‘আমরা এমনভাবে গুগলি দিয়েছি যে প্রতিপক্ষ বোল্ড হয়ে গেছে।’
‘গুগলি তো করেছেন, কিন্তু বল তো নো বল। নো বলে বোল্ড হবে না।’
‘আপনাদেরকে নো বলে কিংবা এলবিডব্লিউ দিয়ে আউট করব না। বরং মিডল স্টাম্প উড়িয়ে দিয়ে পতন ঘটানো হবে।’
ওপরের তিনটা লাইন পড়লে যে কারও মনে হতে পারে, ক্রিকেট খেলা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। খেলার দুই পক্ষ একে অপরকে হুংকার দিচ্ছে।
কিন্তু যাঁরা বাংলাদেশের রাজনীতির হালনাগাদ খবর রাখেন, তাঁরা জানেন ওপরের কথাগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের। সর্ববৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা পরস্পরের বিরুদ্ধে এই বাক্যবাণ ছুড়ে দিচ্ছেন। গত কয়েক দিনে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির তিনজন জ্যেষ্ঠ নেতা এই মন্তব্যগুলো করেছেন। রাজনীতির ‘মাঠ’ যেন পরিণত হয়েছে সত্যিকারের ‘খেলার মাঠে’।
নানা উৎকণ্ঠায় থাকা জনতা রাজনীতির মতো ‘সিরিয়াস’ বিষয়ে খেলার মতো ‘খেলো’ বিষয় চলে আসায় বেশ আমোদও পাচ্ছে। কেউ কেউ দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছেন, কোনো একজন নেতা হাত ঘুরিয়ে লেগ স্পিন করছেন। সেই বল খেলতে গিয়ে বোল্ড হলেও অপর পক্ষের নেতা পরক্ষণেই হেসে ফেলে আম্পায়ারের দিকে দেখাচ্ছেন। বলছেন, দেখো, দেখো নো বল।
ওদিকে কাভারে দাঁড়ানো পেস বোলার, বিপুল রাগে বলছেন—হাতে বলটা পাই, সামনের ওভারেই ব্যাটারের স্টাম্প উড়িয়ে দেব। অন্যদিকে প্যাভিলিয়ন থেকে ব্যাটিং দলের একজন খেলোয়াড় চিৎকার করে বলছেন, খেলা হবে! খেলা হবে!
‘খেলার মধ্যে রাজনীতি মেশাবেন না’, এই আলাপ প্রায়ই শোনা যায়। বলার চেষ্টা করা হয়, খেলাধুলা একটি নির্দোষ বিনোদন। এতে রাজনীতির মতো ‘কলুষিত’ ব্যাপার মেশানো ঠিক নয়। কিন্তু আধুনিক যুগে ব্যাপারটা একটা ডাহা অপলাপ। ‘খেলা’ বিষয়টা এখনকার দিনে আর শিশুতোষ নেই। বরং আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় এক দেশ যখন আরেক দেশের বিরুদ্ধে খেলে, তখন তা হয়ে ওঠে দুই দেশের সম্মানের লড়াই। অনেকটা আগের দিনে যুদ্ধের মতো।
এইখানে কিছু ‘অপ্রয়োজনীয়’ নিয়ম মানতে হয়। নিয়মিত নির্বাচন করতে হয়, জনতাকে খুশি রাখতে হয়, জনতাকে জবাবদিহি করতে হয়। আগের দিনের রাজা-বাদশাহদের মতো যা খুশি করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা যায় না, জোর করে কাউকে ক্ষমতা থেকে সরানো যায় না। নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য জনতাকে ভোগান্তি দেওয়া যায় না। আগের দিনের রাজা আর জমিদারদের দৃষ্টিতে দেখলে, এই সব কাজ ‘খুবই অপ্রয়োজনীয়’। সাধের ক্ষমতা পাওয়ার পথে ‘ফালতু’ বাধা।
আবার কোনো এক যুগে নানা রকম দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরস্পরকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হতো, বিজয়ীরা পেতেন রাজত্ব, ক্ষমতা আর পরাজিতরা লাঞ্ছনা। এখনকার দিনে তলোয়ারের যুদ্ধ ফ্যান্সিং আর মল্লযুদ্ধ রেসলিং এগুলো আর ‘সিরিয়াস’ বিষয় না থেকে হয়ে গেছে একেকটা খেলার ইভেন্ট।
ফলে দেশের মূলধারার রাজনীতি যদি ক্রিকেট ম্যাচ হয়ে ওঠে, বিবর্তনের ধারায় ব্যাপারটা মন্দ হয় না। অবশ্য কাদের, ফখরুল আর রিজভী সাহেবরা ব্যাট বল হাতে নিয়ে মাঠে নেমে খেলছেন কল্পনায় ব্যাপারটা দারুণ লাগলেও বাস্তবে তা সম্ভব নয়। উচিতও নয়। এই মুরব্বি মানুষগুলো হাত ঘুরিয়ে বল করতে গিয়ে, সপাটে ব্যাট চালাতে গিয়ে কাঁধে চোট পেলেন কিংবা ঝাঁপিয়ে বল ধরতে গিয়ে হাড়গোড় ভেঙে ফেললেন এই ঝুঁকি নেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না।
তাহলে রাজনীতি ব্যাপারটা ক্রিকেট হয়ে উঠুক তা চাইছি কেন?
একটু তলিয়ে দেখা যাক। খেলাধুলা নিয়ে সবচেয়ে ভালো সংজ্ঞা দিয়েছেন দার্শনিক বার্নার্ড সুইটস। দ্য গ্রাসহুপার: গেমস, লাইফ অ্যান্ড ইউটোপিয়া গ্রন্থে সুইটস বলেন, ‘খেলা হচ্ছে স্বেচ্ছায় এমন এক ব্যাপারে অংশগ্রহণ, যার উদ্দেশ্য অপ্রয়োজনীয় বাধাগুলো অতিক্রম করা।’
ব্যাখ্যা করা যাক। যেকোনো খেলায় আসলে কী হয়? একধরনের নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়। দুই দলের খেলোয়াড়েরা এই নিয়মের মধ্যে কিছু শর্ত পালন করার প্রতিযোগিতায় নামেন। যাঁরা বেশি করতে পারেন, তাঁরাই বিজয়ী হন।
গলফ খেলাটা দিয়ে সবচেয়ে সহজে বোঝা যায়। ধরে নিলাম, গলফ খেলা বোঝে না এমন কাউকে বলা হলো, তোমার কাজ হচ্ছে এই বলটাকে ওই দূরের গর্তে ফেলা । ওনার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া কী হবে? দৌড়ে বা হেঁটে গিয়ে বলটাকে হাতে করে গর্তে ফেলা।
কিন্তু না! গলফের নিয়ম হচ্ছে, এই ‘স্বাভাবিক’ ব্যাপারটা ঘটানো যাবে না। এর জন্য একটা বিশেষ ধরনের লাঠি ব্যবহার করতে হবে, সেই লাঠিটাকে আবার বিশেষ কায়দায় ঘুরিয়ে বলটাকে মারতে হবে। এইভাবে শর্ত মেনে যিনি সবচেয়ে কম বার মেরে বলটাকে গর্তে ফেলতে পারবেন, তিনিই বিজয়ী।
এইবার একই ব্যাপার আমরা ক্রিকেট বা ফুটবল কিংবা দুনিয়ার অন্য যেকোনো খেলার বেলায় বিবেচনা করি।
ফুটবলে বলা হয়, ওই দূরের কাঠি দুইটার ভেতর বলটাকে প্রবেশ করাতে হবে। এখন, আমি যদি ফুটবলের আইন না মেনে বলি, আমার তো অনেক গায়ের জোর, আমি প্রতিপক্ষের সবাইকে জোর করে ধরে রেখে হাত দিয়ে বলটাকে পোস্টের ভেতর জালে জড়াব, তাহলে আর সেটা ফুটবল খেলা থাকে না। ক্রিকেটেও তাই।
এই কারণেই, আরেকজন বিখ্যাত ক্রীড়া দার্শনিক জোহান হুইজিংগা বলেন, খেলাধুলা হচ্ছে মানুষের সৃষ্টিশীলতা ও নিয়মানুবর্তিতার চূড়ান্ত উদাহরণ। যে মুহূর্তে আমি ‘খেলার স্পিরিট’ নষ্ট করে দিচ্ছি, সেই সময় আর তা খেলা থাকে না।
মেলাতে গেলে, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, রাজনীতি ব্যাপারটা খেলার মতোই।
এইখানে কিছু ‘অপ্রয়োজনীয়’ নিয়ম মানতে হয়। নিয়মিত নির্বাচন করতে হয়, জনতাকে খুশি রাখতে হয়, জনতাকে জবাবদিহি করতে হয়। আগের দিনের রাজা-বাদশাহদের মতো যা খুশি করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা যায় না, জোর করে কাউকে ক্ষমতা থেকে সরানো যায় না। নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য জনতাকে ভোগান্তি দেওয়া যায় না। আগের দিনের রাজা আর জমিদারদের দৃষ্টিতে দেখলে, এই সব কাজ ‘খুবই অপ্রয়োজনীয়’। সাধের ক্ষমতা পাওয়ার পথে ‘ফালতু’ বাধা।
কিন্তু খেলতে নেমে এই সব করলেই, ‘ফাউল’ হয়। খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাঁরা হেরে যান।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রাজনীতিতে বেশির ভাগ সময়েই ‘ফাউল প্লে’ করা হয়। রেফারির মতো জনতার যথেষ্ট ক্ষমতা না থাকায়, খেলার স্পিরিটকে কাঁচকলা দেখানোরা জিতে যায়।
ফলে আমাদের সিনিয়র নেতারা যখন রাজনীতির মাঠকে খেলার মাঠ বানাতে চাইছেন, এর চেয়ে খুশির ব্যাপার আর হয় না। আমরা আশা করি, তাঁরা ‘খেলোয়াড়ি চেতনা’ মেনেই খেলবেন।
দোহাই আপনাদের, আপনারা রাজনীতির সঙ্গে খেলা মিশিয়ে ফেলুন।
সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক