গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কয়েক দিন পরের ঘটনা। গাড়িতে কর্মস্থলে যাচ্ছিলাম। চালক এই আলাপ সেই আলাপে জানালেন তাঁর এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কথা। বললেন, এক কোটি টাকা খরচ করেছেন জিতে যাওয়া চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। মুচকি হেসে জানতে চাইলাম, গুনল কে? হিসাব জানলেন কীভাবে? তিনি যত উপায়ে সম্ভব বোঝানোর চেষ্টা করলেন, তাঁর কথা সত্য। কসম-কিরা কেটে জানালেন, শুধু মেম্বার পদপ্রার্থীরাই একেকজন খরচ করেছেন ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা।
ধরেই নিলাম অতিকথন। বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা ব্যতিক্রম। তবে যা রটে, তার কিছু ঘটলেও অঙ্কটি কম হওয়ার কথা নয়। চালকের অতিকথনটিই স্থানীয় নির্বাচনের খরচ কী রকম, তা জানতে আমাকে আগ্রহী করে তুলল। তারপর হাটে-মাঠে যখন যেখানে কোনো কাজে গিয়েছি, সাধারণ মানুষের কাছে জানতে চেয়েছি, আপনাদের জিতে যাওয়া চেয়ারম্যান কী রকম খরচ করেছেন?
উত্তরগুলো গড় করে ৪০ থেকে ৫০ লাখের কম খরচের বিবরণ কোথাও পাইনি। যখনই প্রশ্ন করেছি, এত টাকা খরচ করে তাঁদের কী লাভ? উত্তরদাতারা হেসেছেন। লাভালাভের পথঘাট জানিয়েছেন। উত্তরগুলো এতটাই অসম্মানজনক, পত্রিকার পাতায় বা জনপরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সিংহভাগের নির্বাচন খরচের চেয়েও কম। কমিশন খরচের একটি কাগুজে হিসাব নেবে। চাইলে আমাদের জানাবেও। জিতে যাওয়া ব্যক্তিদের কেউ ২৫ লাখের বেশি খরচ দেখাবেন কি? এবার তো মাঠেই থাকবে প্রবাদের গৌরী সেন। ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’ অবস্থাটি কেন তৈরি হবে? কারণ অসংখ্য।
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আদাজল খেয়ে উঠেপড়ে নেমেছেন অসংখ্যজন। কারণ, তাঁরা বুঝে গেছেন, এ রকম ঘোলা পানি খুব সহজে মেলে না। মাছ শিকারের এটিই মোক্ষম সময়। কে না বোঝে, ভুঁইফোড় নাম না জানা-অজানা অসংখ্য মানুষের একেকজন তিন থেকে চারটি আসনের মনোনয়ন ফরম কিনছেন? প্রতিদিনই ভোটপ্রার্থীর সংখ্যা যে হারে বেড়েছে, অবাক না হয়ে উপায় কী! ভোটপ্রার্থী অর্থাৎ সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের মধ্যে যে রকম ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার জোয়ার-সুনামি, সাধারণ ভোটারদের মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও দেখা মিলছে না।
আমার ব্যক্তিগত যানবাহন নেই। রিকশা-সিএনজিচালিত অটোরিকশা যেটিতেই চড়ি, চালকদের জিজ্ঞাসা করি, ভোটের সময় কোথায় থাকবেন, ঢাকায় না দেশগ্রামে? একজনও পাইনি, যাঁর উত্তর পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে ভোট দেবেনই দেবেন। কয়েকজন সরাসরি জানালেন, ভোট তাঁরা দিতে হয়তো দিতে পারেন, তবে সে জন্য তাঁদের টাকাপয়সা দিয়ে খুশি রাখতে হবে। বড় নোট না দিলে শুধু শুকনা কথায় এবার চিড়ে ভিজবে না।
একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ রকম অনৈতিক কাজটি করবেন? তাঁর উত্তর ছিল, কে নৈতিক কাজ করছে, দেখান। আরেকজন জানালেন, বানোয়াট বিরোধী প্রার্থী কেনাকাটার হাটই যদি বসে যেতে পারে, আমাদেরই কেন ভালো মানুষ হয়ে থাকতে হবে। আমাদের অনৈতিক ভোটের অর্থনীতি ভোটপাগল আমনাগরিককেও টু পাইস কামানোয় উৎসাহিত করে তুলছে। বিষয়টি কি আশঙ্কাজনক নয়?
এবারের নির্বাচনে আগের মতো জনমানবহীন ভোটকেন্দ্র মোটেই দেখানো যাবে না। পত্রপত্রিকা, টিভিতে, ক্যামেরায় প্রমাণ থাকতে হবে ভোটকেন্দ্রে মানুষের ঢল। আন্তর্জাতিক মহলসহ বিদেশি পত্রপত্রিকাতেও ভোটারপূর্ণ কেন্দ্রের ছবি-ভিডিও ছাপার দরকার হবে। তলানিতে থাকা ভোটার-উৎসাহকে চাঙা করতেও টাকার দরকার। আগের নির্বাচনগুলোয় আমরা ভোট কেনার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। এবার ভোটের পাশাপাশি ভোটার কেনার মচ্ছব হবে অনুমান করা যায়।
এই সময়ে ‘উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভরপুর স্বতঃস্ফূর্ত ভোটার’ বলতে রয়েছেন শুধু দলীয় কর্মীরাই। এবারের নির্বাচনে তাঁদের পেছনেও অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি খাইখরচের টাকাকড়ি বিলাতে হবে। কারণ, তাঁরাই আসন্ন নির্বাচন সফল করে তুলতে পারার মূল কারিগর। সুতরাং, তাঁদের দাবিও অন্য সময়ের চেয়ে বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।
নির্বাচনকালে দেশের অর্থনীতি চাঙা হয়ে ওঠে। বাজারে অর্থপ্রবাহ বাড়ে, কিন্তু অর্থপ্রবাহ কোথা হতে শুরু, কোথায় শেষ, বোঝার উপায় থাকে না। বাজারে কালোটাকা নামে বেশি। টাকার সাদাকালো চেনার সহজ উপায় নেই। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান (যেমন ব্যাংক) থেকে নয়, খুঁজে না পাওয়া নানা সূত্র থেকে মুড়িমুড়কির মতো নগদ টাকায় বাজারে সয়লাব হয়। তখনই টের পাওয়া যায় কিছু কিছু ভাগ্যবানের ঘরের সিন্দুক-আলমারিও কম বড় টাঁকশাল নয়।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় একই আসনে একই দল থেকে একাধিক প্রার্থীর প্রার্থী হওয়ার প্রতিযোগিতা অনুচিত কিছু নয়। শেষ পর্যন্ত দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে চূড়ান্ত হওয়া প্রার্থীরাই নির্বাচন করবেন। অন্যদের দলীয় শৃঙ্খলা মেনে নিতে হয়। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার যে উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে তাতে দলের মনোনীত প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হতে পারে স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়ানো তারই দলের প্রার্থীর সঙ্গে।
এবার প্রতিটি আসনের বিপরীতে আওয়ামী লীগ থেকে গড়ে ১১ জন মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। কেউ কেউ নিজেকে জনপ্রিয় মুখ ভেবে, জিতবেনই বিশ্বাসে তেমনটি করবেন। কেউ কেউ শুধুই কামানোর ধান্দায় দর-কষাকষিতে লেগে থাকবেন। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিয়েও অনেকে প্রার্থী হবেন। তারপর চলবে সরে দাঁড়ানোর দরদাম-দামাদামি। অবস্থা এখন আরও সহজ হয়ে এসেছে। খবর হয়েছে, শাসক দলের বিকল্প প্রার্থীই নয়, প্রতিদ্বন্দ্বীদেরই বৈধ ঘোষণা হতে পারে।
ঘাটে ঘাটে অপরাধী চক্রও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার নাম করে দালালি-বাণিজ্যে নামা চক্রের দু-একজন ধরাও পড়ছে অপরাধ দমন বিভাগ ও গোয়েন্দা সদস্যদের হাতে। নির্বাচনের অর্থনীতিতে চাঁদাবাজিরও বড় ভূমিকা থাকে। আবার নিজেদের চাঁদাবাজির হাত থেকে রক্ষার চালাকির বিষয়ও থাকে।
এ বিষয়ে একটি বহুল প্রচলিত গল্প আছে। সত্য হোক বা বানোয়াট হোক, গল্পটি এমন: একজন সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন। সালটি সম্ভবত ১৯৯৫। সাংবাদিকেরা তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার জেতার সম্ভাবনা কতটা?’ তিনি উত্তর দিলেন, একেবারেই সম্ভাবনা নেই। কৌতূহলী সাংবাদিকের পাল্টা প্রশ্ন, মোটেই সম্ভাবনা নেই জেনেও কেন নির্বাচন করছেন। তাঁর উত্তর, নির্বাচন করছি, কারণ পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকায় আমার প্রচার-প্রচারণা, পোস্টার, নাম কামাই সবই হয়ে যাবে। নির্বাচন না করলে ঘাটে ঘাটে প্রার্থীদের চাঁদাই দিতে হবে নিজের খরচের কয়েক গুণ বেশি।
তবে লাভবান হতে চাইলেই সবাই এ অর্থনীতি থেকে লাভবান হবেন না। দেখা যাবে অনেকের পকেটেও কিছু আসবে না, ভবিষ্যৎও খোয়াবেন। রাজনীতির ভাড়াটে হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কলঙ্কই হয়ে উঠবে কারও কারও নিয়তি। সবচেয়ে বড় বিপদের কথা, চলতি নির্বাচনী গৌরী সেনের নোট বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়ণের বেলায় দীর্ঘস্থায়ী চোট তৈরি করে বসবে।
হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।