যে ফর্মুলায় জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন এরদোয়ান

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সার্বিয়া সফরে যাচ্ছেন
ছবি : রয়টার্স

তুরস্কের সেক্যুলার ও পশ্চিমাভাবাপন্ন সমাজকে হতাশ করে দিয়ে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আবার তাঁর নিজের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করলেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি প্রায় জিতে গিয়েছিলেন। ২৮ মে দ্বিতীয় রাউন্ডের ভোট এবং তাতে তিনিই জয়ী হবেন বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। তবে এমনটা একেবারেই প্রত্যাশিত ছিল না।

নির্বাচনের আগে বেশির ভাগ জরিপ বলছিল, এবার এরদোয়ান যুগের সমাপ্তি হতে যাচ্ছে। তুরস্কে মুদ্রাস্ফীতি তিন সংখ্যায় উঠে যাওয়া, সরকারের অযোগ্যতাকে প্রকাশ করে দিয়ে ভূমিকম্পে অর্ধলক্ষের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটা, বিরোধী দলগুলোর এক হওয়া এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নাজুকাবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল ক্ষমতার পালাবদল ঘটবে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেছিলেন, ‘রোটি-কাপড়া-মকান’ ইস্যু সামনে নিয়ে আসা সেক্যুলার নেতা কেমাল কিলিচদারওলু আরামসে জিতে যাবেন। কিন্তু বিরোধীদের সেই আশা ও উচ্ছ্বাসের আগুনে এরদোয়ান পানি ঢেলে দিয়েছেন। তবে খেলা শেষ হয়ে যায়নি। কিলিচদারওলু প্রথম রাউন্ডে ৪৪ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন এবং দ্বিতীয় রাউন্ডে তাঁর জেতার সম্ভাবনা একেবারেই নেই—এমনও নয়। কিন্তু পরিস্থিতি এখন তাঁর বিরুদ্ধে।

এরদোয়ানের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী জোট ইতিমধ্যে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। তাঁর সঙ্গে দৌড়ে দৃশ্যত কিলিচদারওলু পিছিয়ে পড়েছেন এবং সে কারণে বিরোধীদের মধ্যে হতাশা ক্রমে বেশি তীব্র হচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, এরদোয়ানের এই জনপ্রিয়তা ধরে রাখার কী ব্যাখ্যা হতে পারে? এককথায় এর জবাব হলো দেশবাসীর মধ্যে মেরুকরণে তাঁর অসম্ভব সক্ষমতা এর পেছনে কাজ করেছে। তিনি ভালো করেই জানেন, একমাত্র জাতীয়তাবাদের তাসই তাঁকে এই খেলায় জয় এনে দিতে পারে। সে কারণে তিনি বিভাজনকে নতুন উচ্চতায় নেওয়ার জন্য নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে গেছেন।

হ্যাঁ, সন্দেহ নেই তুর্কি অর্থনীতি খুব খারাপ অবস্থায় আছে, মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার ইস্যু জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি এবং পরিচয়ের রাজনীতিকে ছাপিয়ে যাবে—এমনটি মনে করায় দুটি সমস্যা ছিল। প্রথমত, বিরোধীরা এটি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে যে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদের সঙ্গে যে সরকারের তৈরি করা জাতীয় নিরাপত্তার হুমকির যোগসূত্রের কথা প্রচার করা হয়েছে, সেটিকে খণ্ডন করা তাদের জন্য সবচেয়ে জরুরি ছিল।

কুর্দিশ পার্টি তাদের নিজস্ব প্রার্থী দাঁড় না করিয়ে কিলিচদারওলুকে প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দেওয়ায় এরদোয়ানের জয় সহজ হয়ে গেছে। কুর্দিদের দল পিপলস ডেমোক্রেসি পার্টি একটি বৈধ রাজনৈতিক দল যারা সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করে থাকে। কিন্তু তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা সন্দেহ করেন, এই দলটির সঙ্গে সন্ত্রাসীদের যোগসাজশ রয়েছে।

বড় ডিজিটাল পর্দায় নেতিবাচক নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় এরদোয়ান ক্রমাগত দেখিয়ে এসেছেন, কুর্দিরা কিলিচদারওলুর প্রার্থিতাকে মহিমান্বিত করছে। জাতীয়তাবাদের মেরুকরণের বাইরেও এরদোয়ান ধর্মকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি ক্রমাগত সেক্যুলার বিরোধীদের সমকামিতা-সমর্থক ও মুসলিম পারিবারিক বন্ধনের বিরোধী শক্তি হিসেবে দেখিয়েছেন।

সংবাদমাধ্যমের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এরদোয়ান নির্বাচনে বিরোধীদের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা নিশ্চিত করতে পেরেছেন। তাঁকে ভোট চুরি করতে হয়নি। তিনি শুধু তাঁর প্রোপাগান্ডা মেশিনের ওপর নির্ভর করেছেন এবং রক্ষণশীল মুসলমানদের সঙ্গে সম্পর্ককে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। অন্যদিকে কিলিচদারওলু তাঁর প্রচারণা-বার্তা হিসেবে অর্থনৈতিক মন্দার প্রচারের ওপর খুব বেশি নির্ভর করেছেন বলে মনে হয়েছে।

হ্যাঁ, সন্দেহ নেই তুর্কি অর্থনীতি খুব খারাপ অবস্থায় আছে, মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার ইস্যু জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি এবং পরিচয়ের রাজনীতিকে ছাপিয়ে যাবে—এমনটি মনে করায় দুটি সমস্যা ছিল। প্রথমত, বিরোধীরা এটি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে যে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদের সঙ্গে যে সরকারের তৈরি করা জাতীয় নিরাপত্তার হুমকির যোগসূত্রের কথা প্রচার করা হয়েছে, সেটিকে খণ্ডন করা তাদের জন্য সবচেয়ে জরুরি ছিল।

কুর্দি ইস্যু তুর্কি জনগণের কাছে খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। সিরিয়া এবং তুরস্কে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে বেশির ভাগ তুর্কি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে থাকেন। এ কারণে কুর্দিদের সমর্থন কিলিচদারওলুর জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে।

দ্বিতীয় সমস্যা হলো, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে তুরস্কের অর্থনৈতিক মন্দাকে সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হিসেবে তুলে ধরাটা যথার্থ হয়নি। এরদোয়ান অর্থনীতিকে পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন—এই ভাষ্যকে প্রতিষ্ঠা করার মতো যথেষ্ট আলামত বিরোধীরা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেনি।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • ওমর তাসপিনার ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি এবং জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধ্যাপক