বান্দরবানের লামায় যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী ম্রো জনগোষ্ঠীর বসতিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ২ জানুয়ারি রাত একটার দিকে পাঁচ থেকে ছয়টি ট্রাকে বহিরাগত ব্যক্তিরা এসে এই হামলা চালায়। লামার সরই ইউনিয়নের রেঙয়েন কার্বারি পাড়ায় বসবাসকারী ও হামলার শিকার ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের অভিযোগ, তাদের বসবাসের শেষ অবলম্বন ৪০০ একর জমি থেকে তাদের উচ্ছেদ করার জন্যই লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নেতৃত্বে এই হামলা চালানো হয়েছে (লামায় ম্রোদের বাড়িঘরে আগুন-ভাঙচুরের অভিযোগ, ডেইলি স্টার অনলাইন বাংলা, ২ জানুয়ারি, ২০২৩)।
লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে রেঙয়েন কার্বারি পাড়ায় বসবাসকারী ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ তৎপরতার অভিযোগ নতুন নয়। গত বছরের ৪ মে প্রথম আলো পত্রিকার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০২২ সালের ২৬ এপ্রিল লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লাংকমপাড়া, রেঙয়েনপাড়া ও জয় চন্দ্রপাড়ার ৪০০ একর জুমচাষের জমির মধ্যে ৩৫০ একর জমির গাছ ও ফসল কেটে পুড়িয়ে দেয়। বাগানে লাগানো বিভিন্ন ফলদ চারা, যেমন আনারস, বরই, আম, জাম, কাঁঠালগাছ, বাঁশবাগানসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে দেওয়া এবং জমিতে আগুন দিয়ে ফসল ধ্বংস করে দেওয়ায় তিনটি পাড়ার ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষ তীব্র খাদ্যসংকটে পড়ে যায়।
শুধু তাই নয়, জুমভূমি পুড়িয়ে দেওয়া ছাড়াও ভূমি জবরদখলের উদ্দেশ্যে সেখানকার অশোক বৌদ্ধবিহারে হামলা, ভাঙচুর ও বুদ্ধমূর্তি লুট এবং ভূমি রক্ষা কমিটির নেতা-কর্মী ও গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলাও করেছে কোম্পানিটি। এ ছাড়া গত ৬ সেপ্টেম্বর মাছ শিকারের নামে সরই ইউনিয়নের রেঙয়েনপাড়ার বাসিন্দাদের পানির প্রধান উৎস কালাইয়া ঝিরিতে কীটনাশক মেশানোর মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়। এতে চিংড়িসহ নানা ধরনের মাছ ও বিভিন্ন জলজ প্রাণী পচে দুর্গন্ধ তৈরি হয় ঝিরির পানিতে। এমন পরিস্থিতিতে ম্রো সম্প্রদায়ের ১৫টি পরিবার পানির সংকটে পড়ে যায়। পাড়ার প্রধান অভিযোগ করেছিলেন, পার্শ্ববর্তী রাবার বাগানের শ্রমিকেরা এ কাজ করেছেন।
বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের এসব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য হলো সেখানে বসবাসরত ব্যক্তিদের নানাভাবে বিপদগ্রস্ত করে জমি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা। লামা রাবার কোম্পানি বারবার স্থানীয় অধিবাসীদের তাদের বসতি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য এ রকম অবৈধ জবরদস্তিমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে কিন্তু সেগুলো প্রতিরোধ করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। এমনকি বান্দরবান জেলা পরিষদ কর্তৃক গঠিত পরিদর্শন কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে রাবার কোম্পানির দাবি করা জমির ওপর কোনো বৈধ মালিকানা না থাকার বিষয়টি উঠে এলেও রহস্যজনকভাবে কোম্পানিটিকে সেই জমি জবরদখল থেকে বিরত রাখার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না (প্রশাসনের দুই অবস্থানে খুলছে না লামার ৪০০ একর জমির জট, ১০ নভেম্বর ২০২২, প্রথম আলো)।
প্রকৃতপক্ষে, লামার বিস্তীর্ণ এলাকার জমি একসময় ম্রো ও ত্রিপুরাদের সমষ্টিগত মালিকানার অধীন ছিল। সে সময় সেখানে তারা জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করত। আর জুমচাষের বৈশিষ্ট্যই এমন যে তার জন্য স্থায়ী ব্যক্তিগত ভূমি মালিকানার প্রয়োজন পড়ে না। কোনো একটি পাড়ার আওতায় থাকা জুমচাষের জমিটুকু পাড়ার বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে অস্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং এক টানা দুই বা তিন বছর চাষাবাদের পর সেই জমির উর্বরতা পুনরুদ্ধারের জন্য কয়েক বছরের জন্য ফেলে রাখতে হয়। এভাবে কয়েক বছর পরপর পাড়ার জুমচাষের জন্য নির্ধারিত জায়গা বদলানো হয় আর সেই সঙ্গে প্রতিটি পরিবারের জুমের খেতও বদলে যেতে থাকে। কাজেই এই ব্যবস্থায় এ অঞ্চলে কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানির নামে জমি থাকার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকারকে তোয়াক্কা না করে গত শতকের আশি বা নব্বইয়ে দশকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাবার, টিক, পাল্প উডের বাণিজ্যিক প্ল্যান্টেশনের জন্য বহিরাগত ব্যক্তিদের দীর্ঘ মেয়াদে জমি ইজারা দেওয়ার কারণে উক্ত জুম ভূমি থেকে এক দিকে ম্রো ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মানুষ উচ্ছেদ হতে থাকে, অন্যদিকে রাবার, টিক ইত্যাদির মনোকালচার প্ল্যান্টেশনের প্রভাবে উক্ত এলাকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হতে থাকে।
এই ধারাবাহিকতাতেই লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের নামে আশি ও নব্বইয়ের দশকে ডলুছড়ি ও সরাই—এই দুই মৌজার মোট ১ হাজার ৬০০ একর জমি ইজারা দেওয়া হয়। লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির অভিযোগ হলো, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিজ নেওয়া জমির সীমানা নির্ধারণসংক্রান্ত অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে বাস্তবে তিন হাজার একরেরও বেশি জমিতে রাবার বাগান করেছে। আর এখন যে ৪০০ একর জমি থেকে ম্রো ও ত্রিপুরাদের উচ্ছেদ করতে চাইছে, সেটাও ইজারার আওতার বাইরের জমি।
জুম ভূমিতে অগ্নিসংযোগের এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বান্দরবান জেলা পরিষদ কর্তৃক গঠিত পরিদর্শন কমিটির ১৯ মে ২০২২ তারিখে দেওয়া প্রতিবেদন অনুসারে, এই ৪০০ একর জমি যদি ১৯৯৬ সালে দেওয়া লিজের আওতায় পড়েও থাকে, সে ক্ষেত্রেও পাঁচ বছরের মধ্যে রাবার বাগান সৃজনের যে শর্ত ইজারার বেলায় দেওয়া হয়েছিল, সেই শর্ত ভঙ্গের কারণে এই জমির ওপর লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের আইনগত কোনো অধিকার এখন আর অবশিষ্ট নেই। এই কারণেই পরিদর্শন কমিটির প্রতিবেদনে এই ইজারা বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছিল।
‘লিজকৃত জমি ১৯৯৬ সালে প্রদান করা হয়, যা ৫ বছরের মধ্যে রাবার বাগান সৃজন করার শর্তে। ১৯৯৬ হতে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৫ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও লিজকৃত জায়গার ওপর কোনো প্রকার রাবার রোপণ শুরু করা হয়নি। সুতরাং আইনগতভাবে লিজকৃত জায়গার ওপর লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লি. এর কোনো প্রকার বৈধ অধিকার নেই এবং আইন অনুযায়ী বাতিল যোগ্য, যা অতিসত্বর বাতিল করার সুপারিশ করা হলো’ (লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে জুম ভূমিতে অগ্নিসংযোগ এবং ভয়াবহ খাদ্যসংকট এলাকা পরিদর্শনে গঠিত পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট পরিদর্শন কমিটির পরিদর্শন প্রতিবেদন, ১৯ মে ২০২২)।
জেলা পরিষদ কর্তৃক গঠিত পরিদর্শন কমিটির ইজারা বাতিলের এই সুপারিশ আজও বাস্তবায়ন করা হয়নি, ভূমি দখলের উদ্দেশ্যে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের জোর জবরদস্তি জুলুমও বন্ধ হয়নি। লামার ম্রো জনগোষ্ঠীর বসতিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের সাম্প্রতিক ঘটনাটি ঘটেছে এ রকম একটা প্রেক্ষাপটে। এই ঘটনায় ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরা এক ফেসবুক পোস্টে প্রশ্ন তুলেছেন‘কোন দেশে বাস করছি আমরা! সাধারণভাবে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও কি নেই আমাদের!! দেশের আইনকানুনের কি এতই অবক্ষয় হয়েছে?... জীবনের নিশ্চয়তা কোথায়?’
রংধজন ত্রিপুরার এই প্রশ্নের উত্তর সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনকেই দিতে হবে। এই ঘটনায় ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের বসবাস ও চাষাবাদের জমির অধিকার যেমন সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে, সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে প্রথাগতভাবে ব্যবহৃত হওয়া এসব জমিতে যেন কোনো ধরনের বাণিজ্যিক ও উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া না হয় কিংবা বেসরকারি কোম্পানির কাজে ইজারা দেওয়া না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে প্রথাগতভাবে যৌথমালিকানা ব্যবস্থায় বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক ভূমি অধিকারের আইনি স্বীকৃতি দেওয়া ভীষণ জরুরি, যেন দখলদারেরা কোনো ধরনের আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভূমি দখল করতে না পারেন।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক, প্রকাশিত গ্রন্থ: বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি
ই-মেইল: kallol_mustafa@yahoo. com