ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের ভাউলার হাটে তীব্র স্রোতে বয়ে চলছে ভক্তি নদী
ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের ভাউলার হাটে তীব্র স্রোতে বয়ে চলছে ভক্তি নদী

মতামত

রংপুর বিভাগে ২৭৭ নদী যেভাবে পাওয়া গেল

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১১ সালে বাংলাদেশের নদ-নদী শীর্ষক ছয় খণ্ডের একটি বই প্রকাশ করে। সেখানে সারা দেশের ৪০৫টি নদীর উল্লেখ আছে। এ বই অনুযায়ী রংপুর বিভাগে মোট নদ-নদীর সংখ্যা ৮৩। এরপর ২০২৩ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বাংলাদেশের ১ হাজার ৮টি নদী আছে মর্মে একটি বই প্রকাশ করেছে। রংপুর বিভাগে সেখানে ১৩১টি নদীর কথা বলা হয়েছে। রিভারাইন পিপলের পক্ষে আমি এবং মহাসচিব শেখ রোকন আরও শতাধিক নদীর তালিকা কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে তুলে দিয়েছিলাম। কমিশন এই তালিকা আমলে নেয়নি।

নদী–গবেষক মাহবুব সিদ্দিকীসহ আমরা কয়েকজন নদীকর্মী রংপুর বিভাগের ২৬৮টি নদীর তালিকা রংপুর বিভাগীয় কমিশনার তথা বিভাগীয় নদী রক্ষা কমিটির সভাপতির কাছে তুলে দিয়েছিলাম। এ কাজে নদীকর্মী প্রকৌশলী ফজলুল হকও সহায়তা করেন। আমরা দাবি করেছিলাম, এই নদীগুলো সরেজমিন দেখে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত করা হোক। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডেও (পাউবো) নদীর একটি তালিকা পাঠাই। জেলা প্রশাসন এবং পাউবোর জেলা ও রংপুর বিভাগীয় পর্যায়ের প্রকৌশলীরা সম্প্রতি নদীর তালিকা প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেন। এই উদ্যোগ মূলত অন্তর্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের নির্দেশে। তিনি দুই মাসের মধ্যে দেশের নদ-নদীর তালিকা চূড়ান্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

রংপুর বিভাগের জেলা পর্যায়ের প্রকৌশলীরা আমাদের দেওয়া তালিকা ধরে নদীর অনুসন্ধান করেন। সরেজমিন অনুসন্ধান করতে গিয়ে যখন যেটি পাননি, সেটি আমাদের কাছে জেনে নিয়েছেন। নতুন করে যখন পাউবো এই নদীর অনুসন্ধান শুরু করে, আমাদের তালিকার বাইরেও নদীর সন্ধান পায়। আমাদের দেওয়া তালিকা থেকে কয়েকটি নদী বাদ পড়েছে। সেই বিবেচনায় বলা যায়, রংপুর বিভাগে নদীর সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে যাবে।

পাউবোর রংপুর বিভাগীয় প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান একদিন আমাকে একটি সভায় আমন্ত্রণ জানান। সেখানে বিভাগের আট জেলার প্রকৌশলীরা উপস্থিত ছিলেন। ওই দিন রংপুর বিভাগে তাঁদের প্রাপ্ত নদ-নদী সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। রংপুর বিভাগীয় নদী রক্ষা কমিটির বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয় রংপুর বিভাগের নদ-নদীর তালিকা চূড়ান্ত করার জন্য। ওই সভায় যে তালিকা চূড়ান্ত করা হয়, সেখানে জেলাভিত্তিক সংখ্যা দেখানো হয়। রংপুরে ৪০টি, নীলফামারীতে ৩৭টি, লালমনিরহাটে ১৮টি, কুড়িগ্রামে ৩৫টি, গাইবান্ধায় ২৪টি, ঠাকুরগাঁওয়ে ৩৯টি, দিনাজপুরে ৩৪টি এবং পঞ্চগড়ে ৫০টি নদীর উল্লেখ আছে। জেলাভিত্তিক নদীর পূর্বের সংখ্যাগত ধারণা এবার বদলে যাবে। কেবল নদীর নাম নয়, নদীগুলো সম্পর্কে অনেক তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছে। উৎস-মিলনস্থল, দৈর্ঘ্য, সিএস-এসএ-আরএস রেকর্ডে নদীগুলোর অবস্থা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেওয়া আছে। যেসব নদী রেকর্ডভুক্ত নয়; কিন্তু প্রবাহ আছে, এ রকম অনেক নদীও তালিকাভুক্ত হয়েছে।

রংপুর বিভাগে বাংলাদেশ-ভারত স্বীকৃত আন্তসীমান্ত নদীর সংখ্যা ১৮। বর্তমানে নদীর যে সংখ্যা পওয়া গেছে, তাতে আন্তসীমান্ত নদীর সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। ফলে রংপুর বিভাগের আন্তসীমান্ত নদীর সংখ্যাগত ধারণাও বদলে যাবে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক নদ-নদীর তালিকা চূড়ান্তকরণে সারা দেশে নদীর সংখ্যা কিছু বাড়বে। কিন্তু এই সংখ্যা রংপুর বিভাগে যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে বাড়বে বলে মনে হয় না। প্রতিবার নদীর তালিকা প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে যঁাদের ওপর নির্ভর করা হয়, এবারও তা–ই করা হয়েছে। ফলে সরেজমিন অনুসন্ধানে তেমনটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। রংপুর বিভাগ এ ক্ষেত্রে ভিন্ন। এখানে সরকারি-বেসরকারি তথ্যের সমন্বয় করা হয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে একটি নদের কথা উল্লেখ না করলে নয়। ঠাকুরগাঁও জেলার ভক্তি নদ সরকারি তালিকায় ছিল না। নদটি তালিকাভুক্ত করার জন্য আমি কমিশনে কয়েক মাস আগে চিঠি দিয়েছিলাম। কমিশন ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসকের কাছে নদটি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। জেলা প্রশাসক আটজনের একটি কমিটি করে দিয়েছিলেন নদটির তথ্য সংগ্রহের জন্য। আটজন মিলে প্রতিবেদন দিয়েছিল ভক্তি নামে কোনো নদ নেই। এই প্রতিবেদন দেখে আমি প্রথম আলোয় লেখা লিখলাম, ‘প্রবহমান ভক্তি নদ আটজনের কেউ খুঁজে পেলেন না?’ এরপর নতুন করে পাউবো আমার লেখা সূত্রে নদটি খুঁজে পায়। নদটির ভাটিতে নাম নেহা। এই নামে নদটি তালিকাভুক্ত হয়েছে।

রংপুর বিভাগের নদ-নদীর এই সংখ্যাও নদীর সম্পূর্ণ তালিকা নির্দেশ করে না। তবু যে সংখ্যা পাওয়া গেছে, তা অনেক। এখন এই নদীগুলোর পূর্ণ তথ্য পাউবো হাজির করতে পারবে। এই তালিকা নিশ্চয়ই জেলাভিত্তিক ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। রংপুর বিভাগে প্রাপ্ত ২৭৭টি নদীর মধ্যে একটিরও অবস্থা ভালো নেই বললেই চলে। এই সংখ্যার বাইরে রংপুর বিভাগে আরও কোন কোন নদী আছে, তার অনুসন্ধানও চলমান রাখতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় সিএস রেকর্ড ধরে নদীর অনুসন্ধান করা। সম্প্রতি এই পদ্ধতিতে নদীর অনুসন্ধানবিষয়ক একটি সভা জাতীয় নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট আয়োজন করেছিল। আমি ওই সভায় উপস্থিত ছিলাম। সিএস রেকর্ড ম্যাপ এবং খতিয়ান ধরে কাজ শুরু করতে পারলেও নদীর প্রকৃত সংখ্যা পাওয়া সম্ভব হবে।

রংপুর বিভাগে বাংলাদেশ-ভারত স্বীকৃত আন্তসীমান্ত নদীর সংখ্যা ১৮। বর্তমানে নদীর যে সংখ্যা পওয়া গেছে, তাতে আন্তসীমান্ত নদীর সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। ফলে রংপুর বিভাগের আন্তসীমান্ত নদীর সংখ্যাগত ধারণাও বদলে যাবে।

আমরা চাই দেশের সব বিভাগে এভাবে নদীর অনুসন্ধান করা হোক। বাংলাদেশ-ভারত আন্তসীমান্ত সব নদীর স্বীকৃতি থাকুক। বাংলাদেশ অর্ধশত বছরে নদ-নদীর যে তালিকা প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার সেই ব্যর্থতা দূর করুক। 

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক