মতামত

ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের কীভাবে শাস্তি দেওয়া যায়

বহু টানাপোড়েন ও গড়িমসির পর ২০২৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইনে সংশোধনী এনে ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করা ও তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। আইনটির খসড়া প্রণয়ন শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে। কিন্তু কাজটি চার বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখার কারণেই গড়িমসির বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ কথা স্পষ্ট যে বিশেষ সুবিধাভোগী মহল এই আইন চালুর বিপক্ষে ছিল।

এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, ভারতে এই আইন প্রথম জারি হয় ১৯৯৯ সালে, অর্থাৎ আমাদের ২৪ বছর আগে।

বাংলাদেশের এই আইনে তাঁরাই ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসেবে গণ্য হবেন, যাঁরা (১) ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরিশোধ করেন না, (২) জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ গ্রহণ করেন, (৩) যে উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল, তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে বা ব্যবসায় সেই ঋণ ব্যবহার করেন এবং (৪) ঋণের বিপরীতে দেওয়া জামানত ব্যাংকের অগোচরে অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলেন।

ওপরের শর্তগুলো মেনে কোনো ঋণগ্রহীতাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করার কঠিন কাজটি ব্যাংকারদেরই করতে হবে। খেলাপি নির্ধারণ কিংবা ঋণ শ্রেণীকরণের কাজগুলোও সুনির্দিষ্ট গাণিতিক নীতিমালায় ব্যাংকাররাই করে থাকেন। কিন্তু ইচ্ছাকৃত খেলাপি হওয়ার চারটি শর্তের মধ্যে দুটি অপেক্ষাকৃত সহজ হলেও প্রথম ও তৃতীয়টির প্রয়োগ ব্যাংকারদের জন্য সত্যিকারের চ্যালেঞ্জিং কাজ হবে।

প্রথম শর্ত, অর্থাৎ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করার শর্তটির প্রমাণ দেওয়া কঠিন। কারণ, সামর্থ্য থাকা বা না-থাকার বিষয়টি প্রমাণ করার কোনো একক সূত্র বা নীতিমালা নেই। আমাদের দেশে ঋণখেলাপিরা ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে পারেন না, অথচ তাঁদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, দামি গাড়ি, সন্তানদের বিদেশে পড়ানো কিংবা বিজনেস ক্লাসে বিদেশভ্রমণ—কোনোটিই বন্ধ হয় না।

এসব বিষয় প্রমাণ হিসেবে টেকানোর জন্য আইনি ভিত্তির প্রয়োজন হবে কি না, ভেবে দেখা দরকার। খেলাপি ঋণসংশ্লিষ্ট ব্যবসাটি বন্ধ বা রুগ্‌ণ হয়ে পড়লেও গ্রহীতার অন্য ব্যবসা ঠিকমতো চলছে, এমন অবস্থাকে সামর্থ্য থাকা হিসেবে গণ্য করা যাবে কি না, সে বিষয়েরও সুরাহা করা উচিত। অর্থাৎ, ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য পরিমাপ করার জন্য একটা সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি প্রণয়ন করা উচিত। এটি না থাকলে ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা ব্যাংকের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আইনি সুরক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়ে যাবেন।

দ্বিতীয়ত, যে উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল, তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে বা ব্যবসায় সেই ঋণ ব্যবহার করার শর্তটি প্রমাণ করাও ব্যাংকারদের জন্য কঠিন হবে। আমাদের দেশের ব্যাংকিং পদ্ধতিতে ওভারড্রাফট নামের যে ঋণ অবাধে দেওয়া হয়, সেখান থেকে অর্থ সরিয়ে নেওয়া খুবই সহজ।

লক্ষণীয়, বলা হয়েছে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নেবে, সেটি স্পষ্ট করে বলা হয়নি। তাদের বিদ্যমান আইন বা বিধিতে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিষয়ে কোনো ‘যথাযথ কার্যব্যবস্থা’ আছে কি না, সেটিও স্পষ্ট নয়। সুতরাং, এটিও তৎকালীন সরকারের একটা লোকদেখানো উদ্যোগ বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

এভাবে তহবিল সরিয়ে নিয়ে অন্যত্র বিনিয়োগ করার অজস্র উদাহরণ রয়েছে। এই প্রবণতার কারণেই অধিকাংশ ঋণ অনিয়মিত ও খেলাপি হয়ে পড়ে। প্রায়ই দেখা যায়, ঋণগ্রহীতা কোনো শিল্পোদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী ঋণের টাকা সরিয়ে নতুন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে দাবি করেন, কোনো ব্যাংকঋণ ছাড়া নিজের টাকায় কিংবা অতি সামান্য ঋণ দিয়ে সেটি গড়ে তুলেছেন তিনি। ক্ষেত্রবিশেষে এই ‘সামান্য’ ঋণও নেওয়া হয় আয়কর বিভাগকে দেখানোর জন্য।

উল্লেখ্য, ওভারড্রাফটের মতো স্বল্পমেয়াদি চলমান ঋণ দেওয়া হয় দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য। কিন্তু নিবিড় নজরদারি করা সম্ভব হয় না বলে সেই ঋণ দিয়ে জমি বা বাড়ি কেনা কিংবা অন্য একটা কারখানা গড়ার মতো গর্হিত প্রবণতা ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে দেখা যায়।

স্বল্পমেয়াদি ঋণকে এভাবে দীর্ঘমেয়াদি সম্পদে পরিণত করার কারণে চালু প্রতিষ্ঠানটি চলতি মূলধনের অভাবে ধুঁকতে শুরু করে। এর ফলে ব্যাংক তার নিজের স্বার্থেই প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আবারও ঋণ দিতে বাধ্য হয়। এ রকম দৃষ্টান্তও পাওয়া যাবে অগণিত।

২০২৪ সালের মার্চ মাসে জারি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম সার্কুলারে মূলত ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনীর সংশ্লিষ্ট অংশগুলোর উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে মাত্র। কিন্তু তাতেও রয়ে গেছে কিছু দুর্বলতা। এই আইনে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের কোনো নিম্নসীমা নেই। এর ফলে ছোট ও মাঝারি ঋণগ্রহীতাদের মধ্য থেকে এই শ্রেণিকে চিহ্নিত করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর অর্থ ও লোকবলের অপব্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। তাই সুপারিশ রাখা যায়, পরবর্তী বিস্তারিত এবং আরও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনায় ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের একটা সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। যেমন ভারতে এই নিম্নসীমা ২৫ লাখ রুপি।

ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নীতিমালায় ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ঋণের টাকা সরিয়ে ফেলার কিছু লক্ষণও বাতলে দিয়েছে। যেমন স্বল্পমেয়াদি চলতি মূলধনের অর্থ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা, ঋণের অর্থ দিয়ে ব্যবসাবহির্ভূত জায়গায় সম্পদ কেনা, গ্রুপের অন্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানে ঋণের অর্থ স্থানান্তর করা, ঋণদাতা ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণসংশ্লিষ্ট ব্যবসার অর্থ লেনদেন করা, অন্য কোনো কোম্পানিতে ঋণের অর্থ লগ্নি করা, গৃহীত ঋণের টাকা যেখানে যতটুকু বিনিয়োগ বা ব্যবহার করার কথা, সেখানে ততটুকু ব্যবহার না করা ইত্যাদি।

আশা করা যায়, পরবর্তী নির্দেশনায় আরও সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও নির্দেশনা দেওয়া হবে। এতে ব্যাংকের পক্ষে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করা সম্ভব ও সহজ হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের যে ধারাবলে এই নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, সেই ধারায় বলা হয়েছে, (ইচ্ছাকৃত খেলাপির) এই সংজ্ঞার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনানুযায়ী নির্দেশনা জারি করতে পারবে।

লক্ষণীয়, ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনীতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে আকারে-ইঙ্গিতে, সরাসরি নয়। অনেকটা যেন ‘জলে নামব, জল ছড়াব, জল তো ছোঁব না।’ বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সংস্থার নিকট ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতার তালিকা প্রেরণ করিতে পারিবে এবং তাহাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস-এর নিকট কোম্পানি নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করিলে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।’

অর্থাৎ, বাংলাদেশ ব্যাংক তালিকা ‘প্রেরণ করিতে পারিবে’ কিংবা ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করিলে’ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে’। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে তৎকালীন সরকারের অনাগ্রহ এ রকম ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানির’ মতো বাক্যের মধ্যেই স্পষ্ট।

মনে হয়, নিষেধাজ্ঞার বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতে সাহসই পাচ্ছিল না তারা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে ব্যাংকিং কোম্পানি আইনে বলা হয়নি, এমন দুটি শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে; একটি সরাসরি, আরেকটি পরোক্ষ ও অস্পষ্ট।

বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননা পাওয়ার যোগ্য হবেন না। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে উচ্চারিত এটিই একমাত্র শাস্তির বিধান, যদিও বিষয়টা প্রায় অবান্তর। কারণ, যাঁরা ইচ্ছাকৃত খেলাপি বলে গণ্য হবেন, তাঁরা রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের তোয়াক্কা করেন না।

আবার সাধারণত যাঁরা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য, তাঁদের ইচ্ছাকৃত খেলাপি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। পরেরটিতে বলা হয়েছে, ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতার তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গাড়ি, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ইত্যাদির নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের বিদ্যমান আইন বা বিধির আওতায় যথাযথ কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।

লক্ষণীয়, বলা হয়েছে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নেবে, সেটি স্পষ্ট করে বলা হয়নি। তাদের বিদ্যমান আইন বা বিধিতে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিষয়ে কোনো ‘যথাযথ কার্যব্যবস্থা’ আছে কি না, সেটিও স্পষ্ট নয়। সুতরাং, এটিও তৎকালীন সরকারের একটা লোকদেখানো উদ্যোগ বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

ওপরের পর্যবেক্ষণগুলো বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নেতৃত্বের আরও সুস্পষ্ট ধারা ও শাস্তির বিধান সংযুক্ত করে দ্বিধাহীনভাবে সংশোধিত নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। এর জন্য ব্যাংকিং কোম্পানি আইন সংশোধনেরও প্রয়োজন পড়বে না। কারণ, আইনটিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা ও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

ফারুক মঈনউদ্দীন লেখক ও ব্যাংকার

fmainuddin@hotmail.com