের তিনি সামাল দিতে পারলেন না; যার প্রথম উপসর্গ দেখা দেয় মিরপুর উপনির্বাচনে এবং সর্বশেষ মাগুরা-২-এ। মাগুরা উপনির্বাচন হয় ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ। উপনির্বাচন উপলক্ষে মন্ত্রী-বিরোধীদলীয় নেতাসহ ৮০ জন সংসদ সদস্য সেখানে গিয়েছিলেন বলে পত্রিকায় খবর বের হয়েছিল। নির্বাচনের পরদিন ২১ মার্চের পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মাগুরা-২ উপনির্বাচন চলাকালে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে বেশ কিছু স্কুটারকে ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় দেখা গেছে। এসব স্কুটারের নম্বর-প্লেট ঢাকা ছিল। এর পরিবর্তে লেখা ছিল সংবাদপত্র। স্কুটারের ভেতরে ছিল সশস্ত্র যুবকেরা।’ (সংবাদ, ২১ মার্চ)।

নির্বাচনের পরদিন মাগুরায় আয়োজিত জনসভায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ভোট ডাকাতির নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে পুনর্নির্বাচন না দিলে আমরা নতুন আন্দোলন করতে বাধ্য হব, যা সরকারের পতন ডেকে আনবে। ভোট ডাকাত এমপিদের সঙ্গে সংসদে বসা যায় কি না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। এ নির্বাচনে ভোট ডাকাতি প্রমাণ করেছে এ সরকারের অধীনে কোনো নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।’ (সূত্র: ভোরের কাগজ, ২২ মার্চ ১৯৯৪)।

একই পত্রিকায় বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের বাইরে পড়ে থাকা প্রচুর ব্যালটের ছবি ছাপা হয়েছিল। বিরোধী দলের সমালোচনার জবাবে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুস সালাম তালুকদার সংবাদপত্রে বিবৃতিতে বলেছিলেন, পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতা নেই বলেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনেছে। সেই সময়ে বিএনপির নেতাদের বক্তৃতা বিবৃতির সঙ্গে এখনকার আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। দোষটা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির নয়। ক্ষমতার ভাষা বরাবরই অহমিকায় আচ্ছন্ন থাকে।

বিএনপি আমলে সেটাই ছিল সম্ভবত শেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ উপনির্বাচন। এরপর বিএনপি সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নেয়নি। সংসদেও যোগ দেয়নি তারা। এই মাগুরা উপনির্বাচনের কারচুপি ও ভোট জালিয়াতিকে কেন্দ্র করেই বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তুলল এবং সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা মানতে বাধ্য করল। মাগুরা উপনির্বাচনের সময় সিইসি ছিলেন বিচারপতি আবদুর রউফ। ছাত্ররাজনীতিতে উজ্জ্বল অতীতের অধিকারী রউফ বলেছিলেন, কেউ ভোটকেন্দ্রে মাস্তানি করতে এলে কমিশন তিন গুণ মাস্তানি দিয়ে তা মোকাবিলা করবে। কিন্তু তিনি পারেননি বলেই বাজে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায় মাথায় নিয়ে তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছে।

ভোট কারচুপি ও জবরদস্তির দায়ে  এর আগে কোনো উপনির্বাচন এভাবে বাতিল করেনি কমিশন। মোহাম্মদ আবু হেনা সিইসি থাকতে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনের গেজেট নোটিফিকেশন আটকে দিয়েছিলেন। তার পদত্যাগের পরই গেজেট নোটিফিকেশন হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন অন্তত নির্বাচন বাতিল করার নজির স্থাপন করেছে।

নির্বাচনী প্রহসন করে গাইবান্ধায় আওয়ামী লীগের জয়ী হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় আপাতত ছেদ পড়ল।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম–সম্পাদক ও কবি