আজিজ আহমেদ ও বেনজীর আহমদ
আজিজ আহমেদ ও বেনজীর আহমদ

আজিজ ও বেনজীর তাহলে কাদের লোক

ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম আওয়ামী লীগকে আত্মরক্ষামূলক কৌশল নিতে হচ্ছে। আগে যেকোনো বিষয়ে তারা বিএনপির বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কথা বলত। ব্যাংক থেকে টাকা লোপাট হচ্ছে। এর জন্য বিএনপি দায়ী। বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে, বিএনপিই এটা প্রথম করেছে। ভোটারবিহীন ভোট হচ্ছে, জিয়াউর রহমান এর সূচনা করে গেছেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র‍্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। এর জন্যও বিএনপি দায়ী। তারাই র‍্যাব তৈরি করেছিল।

কিন্তু সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ ও পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমদের বিরুদ্ধে অনীত অভিযোগ এতই গুরুতর যে তাদের পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতারা কোনো যুক্তিই দিতে পারছেন না। দায়িত্ব এড়াতে প্রথমে তাঁরা বললেন, আজিজ ও বেনজীরের অপরাধ ব্যক্তিগত, সরকার এর দায় নেবে না

কিন্তু যখন সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের আইডি কেলেঙ্কারি ধরা পড়ল ও পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের আলাদিনের চেরাগ বের হতে থাকল, তখন সরকার আরও বিব্রত হলো।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘বেনজীর আমাদের দলের লোক নয়। জ্যেষ্ঠতা ও মেধা নিয়ে সে আইজিপি হয়েছে। আজিজও আমাদের দলের লোক নয়। তাঁর যোগ্যতায় ও জ্যেষ্ঠতার কারণে সেনাপ্রধান হয়েছেন। এখন ভেতরে তাঁরা যদি কোনো অপকর্ম করেন, এটা যখন সরকারের কাছে আসে তখন তাঁদের বিচার করার সৎ সাহস শেখ হাসিনার আছে।’

এর আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, আজিজ-বেনজীর আওয়ামী লীগেরই সৃষ্টি। সরকারে অসংখ্য আজিজ ও বেনজীর আছেন। কাদের সাহেব মির্জা সাহেবের অভিযোগের সরাসরি জবাব না দিয়ে বিএনপির আমলে কী কী দুর্নীতি হয়েছে, কজনকে ডিঙিয়ে মইন উ আহমদকে সেনাপ্রধান করা হয়েছিল, সেই ফিরিস্তি দিলেন।

তবে তিনি কেবল বিএনপির ওপরই ক্ষুব্ধ হননি। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন টিআইবি ও সুজনের বিরুদ্ধেও। বলেছেন, ‘আজ টিআইবি একটা আছে, সুজন আছে, সুজন না কুজন জানি না। ফখরুল, গয়েশ্বর যে সুরে কথা বলে, তারাও একই সুরে কথা বলে। আজ মানুষের প্রশ্ন, টিআইবি ও সুজন কি বিএনপির “বি” টিম? যে সুরে কথা বলে, কোনো পার্থক্য নেই, একই সুরে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে।’

আওয়ামী লীগ এখন বিএনপির সঙ্গে টিআইবি ও সুজনের সাজুয্য খোঁজে। বিরোধা দলে থাকতে তাদের বিবৃতি ও তথ্যকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এটাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি।

বিএনপি আমলে টিআইবির আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশকে পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করেছিল। এর একবার আওয়ামী লীগ আমলে, চারবার বিএনপির আমলে। আওয়ামী লীগ আমলে ২০০১ সালে যখন টিআই বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে, ক্ষমতাসীনেরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিল এবং নির্বাচনের আগে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেছিলেন। এরপর বিএনপির আমলে টিআইয়ের প্রতিবেদনে পরপর চারবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হলে বিএনপির নেতারাও একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন বিএনপি আমলে সৎ প্রার্থী আন্দোলন করলে বিএনপির নেতারা এর মধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজেছিলেন। সুজনের সৎ প্রার্থী আন্দোলনের কথা যে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কেউ শোনেনি, সেটা অষ্টম, নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদের কোনো কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধির কর্মকাণ্ডই প্রমাণ করে।

কাদের সাহেবের যুক্তি মেনে নিলে বিএনপি আমলে সংঘটিত গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার দায়ে সেই সরকারের যেসব কর্মকর্তা দণ্ডিত হয়েছেন, সে জন্য বিএনপির সরকার ও দলকেও দায়ী করা যায় না। ক্ষমতাকাঠামোর ভেতরে থেকে কেউ অপরাধ করলে,তার দায় ক্ষমতাসীনদের নিতেই হবে।  

সম্প্রতি দ্বাদশ সংসদের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের হত্যার ঘটনায় যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে, সেটা সরকার কিংবা সরকারি দল কারও জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। আনোয়ারুল আজীম একসময় জাতীয় পার্টি করতেন। পরে বিএনপির নেতা হিসেবে পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগে এসে সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি ডবল প্রমোশন পেলেন। এ রকম প্রমোশন পাওয়া নেতা বর্তমান সংসদে আরও আছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, সাবেক পুলিশ ও সেনাপ্রধান তাদের দলের কেউ নন। এক অর্থে তিনি ঠিকই বলেছেন। বাকশাল আমলে সেনা ও পুলিশপ্রধানকে দলের সদস্য হতে হতো। কিন্তু এখন তো আনুষ্ঠানিক বাকশাল নেই। তাই, সরকারি চাকরিতে থাকতে কেউ আওয়ামী লীগের সদস্য হতে পারেন না।  কিন্তু বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা যতটা না আওয়ামী লীগার ছিলেন, তার চেয়ে বেশি আওয়ামী লীগার হিসেবেই তাঁরা নিজেদের তুলে ধরেছেন। কাজে ও কথায়।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর অনেক পুলিশ কর্মকর্তা বড়াই করে বলতেন, ‘আমরাই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছি।’ এ ধরনের বক্তব্যের জন্য কোনো কর্মকর্তাকে শাস্তি পেতে হয়নি। বরং অনেকে পুরস্কৃত হয়েছেন।

সেই সময়ে যদি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কিংবা অন্য কোনো নেতা বলতেন, ‘তাঁরা আমাদের লোক নন’, তাহলে দেশবাসী তাঁদের প্রশংসা করতেন। এখন দুই সাবেক ‘সিপাহসালার’ ধরা পড়ার পর আওয়ামী লীগ যতই বলুক ‘তাঁরা আমাদের লোক নন’, কেউ বিশ্বাস করবেন না।

বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হলো, ক্ষমতাসীনেরা দল ও সরকারের পার্থক্যটা মনে রাখেন না। সব আমলেই দলীয়করণ হয়েছে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেই মাত্রা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে।

ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে আজিজ আহমেদ সেনাপ্রধান ও বেনজীর আহমেদ পুলিশপ্রধান হয়েছেন। কিন্তু সেই মেধা তারা কী কাজে লাগিয়ছেন? দেশের বিভিন্ন স্থানে জমিদারি কেনায়! ভূয়া পরিচয়ে ভাইকে পাসপোর্ট করে দেওয়ায়। যদি তাঁরা ভালো কাজ করে থাকেন( যার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ) তার কৃতিত্ব যেমন ক্ষমতাসীনেরা নেবেন, তেমনি, মন্দ কাজের দায়ও তাদের নিতে হবে।

কাদের সাহেবের যুক্তি মেনে নিলে বিএনপি আমলে সংঘটিত গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার দায়ে সেই সরকারের যেসব কর্মকর্তা দণ্ডিত হয়েছেন, সে জন্য বিএনপির সরকার ও দলকেও দায়ী করা যায় না। ক্ষমতাকাঠামোর ভেতরে থেকে কেউ অপরাধ করলে,তার দায় ক্ষমতাসীনদের নিতেই হবে।  

প্রথম আলোর খবরে দেখলাম, স্বামীদের মতো ভুয়া তথ্য দিয়ে ই-পাসপোর্ট নিয়েছেন হারিছ আহমেদের স্ত্রী দিলারা হাসান ও তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফের স্ত্রী শামীম আরা খান। দিলারা হাসান তাঁর ই-পাসপোর্টে স্বামীর নাম লিখেছেন মোহাম্মদ হাসান। বাস্তবে স্বামীর নাম হারিছ আহমেদ। আর শামীম আরা খান স্বামীর নাম লিখেছেন তানভীর আহমেদ তানজীল। স্বামীর প্রকৃত নাম তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ।

সরকারি পদে না থাকলে আজিজ আহমেদও দণ্ডিত ভাইদের ‘ত্রাতা’ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারতেন না। বেনজির আহমদও পুরো বাংলাদেশকে ‘নিজস্ব সম্পত্তি’ মনে করতেন না।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি