নির্যাতনের ঘটনা কাউকে বললে বুয়েটের শিক্ষার্থী আরবারের পরিণতির মতো পিটিয়ে হত্যা করা হবে বলে হুমকিও দেওয়া হয়
নির্যাতনের ঘটনা কাউকে বললে বুয়েটের শিক্ষার্থী আরবারের পরিণতির মতো পিটিয়ে হত্যা করা হবে বলে হুমকিও দেওয়া হয়

মতামত

‘কোন বাপে সিট দেবে’ বলার ঔদ্ধত্য ছাত্রলীগকে কে দিল

প্রাণহীন জাতীয় রাজনীতির মাঠ খানিকটা সরগরম হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজপথে কার কত শক্তি, তা প্রদর্শনের ঘোষণা দিয়েছে। গণতন্ত্র মঞ্চ এবং বামজোটও তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে; যদিও ইসলামি দলগুলো এখনো চুপচাপ দূরত্বে আছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছরের একটু বেশি সময় বাকি। সে কারণেই রাজনীতির এই উত্তাপ সরাসরি মাঠের উত্তাপ না হওয়ার সুযোগই বেশি। তবে ছাত্রলীগের কাছে বাগ্‌যুদ্ধ হয়তো সত্যিকারের যুদ্ধের বার্তা হিসেবে গেছে। উত্তেজনা আর চাপ তাদের আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। গত সপ্তাহজুড়ে গণমাধ্যমে ছাত্রলীগ একের পর এক নেতিবাচক শিরোনামের বিষয়বস্তু হচ্ছে।

প্রথম ঘটনাটি ১৮ আগস্ট রাতের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মেফতাহুল মারুফ মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে সম্প্রতি ছাত্রলীগের একটি কর্মসূচির কারণে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে—এমন অভিযোগ করে মন্তব্য লেখেন তিনি। ২০০৫ সালে দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলার প্রতিবাদে কর্মসূচিটির আয়োজক ছিল ছাত্রলীগ। মেফতাহুল লেখেন, ‘সিরিজ বোমা হামলা চালাইছে জামাআতুল মুজাহিদীন নামের একটি জঙ্গি সংগঠন বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে। সেই সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত। ক্ষমতায় থাকার জন্য যদি তারা দায়ী হয়, তাহলে ২০০৮-বর্তমানে গুলশানসহ সব জঙ্গি হামলার জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ।’

প্রতিটি ঘটনাই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে, নাগরিকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধ। কিন্তু ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলোর এই অপরাধ, অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত নয়। নব্বইয়ে এরশাদের সামরিক শাসন পতনের পর গত তিন দশকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিরোধী মতের শিক্ষার্থীদের দমনের হাতিয়ার হিসেবে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ব্যবহার করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন কিংবা ভিন্নমত দমন সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন।

মেফতাহুলের এ মতকে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড ও জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততার মতো গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে জিয়াউর রহমান হলের ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী তাঁকে ধরে প্রাধ্যক্ষের কাছে নিয়ে যান। প্রাধ্যক্ষ মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন ছাত্রলীগের কথার ওপর ভিত্তি করে আর কোনো কিছু বিবেচনা না করেই মেফতাহুলকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। পুলিশি হেফাজতে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে মামলা করার মতো ‘পর্যাপ্ত উপাদান’ না পাওয়ায় গত শুক্রবার দুপুরে শিক্ষকদের হেফাজতে ছেড়ে দেওয়া হয়। মুক্তির পর শাহবাগ থানা থেকে তাঁকে নিয়ে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে ছাত্র অধিকার পরিষদের দুই নেতা হামলার শিকার হন।

দ্বিতীয় ঘটনাটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। ১৯ আগস্ট বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মতিহার হলে ছাত্রলীগের এক নেতা এক শিক্ষার্থীকে আটকিয়ে ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে ২০ হাজার টাকা কেড়ে নেন। নির্যাতনের ঘটনা কাউকে বললে বুয়েটের শিক্ষার্থী আরবারের পরিণতির মতো পিটিয়ে হত্যা করা হবে বলে হুমকিও দেওয়া হয়। প্রথম আলোর খবরে জানা যাচ্ছে, নির্যাতনের শিকার সামছুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। আর প্রধান অভিযুক্ত ভাস্কর সাহা শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র এবং মতিহার হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।

সামছুল ইসলাম লিখিত অভিযোগে জানান, তিনি মতিহার হলের ১৫৯ নম্বর কক্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ করেন তিনি। সেখান থেকে তিনি বাড়িতেও টাকা পাঠান। রাজশাহীতে এক ছোট ভাইকেও কলেজে পড়াশোনার খরচ দেন। তাঁর কাছে কয়েক দিন ধরেই ছাত্রলীগ নেতা ভাস্কর চাঁদা দাবি করে আসছিলেন। প্রথমে চাঁদা দাবি করেন ১৫ আগস্ট। এর পর থেকে চাঁদা চেয়ে বারবার ফোন দিতে থাকেন। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি। টাকা না দিলে হল থেকেও নামিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয় তাঁকে। ১৯ আগস্ট হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা তাঁকে ফোন করে হলের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে ডেকে নেন। সেখানে ভাস্করের সঙ্গে আরও দুজন ছিলেন। ভাস্করের কক্ষে যাওয়ার পর তিনি তাঁর কাছে চাঁদা দাবি করেন। একপর্যায়ে গলায় ছুরি ধরে মানিব্যাগে থাকা ২০ হাজার টাকা কেড়ে নেন। সে সময় আরও ৬ হাজার টাকা দাবি করলে বিষয়টি সামছুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সাংবাদিকদের অবহিত করবেন বলে তাঁদের জানান। এ কথা শুনে ভাস্করসহ বাকি দুজন রড ও স্টাম্প দিয়ে বেধড়ক মারধর করেন সামছুলকে। একপর্যায়ে ভাস্কর তাঁকে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘কাউকে বললে আবরারের যে অবস্থা হয়েছে, সে অবস্থা হবে।’

জিয়াউর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ মোহাম্মদ বিল্লালের পদত্যাগ দাবিতে সমাবেশ

তৃতীয় ঘটনাটি রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজে। ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় একটি শিক্ষার্থীনিবাসে স্নাতক চতুর্থ বর্ষের কয়েক শিক্ষার্থীকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রীভা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হওয়া অডিওতে শোনা যাচ্ছে, হুমকি দিতে গিয়ে তামান্না শিক্ষার্থীদের বলেছেন, ‘আমি যদি একটা সিট না দিই, তোদের কোন বাপ সিট দেবে? ম্যাডামরা (হল প্রশাসন) দেবে? ক্ষমতা আছে ম্যাডামদের?’

অডিও রেকর্ডে তামান্না জেসমিনকে বলতে শোনা যায়, ‘বেশি চ্যাটাং চ্যাটাং করতেছিস। এক পায়ে পাড়া দিমু, আরেক পা টাইনা ধইরা ছিঁড়া ফেলমু। চার মাস হয়ে গেছে, ফাইজলামি শুরু করছিস। তোরা লিগ্যাল, তাতে আমার...। কোন হ্যাডাম দেখাইতেছিস তোরা? আমার পলিটিক্যাল রুমে তোরা লিগ্যাল থাকবি কি না, সেটা তোদের বিষয়। কে কে টাকা জমা দিছিস? আমারে দিছিস? বুঝিস না পলিটিক্যাল রুমে থাকিস! তোদের লিগ্যাল করাইছে, তাতে আমার...? আমি যদি একটা সিট না দেই, ২০২ থেকে তোদের কোন বাপ সিট দেবে? ম্যাডামরা দেবে? ক্ষমতা আছে ম্যাডামদের?’

চতুর্থ ঘটনাটি ঘটেছে কুষ্টিয়ায়। এ ক্ষেত্রে ফাঁস হয়েছে ভিডিও। শোক দিবসের অনুষ্ঠান থেকে মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে ফিরছিলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া টোল প্লাজার একাধিক সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, সৈয়দ মাস উদ রুমী সেতুর পশ্চিম প্রান্তে টোল প্লাজায় ছাত্রলীগের মোটরসাইকেলের বহরকে থামানোর চেষ্টা করেন সেতুর টোল আদায়ে দায়িত্বে থাকা কর্মচারীরা। এ সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁদের তর্ক হয়। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের কয়েক নেতা-কর্মী মোটরসাইকেল থেকে নেমে টোল প্লাজার এক কর্মচারীকে কিলঘুষি মারতে থাকেন। অন্য কর্মচারীরা প্রতিবাদ করলে ছাত্রলীগের আরও নেতা-কর্মী এসে তাঁদের মারধর করতে থাকেন।

একপর্যায়ে ছাত্রলীগের কয়েক নেতা-কর্মী মোটরসাইকেল থেকে নেমে টোল প্লাজার এক কর্মচারীকে কিলঘুষি মারতে থাকেন।

প্রতিটি ঘটনাই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে, নাগরিকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধ। কিন্তু ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলোর এই অপরাধ, অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত নয়। নব্বইয়ে এরশাদের সামরিক শাসন পতনের পর গত তিন দশকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিরোধী মতের শিক্ষার্থীদের দমনের হাতিয়ার হিসেবে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ব্যবহার করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন কিংবা ভিন্নমত দমন সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। এ ধরনের অপরাধে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শাস্তির বদলে পুরস্কার জোটে। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে আর প্রতিবাদ হলে কাউকে কাউকে নামমাত্র সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার তাঁরা বহাল তবিয়তে ফিরে আসেন।

এ কারণে অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা আরও বেপরোয়া হয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে নিপীড়ন শুরু করে। গত কয়েক দশকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আন্দোলন হয়েছে, তার বেশির ভাগই হয়েছে শিক্ষার্থী নিপীড়নের প্রতিবাদে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় এবারেও শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ওপর ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে সামাজিক নীরবতা ভাঙার সময় এসেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশের সবার করের টাকাতেই চলে। ফলে, কাউকে নিপীড়ন করা কিংবা ‘কোন বাপে সিট দেবে’, এ কথা বলার অধিকার কারও নেই। ছাত্রলীগের নিপীড়ন কেন অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হবে না?

মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
ই-মেইল: monoj.dey@prothomalo.com