বিশেষ সাক্ষাৎকার: আনু মুহাম্মদ

আইএমএফের ঋণ মানুষের বঞ্চনা ও কষ্ট বাড়াবে

বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এই ঋণের শর্ত বাস্তবায়নে সরকার কতটুকু সক্ষম, এর প্রভাবই–বা কী—এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ইফতেখার মাহমুদ

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ
প্রশ্ন

আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করল। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন সংকট থেকে বেরোতে পারবে বলে মনে করেন?

আনু মুহাম্মদ: একটি দেশের অর্থনীতি কোন ধরনের সংকটের মধ্যে আছে এবং দেশটির শাসনব্যবস্থা কেমন, তার ওপর নির্ভর করে আইএমএফের ঋণ সে কীভাবে ব্যবহার করবে। কারণ, সংকটের ধরন অনুযায়ী ঋণের শর্তগুলো ঠিক হয়। দেশের অর্থনীতি এখন যে ধরনের সমস্যা এবং সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার দুটি দিক আছে। সরকারের জন্য প্রধান সমস্যা রিজার্ভ কমে যাওয়া, প্রয়োজন অনুযায়ী ডলার না থাকা। জনগণের জন্য দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, আর্থিক খাতের দুর্নীতি ও অনিয়ম। এটা তৈরি হয়েছে ভুল নীতি এবং শাসনব্যবস্থায় যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সে কারণে। আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে বা দেবে, তার কিছু পূরণ করা সরকারের জন্য তেমন বড় সমস্যা না, যেগুলো জনগণের বিরুদ্ধে যাবে। বরং সরকার যারা চালায়, তাদের অনেকে ওই ঋণ থেকে উল্টো লাভবান হবে। কারণ, ঋণের শর্ত থাকবে মূলত আরও বেশি বেসরকারীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ। এটা সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের জন্য আরও সম্পদ অর্জনের সুযোগ তৈরি করবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান সংস্কার, লুণ্ঠন কমানোর কাজ তারা করবে না, আইএমএফও জোর করবে না।

প্রশ্ন

বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকট সামাল দিতে আইএমএফ কি ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, নাকি শেষ পর্যন্ত শর্তগুলো সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে?

আনু মুহাম্মদ: বাংলাদেশ এ নিয়ে মোট ১২ বার আইএমএফের ঋণ নিয়েছে। তারা তখনো অনেক শর্ত দিয়েছিল। খেলাপি ঋণ কমানো ও লোকসান কমাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছিল। এতে সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা এসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে নেবে। কর বাড়ানোর কথা বলা হলেও যাঁরা বড় ব্যবসায়ী এবং কর ফাঁকি দেন, তাঁরা বছরের পর বছর কর ফাঁকি দিয়ে গেছেন। আর সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। এতে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে।

আইএমএফের ঋণ নিয়ে এর আগে কোনো দেশ অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে পেরেছে, তার কোনো উদাহরণ নেই। পাকিস্তান এর আগে ২২ বার ও শ্রীলঙ্কা ১৬ বার ওই ঋণ নিয়েছে। ঋণের শর্ত পূরণের জন্য তারা যেসব সংস্কার করছে, তাতে সেই দেশগুলোর সামরিক বাহিনী এবং একদল ব্যবসায়িক গোষ্ঠী লাভবান হয়েছে। কিন্তু দেশের অর্থনীতি দিন দিন খারাপ হয়েছে। সাময়িকভাবে সরকারের সমস্যার সমাধান হবে। তার আরও ঋণ নেওয়ার পথ তৈরি হবে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সংকট আরও বাড়বে।
প্রশ্ন

শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে সরকার এরই মধ্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে। মানুষকে অতিরিক্ত দামে জ্বালানি কিনতে হচ্ছে। কিন্তু বিকল্প কী ছিল?

আনু মুহাম্মদ: আইএমএফের শর্ত থাকে খাদ্য, সার, গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের ওপর থেকে ভর্তুকি কমানো। কিন্তু তারা এর কারণ দূর করার কথা বলবে না। সরকার বছরের পর বছর কোনো ধরনের শর্ত ছাড়াই বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখে নানা ব্যয়বহুল আমদানিমুখী প্রকল্প নিচ্ছে, অর্থ পাচার করতে দিচ্ছে, আর এর বোঝা মানুষের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। সেটা আরও বাড়বে। নিত্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে। ফলে অবশ্যই মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তি বাড়বে।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এ ছাড়া তো আমাদের কোনো বিকল্প নেই। কারণ, আমাদের তো খাদ্য, জ্বালানি তেলসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। কিন্তু ওই প্রশ্ন ওঠার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশে ডলার ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরির প্রধান কারণ ঋণ করে মেগা প্রকল্প করা। যার কিস্তি শোধ করতে আমাদের রিজার্ভে টান পড়েছে। দেশের ভেতরে গ্যাস এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যাপারে মনোযোগ না দিয়ে এলএনজি ও কয়লার মতো জ্বালানি বেশি দামে বিদেশ থেকে কেনা হয়েছে। একের পর এক বেশি অর্থ ব্যয় করে মেগা প্রকল্প করা হয়েছে। ডলারে অর্থ পাচার বেড়েছে।

প্রশ্ন

আইএমএফ ঋণ অনুমোদন করে বলেছে যে এই ঋণ দেশটির সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা অক্ষুণ্ন রাখা, দুর্বলকে সুরক্ষিত করা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে? এগুলো কি বাস্তবায়ন করা যাবে?

আনু মুহাম্মদ: আইএমএফের ঋণ নিয়ে এর আগে কোনো দেশ অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে পেরেছে, তার কোনো উদাহরণ নেই। পাকিস্তান এর আগে ২২ বার ও শ্রীলঙ্কা ১৬ বার ওই ঋণ নিয়েছে। ঋণের শর্ত পূরণের জন্য তারা যেসব সংস্কার করছে, তাতে সেই দেশগুলোর সামরিক বাহিনী এবং একদল ব্যবসায়িক গোষ্ঠী লাভবান হয়েছে। কিন্তু দেশের অর্থনীতি দিন দিন খারাপ হয়েছে। সাময়িকভাবে সরকারের সমস্যার সমাধান হবে। তার আরও ঋণ নেওয়ার পথ তৈরি হবে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সংকট আরও বাড়বে।

প্রশ্ন

সংস্কার বাস্তবায়নে সরকারের সক্ষমতা কতটা আছে?

আনু মুহাম্মদ: আইএমএফের ঋণের পেছনে যে সংস্কারের সুপারিশ থাকবে, সেগুলোর কিছু তারা আগ্রহ নিয়েই করছে, যেগুলো জনগণের ওপর বোঝা বাড়াবে। তারা যে পরিমাণে ঋণ দিচ্ছে, তা দেশের প্রবাসীদের পাঠানো দুই মাসের আয়ের সমান। প্রতিবছর দেশ থেকে যে পরিমাণ ডলার পাচার হয়, তা রোধ করা গেলে ওই ঋণ নেওয়ার দরকার হয় না। সেটি সরকার করতে পারবে না। কারণ, সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা এসব কাজ করেন। দেশের আর্থিক খাতে লুটপাট বন্ধ না করলে আইএমএফের ঋণ নিয়ে সরকার সাময়িক ত্রাণ পেলেও জনগণের কোনো লাভ হবে না, বরং তাদের বোঝা ও বঞ্চনা বাড়বে।

প্রশ্ন

দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে আইএমএফের ঋণ তাহলে কাজে লাগবে না মনে করছেন?

আনু মুহাম্মদ: দেশে বর্তমানে খাদ্য ও নিত্যপণ্য আমদানিতে ডলার-সংকট নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। কিন্তু আমাদের এটা মনে রাখতে হবে, এসব সমস্যার সমাধানে আইএমএফের ঋণ কাজে লাগানো যাবে, এটা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না। কারণ, ওই ঋণ কোন খাতে কীভাবে ব্যয় করতে হবে, তা আইএমএফ থেকে বলে দেওয়া হবে। মোট সাতটি কিস্তিতে তা আসবে। অনেক অর্থ সরাসরি বাংলাদেশেও আসবে না। ঋণ কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, কোথায় ব্যবহার হবে—এগুলো বোঝানোর নামে বিদেশে প্রশিক্ষণ-কর্মশালা হবে। বিদেশি বিশেষজ্ঞরা আসবেন। তাঁদের জন্য অর্থ বরাদ্দ থাকবে। ফলে বঙ্গোপসাগরে পণ্যবাহী জাহাজ ভাসছে, আইএমএফের ঋণ এলে সেই ডলার দিয়ে পণ্য খালাস করা যাবে, এমনটা যাঁরা মনে করছেন, তাঁরা ভুল পথে আছেন।

প্রশ্ন

আইএমএফের ঋণ নিয়ে বিশ্বের কোনো দেশের কোনো কাজে লাগেনি মনে করছেন?

আনু মুহাম্মদ: আইএমএফ ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দুই ধরনের শর্ত দেয়। প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক ও দ্বিতীয়ত, ভর্তুকি কমানোর শর্ত। ওই দুই শর্ত পালন করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কা আগে বিপদে পড়েছিল। ঋণ নেওয়ার আগে শ্রীলঙ্কার বেশ কিছু ইতিবাচক শক্তি ছিল। যেমন দেশটির সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসেবা খুব উন্নত ছিল। তাদের পরিবেশ সুরক্ষার একটি প্রবণতা ছিল। ঋণ পাওয়ার পর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে তাদের সরকারি বরাদ্দ কমাতে হয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষা করে কৃষিকাজ এবং অন্যান্য তৎপরতার ব্যাপারে আইএমএফ কোনো বরাদ্দ দেয়নি। আর দেশটির শাসকদের মধ্যে পরিবারতন্ত্র এবং সামরিক বাহিনীর পেছনে অত্যধিক ব্যয় বেড়ে যায়।

আর দিন শেষে মনে রাখতে হবে, আইএমএফের ঋণের টাকার বড় অংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকে। তারা তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ নিশ্চিত করতে ওই অর্থের মধ্যে নানা শর্ত জুড়ে দেয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতারও সমস্যা আছে। ফলে ওই ঋণকে বাংলাদেশ চাইলেও জাতীয় সক্ষমতা বাড়াতে ব্যয় করতে পারবে না। আইএমএফের এ ব্যাপারে কোনো ইচ্ছাও নেই। তাই দিন শেষে ওই অর্থ জনগণের কষ্টের বোঝা বাড়ানো ছাড়া আর কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।

প্রশ্ন

আপনাকে ধন্যবাদ।

আনু মুহাম্মদ: আপনাদেরও ধন্যবাদ।