১৯৬৭ সালের ৭ জুন। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ চলছে। ইসরায়েল জেরুজালেম দখল করে নিয়েছে। হলিউড মুভি স্টাইলে হেলিকপ্টার থেকে প্যারাসুটে ভর করে ইসরায়েলি সেনারা একের পর এক আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডে নামতে থাকলেন। তাঁরা কম্পাউন্ডে অবাক বিস্ময় নিয়ে হেঁটে হেঁটে চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন।
ইসরায়েলি ইহুদি হিসেবে আল আকসা কম্পাউন্ডের মধ্যে এভাবে অস্ত্র হাতে তাঁরা ঘুরে বেড়াতে পারছেন, এটা সেনাদের নিজেদের কাছে বিশ্বাস হচ্ছিল না। পুরো বিষয়টি তাঁদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল।
এ সময় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রধান ধর্মযাজক বা রাবাই শ্লোমো গোরেন (যিনি পরবর্তীতে ইসরায়েলের প্রধান রাবাই হয়েছিলেন) প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফএর (ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স) কমান্ডার জেনারেল উজি নারকিসের কাছে এলেন।
রাবাই গোরেন জেনারেল নারকিসকে বললেন, ‘উমরের মসজিদকে (আল আকসা কম্পাউন্ডের সোনালি গম্বুজওয়ালা মসজিদ; যেটিকে আরবরা বলে ‘কুব্বাতুস সাখ্রা’ আর ইসরায়েলিরা ও পশ্চিমারা বলে, ‘ডোম অব দ্য রক’। ‘কুব্বাতুস সাখ্রা’ ও ‘ডোম অব দ্য রক’-উভয়ের অর্থ ‘শিলা পাথরের গম্বুজ’। বর্তমান কাঠামোটি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর রা. এর জেরুজালেম জয়ের পর নির্মিত হয়েছিল) এক শ কেজির বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার এখনই মোক্ষম সময়। এখনই আমরা এই কাজ শেষ করতে চাই।’
জেনারেল নারকিস তাঁকে ধমক দিলেন, ‘রাবাই, চুপ করুন।’
সামরিক কমান্ডারের ধমকে রাবাই গোরেনের চুপসে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি দমে গেলেন না। তিনি জেনারেল নারকিসকে পীড়াপীড়ির সুরে বলতে লাগলেন, ‘আজকের এই মুহূর্তের যে বিশাল অর্থ, তা আপনি ধরতে পারছেন না। এটি আমাদের কাছে এক বিশাল সুযোগ। এটি এখনই আমরা কাজে লাগাতে পারি; এই মুহূর্তেই পারি। আজ থেকে কালকে গড়ালেই এটি আমাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে।’
এবার জেনারেল নারকিস ভারিক্কি গলায় বললেন, ‘রাবাই, আপনি যদি চুপ না করেন তাহলে আমি আপনাকে এখনই এখান থেকে সোজা জেলে পাঠিয়ে দেব।’
এবার গোরেন চুপ হয়ে গেলেন। তাঁর মুখ কালো হয়ে গেল।
১৯৬৭ সালের ছয় দিন ব্যাপী আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময়কার এই বর্ণনা ঠিক এইভাবে পাওয়া যাবে আমেরিকান বংশোদ্ভূত ইসরায়েলি সাংবাদিক (যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত রাজনীতিবিষয়ক মাসিক পত্রিকা আমেরিকান প্রসপেক্ট-এর সম্পাদক) ও লেখক গেরশোম গোরেনবার্গের লেখা এনড্ অব দ্য ডেজ: ফান্ডামেন্টালিজম অ্যান্ড দ্য স্ট্রাগল ফর দ্য টেম্পল মাউন্ট বইয়ে।
২০১৪ সালের ৬ নভেম্বর দ্য টাইমস অব ইসরায়েল পত্রিকায় ইসরায়েলি বিশ্লেষক ডেভিড হরোভিৎস ‘জেরুজালেম ইন দ্য আনহোলি গ্রিপ অব রিলিজিয়াস ফেভার’ শীর্ষক একটি বিশ্লেষণধর্মী লেখায় এ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন।
তো, লেখক গেরশোম গোরেনবার্গ বর্ণনা দিচ্ছেন, রাবাই গোরেন মাথা নিচু করে চলে গেলেন।
এর তিন দিন পর ১০ জুন ইসরায়েলের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে দায়ান হারাম আল শরিফের (আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ড যে পাহাড়ের ওপর, সেটিকে আরব ও মুসলমানেরা বলেন ‘হারাম আল শরিফ’ এবং ইসরায়েলি ও পশ্চিমারা বলেন ‘টেম্পল মাউন্ট’) মুসলিম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করলেন।
মোশে দায়ান জুতা খুলে আল আকসা মসজিদের কার্পেটে বসে মসজিদের খাদেমদের সঙ্গে বৈঠক করলেন। তিনি তাঁদের বললেন, এখন থেকে ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ এই মসজিদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে।
মসজিদ কম্পাউন্ডের ভেতরের দিকটার নিয়ন্ত্রণে থাকবে জর্ডান সরকারের পরিচালিত একটি ইসলামিক ওয়াক্ফ প্রতিষ্ঠান। চুক্তিতে বলা হলো, আগে এই কম্পাউন্ডে ইহুদিদের প্রবেশ নিষেধ ছিল; এখন থেকে তাঁরা মসজিদ চত্বরে ঢুকতে পারবেন। কিন্তু তাঁরা এটিকে প্রার্থনার জায়গা বানাতে পারবেন না।
আল আকসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ইসরায়েলের করা ওই চুক্তিতে বলা ছিল, শুক্রবার জুমার দিন মুসলিমরা ছাড়া অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী কম্পাউন্ডে ঢুকতে পারবেন না।
রমজান মাস এবং ইসলামের পবিত্র দিন হিসেবে বিবেচিত অন্যান্য দিনেও অমুসলিমেরা সেখানে ঢুকতে পারবেন না। তবে আল আকসার পশ্চিম দেয়াল বা ওয়েস্টার্ন ওয়ালের নিচের দিকটায় ইহুদিরা সব সময় প্রার্থনা করতে পারবেন।
সেই থেকে বহু বছর সেভাবেই চলে আসলেও আল আকসা থেকে জায়নবাদী ইহুদিরা এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি ফেরাননি। গত এক দশকে আইন ভেঙে আল আকসা কম্পাউন্ডে প্রায় প্রতিদিন ইসরায়েলিরা ঢুকছেন এবং সেখানে দাঁড়িয়ে প্রার্থনাও করছেন।
কিন্তু আল আকসাকে এখনই দখল করতে হবে—এ ধরনের মরিয়া ভাব তাঁদের মধ্যে কখনোই দেখা যায়নি যতটা এখন দেখা যাচ্ছে।
অতি অদ্ভুত বিষয়, ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল জেরুজালেম দখল করে নেওয়ার পর থেকে কয়েক দশক ধরে ইসরায়েল আল আকসা মসজিদের নিচে সুড়ঙ্গ কাটার কাজ চালাচ্ছে।
আল আকসার নিচে কিং সোলোমনের (ইসলামের পয়গম্বর সুলাইমান আ.) সমাহিত দেহ কিংবা ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতে উল্লেখিত সুলাইমানি সিন্দুক থাকতে পারে—এমন একটি অস্পষ্ট ঐতিহাসিক ভাষ্যকে সামনে এনে প্রত্নতত্ত্বের দোহাই দিয়ে তারা এই কাজ করে যাচ্ছে।
ওয়েস্টার্ন ওয়ালের পাশ দিয়ে এই সুড়ঙ্গ কাটা হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে এই সুড়ঙ্গ প্রথম খুলে দেওয়া হয়। মোট ১২টি সুড়ঙ্গ সেখানে কাটা হয়েছে। এসব সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে চার শ মিটার।
অর্থাৎ মাটির ওপরে আমরা যে আল আকসা কম্পাউন্ড দেখতে পাই সেই কম্পাউন্ডের নিচে; বিশেষ করে সোনালি গম্বুজের ডোম অব দ্য রকের নিচের প্রায় পুরো এলাকা খুঁড়ে ফেলা হয়েছে। সেখানে ভূগর্ভস্থ ঘরে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভার একাধিক বৈঠকও হয়েছে। এই খনন কাজ চালাচ্ছে ইসরায়েলের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।
আল আকসার নিচে এভাবে খোঁড়াখুঁড়ি করা বন্ধ করার জন্য ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ইউনেসকোর কাছে অভিযোগ করার পর ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি একটি রায়ে বলেছে, জেরুজালেম শহরে ইসরায়েলের সার্বভৌম অধিকার নেই। ফলে সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের অধিকার তারা রাখে না। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি এই সুড়ঙ্গ কাটার নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু সে রায়ে কাজ হয়নি।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বলছে, এই খোঁড়াখুঁড়িতে আল আকসার কাঠামো দুর্বল হয়ে গেছে। সামান্য ভূমিকম্প হলে সেটি ধ্বসে পড়তে পারে।
গত বছরের ২১ মে নেতানিয়াহুর সরকার আল আকসার নিচে ভূগর্ভস্থ ঘরে মন্ত্রিসভার বৈঠক করেছে। পরদিন ২২ মে ‘ইসরায়েল: কেবিনেট হোল্ডস মিটিং বিনিথ আল-আকসা মস্ক’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করে।
তাতে বলা হয়, দখলকৃত জেরুজালেম এবং এখানকার পবিত্র স্থানগুলোর ওপর ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রদর্শনের অংশ হিসেবে আল-আকসা মসজিদের নিচে একটি সুড়ঙ্গে ইসরায়েলের দখলদার সরকার মন্ত্রিসভার বৈঠক করেছে।
সুড়ঙ্গটি আল-আকসার আল-বুরাক প্রাচীরের (‘পশ্চিম প্রাচীর’ বা ‘ওয়েস্টার্ন ওয়াল’) নিচে অবস্থিত।
মন্ত্রিসভার ওই বৈঠকে ছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এএফপির এক খবরে বলা হয়, সেখানে দেওয়া ভাষণে নেতানিয়াহু বলেন, ‘কয়েক দিন আগে, আবু মাজেন (ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ডাক নাম আবু মাজেন) বলেছিলেন, জেরুজালেম এবং আল-হারামের (হারাম আল শরিফ) সঙ্গে ইহুদি জনগণের সম্পর্ক নেই। তাই আমি তাঁকে বলছি, আপনি দেখুন, আমরা আজ জেরুজালেম ও আল-হারামের পেটের ভেতরে বসে আমাদের সভা করছি।’
ইসরায়েলি দৈনিক মারিভ-এর বরাত দিয়ে মিডলইস্ট মনিটর জানায়, ওই বৈঠকের সময় ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা এক কোটি ৭০ লাখ ডলারের একটি বড় বাজেট এবং জেরুজালেমের জন্য বেশ কয়েকটি ‘জুডাইজেশন প্রকল্প’ অনুমোদন করে।
এই বাজেট এবং প্রকল্পগুলোর লক্ষ্য আল-আকসা মসজিদের নিচে আরও টানেল খনন করতে উৎসাহিত করা যা অনিবার্যভাবে মসজিদের প্রাচীন কাঠামোকে দুর্বল করে দেবে।
এই সময় হামাসের মুখপাত্র হাজেম কাসেম বলেছিলেন, ‘এটি পবিত্র শহর জেরুজালেমের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি দখলদারির দ্বারা পরিচালিত ধর্মীয় যুদ্ধের একটি বিপজ্জনক উসকানি।’
নেতানিয়াহু যেদিন আল আকসার নিচের ভূগর্ভস্থ চেম্বারে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন, ওই দিনই আল জাজিরা তাদের ‘ইনসাইড স্টোরি’ সিরিজের মধ্যে ‘হোয়াট’স ড্রাইভিং ইসরায়েলি এক্সক্যাভেশনস্ আন্ডার আল আকসা মস্ক?’ শিরোনামে ২৮ মিনিটের একটি প্রামাণচিত্র প্রকাশ করে।
এই প্রামাণ্যচিত্রে সুড়ঙ্গ খনন থেকে শুরু করে ইসরায়েলের এ সংক্রান্ত নানা দিক দেখানো হয়। এর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে গবেষকদের বিশদ আলোচনা সেখানে উপস্থাপন করা হয়।
এর পরদিন ২৩ মে আরব নিউজ ‘প্যালেস্টিনিয়ানস আউটরেইজড্ অ্যাজ ইসরায়েল হোল্ডস্ কেবিনেট মিটিং ইন টানেলস ডাগ আন্ডার আল-আকসা’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে।
তাতে বলা হয়েছে: আল-আকসা মসজিদের নিচে খনন করা সুড়ঙ্গের ভেতরে ইসরায়েলি সরকারের সাপ্তাহিক মন্ত্রিসভার বৈঠক করার পদক্ষেপে ফিলিস্তিনিরা ক্ষুব্ধ। ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শাতায়েহ ওই দিন ইসরায়েলি খননকাজ তদন্তের জন্য আবারও ইউনিসেফকে ঘটনাটিকে নথিভুক্ত করতে আহ্বান জানান।
গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে বিশ্ববাসীর মনে বারবার যে প্রশ্ন ঘুরছে, তা হলো, কেন গাজা থেকে হামাস কোনো ধরনের উসকানি ছাড়াই নজিরবিহীন কায়দায় ইসরায়েলে ঢুকে হামলা চালিয়ে হাজারের বেশি বেসামরিক ইসরায়েলি নাগরিককে হত্যা করল ?আর কেনই বা তখন থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েল গাজায় স্মরণকালের ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে গাজার ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির মধ্যে ৩৩ হাজার জনকে হত্যা করা হয়েছে। চিরতরে পঙ্গু হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। গাজা শাসন করছে যে হামাস, তার সামরিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়ের তিন ছেলে ও কয়েকজন নাতিকে ঈদের দিন হত্যা করেছে ইসরায়েল।
সেখানে খাবারের অভাবে এখনো না খেয়ে নিরপরাধ শিশুরা মারা যাচ্ছে। তারপরও ইসরায়েলের মধ্যে দয়ামায়া দেখা যাচ্ছে না। হামলা থামানোর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলা এবং ইসরায়েলের এই নৃশংস পাল্টা হামলা ও গণহত্যার পেছনের কারণ হিসেবে যতগুলো ইস্যু ঘুরে ফিরে আলোচনায় আসছে, সেগুলোর মধ্যে এখন একেবারে সামনের সারিতে আছে, সেই টেম্পল মাউন্ট তথা হারাম আল শরিফ তথা ডোম অব দ্য রক তথা আল আকসা কম্পাউন্ড।
এর সঙ্গে আলোচনায় আসছে, লাল গরু বলি দেওয়া এবং এর মধ্য দিয়ে আল আকসা মসজিদের স্থলে ইসরায়েলিদের উপাসনালয় ‘থার্ড টেম্পল’ নির্মাণের প্রসঙ্গ।
আলোচনায় আসছে ‘কার্স অব এইটথ ডেকেড’ শীর্ষক একটি টার্ম। ‘আশি বছরের বেশি কোনো ইহুদি রাষ্ট্র টেকে না’—এই তত্ত্ব অনুযায়ী ২০২৮ সাল নাগাদ ইসরায়েল ভেঙে পড়তে পারে—এমন প্রসঙ্গ আলোচনায় আসছে।
৭ অক্টোবরের পর গাজায় শুরু হওয়া ইসরায়েলের হামলার এক শ তম দিনে হামাসের কাসেম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু ওবাইদা বলেছেন, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের অনুভূতির বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালাতে পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় মিথ অনুযায়ী লাল গরু বলি দেওয়ার ‘ঘৃণাজনক’ চক্রান্ত করছে। এটি ঠেকিয়ে দিতেই হামাস ৭ অক্টোবর হামলা চালিয়েছে।
এখানে বলে রাখি, আল আকসা চত্বরে থাকা ডোম অব দ্য রক ধ্বংস করে সেখানে থার্ড টেম্পল নির্মাণের জন্য ইসরায়েলের একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী যে ‘আন্দোলন’ করে আসছে, তার সঙ্গে লাল গরু বলি দেওয়ার একটি আনুষ্ঠানিকতার বিষয় আছে।
আল আকসার স্থলে থার্ড টেম্পল নির্মানের আন্দোলনে যুক্ত ইসরায়েলিদের বিশ্বাস অনুযায়ী, সেখানে তৃতীয় মন্দির না গড়লে ইসরায়েলের ত্রাণকর্তা বা মসিহ্ আবির্ভূত হবেন না। আর সেই মন্দির গড়তে হলে ইহুদিদের পবিত্র হতে হবে। তার জন্য তাওরাতে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যের লাল গরু বলি দিয়ে এবং সেটি পুড়িয়ে তার ছাই দিয়ে ইহুদিদের পবিত্র হতে হবে।
এ নিয়ে ‘লাল গরু এসে গেছে, আল আকসা ভেঙে থার্ড টেম্পল গড়া হবে?’ শিরোনামে প্রথম আলোয় প্রকাশিত আমার অন্য লেখায় বিশদ আলোচনা করেছি।
গাজায় ইসরায়েলি হামলা নিয়ে গত ৫ এপ্রিল নিউজউইক পত্রিকা ‘হোলি ওয়ার: রেড কাউস, গাজা অ্যান্ড দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামে প্রায় চার হাজার শব্দের একটি বিশাল প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছে এভাবে: ‘গত অক্টোবরে হামাসের রক্তক্ষয়ী হামলার পর থেকে ইসরায়েল গাজায় টানা হামলা চালিয়ে আসছে। কিন্তু পবিত্র এই ভূমিতে ইসরায়েল যে যুদ্ধ চালাচ্ছে, তার আসল লক্ষ্যবিন্দু বিধ্বস্ত গাজা উপত্যকা নয়। এই যুদ্ধের আসল কেন্দ্রস্থল গাজা থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত জেরুজালেম শহরে; সেই শহরের পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র এবং সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটি পাহাড়ের চূড়ায়।’
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি টেম্পল মাউন্টে আসা একজন ইহুদি যাজক নিউজউইককে বলেছেন, ‘আমাদের যে পবিত্র সেনারা গাজায় লড়াই চালাচ্ছে, তারা মূলত টেম্পল মাউন্টে থার্ড টেম্পল (বা তৃতীয় সুলাইমানি মন্দির) নির্মাণের জন্যই লড়াই চালাচ্ছে।’
গাজায় যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হওয়া এক ইহুদি সেনার মা (যার নাম মেরিনা সোকোল) ১৩০০ বছরের পুরোনো আল আকসা চত্বরে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘আমরা গাজায় যে যুদ্ধ করছি সেটি গাজা দখল করার জন্য নয়, আমরা যুদ্ধ করছি শুধুমাত্র টেম্পল মাউন্টের জন্য।’
নিউজউইক–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করে সেখানে ইসলামি শাসন কায়েম করার জন্য যে হামাস নেতারা চেষ্টা করছেন, তাঁদেরও মূল প্রেরণা ও উদ্দীপনার একটি বড় প্রতীক হলো এই আল আকসা।
হামাসের মুখপাত্র বাসেম নাইম নিউজউইক পত্রিকাকে বলেছেন, ‘এবারে যে প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে তা শুধুমাত্র আল-আকসাকে দখলদারি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা হিসেবে চলছে।’ তিনি বলেছেন, ‘এটা গাজা কিংবা পশ্চিম তীর রক্ষার কোনো আন্দোলন নয়। এটি আল আকসাকে ধ্বংসের হাত থেকে ঠেকানোর সংগ্রাম।’
ইসলামি ভাষ্য, খ্রিষ্টীয় ভাষ্য, ইহুদি ভাষ্য এবং ঐতিহাসিক গবেষণায় স্বীকৃত তথ্য অনুযায়ী, জেরুজালেমের আজকের আল-আকসা চত্বর যেখানে অবস্থিত, ঠিক এখানেই পয়গম্বর সোলাইমান (আ.) (পশ্চিমে যিনি কিং সোলোমন বলে পরিচিত) মসজিদটি বানিয়েছিলেন।
ইহুদিরা যেহেতু ইসরায়েলের [ইয়াকুব নবীর আরেক নাম ইসরায়েল; বাইবেলে যাঁকে জ্যাকব বলে উল্লেখ করা হয়েছে] বংশধর; সেহেতু সোলাইমান (আ.) বা কিং সোলোমন ইহুদিদের কাছে পবিত্র পুরুষ। সোলাইমানের বানানো এই প্রার্থনা ঘর মুসলমানদের কাছে মসজিদ ইহুদিদের কাছে ‘ফার্স্ট টেম্পল’ হিসেবে বিবেচিত।
[এখানে বলে রাখা ভালো, জুদাইজম, ক্রিশ্চিয়ানিটি ও ইসলাম—এই তিন ধর্মের মূল ধারা এসেছে ইব্রাহিম (আ.) বা আব্রাহাম থেকে। এ কারণে এই তিন ধর্মকে ‘আব্রাহামিক ধর্ম’ বলা হয়। আদর্শগত দিক থেকে এরা একে অপরের ‘জ্ঞাতি’। ]
৫৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ইরাকের ব্যাবিলনের (আজকের বাগদাদই সেকালের ব্যাবিলন) শাসক বখতে নাছর (পশ্চিমা বিশ্বে যিনি ব্যাবিলনের সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার নামে পরিচিত। তিনিই প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান বানিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়) হামলা চালিয়ে এই ফার্স্ট টেম্পল গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং সব বনি ইসরায়েলকে (আজকের ইহুদিদের পূর্বপুরুষ) দাস হিসেবে বন্দী করে ইরাকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এরপর পারস্য শাসকেরা বখতে নাছরের সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে বনি ইসরায়েল তথা ইহুদিদের ইরাক থেকে মুক্ত করে আবার ফিলিস্তিনে নিয়ে আসেন। ধ্বংস করে ফেলা সোলাইমানের মসজিদ বা ফার্স্ট টেম্পলের ওপর ৫১৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আবার আরেকটি উপাসনালয় নির্মাণ করার কাজ শুরু হয়।
এটিকে বলা হয় ‘সেকেন্ড টেম্পল’। পরে রোমানরা পারস্যদের পরাজিত করে বাইতুল মুকাদ্দাস বা জেরুজালেম দখল করে এবং ৭০ খ্রিষ্টাব্দে তারা সেকেন্ড টেম্পলও ধ্বংস করে ফেলে। রোমানরা সেই জায়গায় তাদের দেবতা জুপিটারের উপাসনালয় বানিয়েছিল।
বর্তমানে আল আকসা বলতে পুরো কম্পাউন্ডকে বোঝানো হয়। পুরো কম্পাউন্ডকে বলা হয় ‘হারাম আল শরিফ’। এই কম্পাউন্ডের চার দেয়ালের মধ্যে থাকা কিবলি মসজিদ, কুব্বাতুস সাখরা (ডোম অব দ্য রক) ও বুরাক মসজিদ—এই তিন মসজিদের সমন্বয়ই হলো আল আকসা। মূল আল আকসা বা কিবলি মসজিদ হলো ধূসর সিসার প্লেট দিয়ে আচ্ছাদিত গম্বুজওয়ালা স্থাপনাটি।
তবে সংবাদমাধ্যমে আল আকসা নামে বেশি প্রসিদ্ধ সোনালি গম্বুজের স্থাপনার নাম কুব্বাতুস সাখরা বা ডোম অব দ্য রক। ইহুদিদের মূল লক্ষ্যস্থল হলো এই ডোম অব দ্য রক যেটিকে তারা টেম্পল মাউন্ট বলে।
উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান এটির নির্মাণকাজ শুরু করেন। ৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ছেলে খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে এর কাজ শেষ হয়।
৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর আব্বাসীয় শাসনামলের খলিফা আল মনসুর এটি পুনর্নির্মাণ করেন। তারও পরে তাঁর উত্তরসূরি আল মাহদি এটি পুনর্নির্মাণ করেন।
১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতেমিদের শাসনামলের খলিফা আলী আজ-জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন।
ইহুদিরা মনে করেন, রোমানরা ‘সেকেন্ড টেম্পল’ ধ্বংস করে জুপিটারের মন্দির বানিয়েছিল। আর সে স্থলেই ডোম অব দ্য রক বা কুব্বাতুস সাখ্রা বানানো হয়েছে। তাঁরা এই কম্পাউন্ডের নাম দিয়েছেন, ‘হার হাবাইত’। এখানেই আদি সোলাইমানি মন্দিরের নকশায় থার্ড টেম্পল বানানোর পরিকল্পনা আছে ইহুদি কট্টরপন্থীদের।
আল আকসা এমন একটি কম্পাউন্ড যা মুসলমান, খ্রিষ্টান ও ইহুদি সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত পবিত্র স্থান। এই তিন ধর্মের অনুসারীরা যাঁদের নবী বা সৃষ্টিকর্তার বার্তাবাহক বলে বিশ্বাস করেন, তাঁদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের জন্ম হয়েছে এখানে বা এর আশপাশে। ঈসা (আ.) (খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছে যিনি যিশুখ্রিষ্ট)-এর মা মারিয়াম (আ.) এই মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন।
ইসলামের ভাষ্যমতে, মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) মিরাজে যাওয়ার রাতে এই মসজিদে এসেছিলেন এবং ইহুদি সম্প্রদায় এখন টেম্পল অব রকের ওয়েস্টার্ন ওয়ালের যে পীঠে হাত রেখে উপাসনা করেন তার ঠিক পীঠে তিনি তাঁর ‘বুরাক’ নামের বাহনটিকে বেঁধেছিলেন। এ কারণে সেটিকে ‘বুরাক ওয়াল’ও বলে।
এখানে আব্রাহামিক তিন ধর্মেরই মহাপুরুষদের স্মৃতি আছে।
তাওরাত [ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টামেন্ট, যেটিকে মুসলমানরাও তাদের পূর্ববর্তী নবী মুসা (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ আসমানি কিতাব বলে বিশ্বাস করে।
তবে মুসলমানরা বিশ্বাস করে, মুসা (আ.)-এর ওপর যে তাওরাত অবতীর্ণ হয়েছিল, সেই তাওরাতের আদি টেক্সট অবিকৃত অবস্থায় নেই; সেই তাওরাতকে ইহুদিরা বিকৃত করেছে] এবং তালমুদের (তালমুদ হলো তাওরাতের প্রত্যাদেশগুলোর আলোকে ইহুদিদের ধর্মবেত্তাদের রচিত আইন শাস্ত্র বা ন্যায়শাস্ত্র, যা ইহুদিদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে) উদ্ধৃতি ব্যাখ্যা করে ইসরায়েলিদের একটি অংশ বলছেন, ইসরায়েলিদের সার্বভৌম জাতি হিসেবে পূর্ণমুক্তি দিতে একজন মসীহ্ আসবেন।
কিন্তু যতক্ষণ না কিং সোলোমনের ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের (বর্তমান আল আকসার সোনালি গম্বুজের মসজিদ বা ‘ডোম অব রক’) জায়গায় তৃতীয় সুলাইমানি মন্দির বা ‘থার্ড টেম্পল’ বানানো হচ্ছে, ততক্ষণ সেই মসীহ্ আসবেন না।
ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী, ইহুদিদের এই মসিহই দাজ্জাল, যে কিনা গোটা বিশ্ব শাসনব্যবস্থার একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে।
আর ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, যিশু আবার পৃথিবীতে আসবেন (ইসলামের ভাষ্যও তাই)। এটিকে ‘সেকেন্ড কামিং’ বা ‘দ্বিতীয় আগমন’ বলে। ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস, যিশুর দ্বিতীয় আগমনের পূর্বশর্তও আল আকসায় থার্ড টেম্পল নির্মাণ।
তালমুদের ব্যাখ্যা দিয়ে থার্ড টেম্পল নির্মাণের পক্ষের একদল লোক বলছেন, মাসিহের আবির্ভাবের প্রধান শর্ত হলো তিনটি।
প্রথম শর্ত, সারা পৃথিবীতে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদের ইসরায়েলে জড়ো হতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত হলো, একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং তৃতীয় শর্ত হলো সোলাইমানি মন্দির আগে যেখানে ছিল, ঠিক সেখানেই সেই মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
ইহুদিরা বিশ্বাস করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই তারা প্রথম দুটি শর্ত পূরণ করতে পেরেছেন। বাকি আছে তৃতীয় শর্ত। সেই শর্ত পূরণ করতে হলে আল-আকসা মসজিদ ভাঙতে হবে আর সেখানেই সোলাইমানি মন্দির বা থার্ড টেম্পল গড়তে হবে।
ইসরায়েলের কট্টর ইহুদিদের একাধিক গোষ্ঠী মসিহের আগমনের শর্ত পূরণ করতে ‘থার্ড টেম্পল’ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে প্রভাবশালী যে সংগঠন, সেটির নাম টেম্পল ইনস্টিটিউট। আলট্রা-অর্থোডক্স বা চরম কট্টর ইহুদিরা ১৯৮৭ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন।
আরেকটি সংগঠনের নাম ‘বোনেহ ইসরায়েল’ (নোট: ‘বনি ইসরায়েল’ বা ‘বনু ইসরায়েল’ নয়। এটি হলো ‘বোনেহ ইসরায়েল’, যার মানে ‘ইসরায়েল গঠন’) নামে একটি সংস্থা।
এই সংগঠনটিতে ইহুদি ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরা এক জোট হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আরেকটি প্রতিষ্ঠানের নাম ‘রিটার্নিং টু দ্য মাউন্ট’।
থার্ড টেম্পল বা তৃতীয় সুলাইমানি মন্দির নির্মাণের জন্য যারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন এবং এর পক্ষে কথা বলে যাচ্ছেন, তাঁরা মন্দির নির্মাণের জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এর পূর্ব আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে টেক্সাস থেকে লাল গরুগুলো বলি দেওয়ার জন্য আনা হয়েছে। সেগুলো ঠিকঠাকভাবে বলি দেওয়ার বিষয়ে তারা বিরাট কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
বাইবেল (নিউ টেস্টামেন্ট) এবং তাওরাতের (হিব্রি বাইবেল বা ওল্ড টেস্টামেন্ট) বর্ণনা মাফিক তৃতীয় মন্দিরের স্থাপত্য নকশা সব ইতিমধ্যেই শেষ করা হয়েছে। মন্দিরের পুরোহিতের গায়ে কোন আলখাল্লা থাকবে; তা পর্যন্ত বুনন করে রাখা হয়েছে।
মন্দিরের উপাসনার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য পাত্র এবং সরঞ্জাম ইত্যাদিও প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।
অনেক মেসিয়ানিক ইহুদি সমর্থকেরা বিশ্বাস করেন, মন্দিরের এই পুনর্নির্মাণ তাদের মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি করবে না। বরং ‘সমস্ত জাতির জন্য প্রার্থনার ঘর’ হিসেবে ‘শান্তির যুগ’ আনার ক্ষেত্রে এই তৃতীয় মন্দির বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীকে পূরণ করবে।
এই মন্দির প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উগ্রপন্থী ইহুদি সম্প্রদায়ের পেছনে যে ইভানজেলিকাল খ্রিষ্টান গোষ্ঠী সহায়ক ভূমিকা পালন করছে, সেই গোষ্ঠীর বিশ্বাস, যিশুর ‘সেকেন্ড কামিং’ দ্বিতীয় আগমনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো এই মন্দির নির্মাণ।
ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের একটি বড় অংশ মনে করেন, খ্রিষ্ট বিরোধী নৈরাজ্যকারীদের সঙ্গে খ্রিষ্টের অনুসারীদের যে চূড়ান্ত লড়াই হবে বলে বাইবেলে ভবিষ্যদ্বাণী করা আছে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী পূরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো এই তৃতীয় মন্দির নির্মাণ।
নিউজউইক-এর ওপরে উল্লিখিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল সরকার গাজা যুদ্ধের ক্ষেত্রে তিনটি লক্ষ্য সামনে রেখে অভিযান চালাচ্ছে। সেগুলো হলো হামাসকে ধ্বংস করা, গাজায় হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের উদ্ধার করা, সর্বোপরি এটা নিশ্চিত করা যে, ইসরায়েল ভূখণ্ড আর সন্ত্রাসী হুমকিতে থাকবে না।
থার্ড টেম্পল প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাওয়া প্রতিষ্ঠান টেম্পল ইনস্টিটিউট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্টে বলেছে, ‘পবিত্র মন্দির আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখনই অনেক বেশি বাস্তব।’
ওল্ড টেস্টামেন্ট বা হিব্রু বাইবেলের ইছাইয়া ৫৬: ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আমি তাদের আমার জেরুজালেমের পবিত্র পর্বতে নিয়ে আসবো এবং আমার প্রার্থনা গৃহে তাদের আনন্দ পূরণ করব। আমি তাদের হোম বলি ও বলিদান গ্রহণ করব কারণ আমার মন্দিরকে সমস্ত জাতির জন্য প্রার্থনার ঘর বলা হবে।’
ফিলিস্তিনি শিক্ষাবিদ আদনান জুলানি নিউজউইককে বলেছেন, ‘ইসরায়েলিদের এ ধরনের কার্যকলাপ মূলত সংঘাতের বীজ এবং এই আগুনের মতো বীজ গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে পারে।’ তিনি বলছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড নিয়ে এটি এক ভয়ংকর খেলা’। ইসরায়েলের দখলকৃত পশ্চিম তীরের একাংশের শাসন ব্যবস্থা প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষের হাতে রয়েছে।
ওল্ড টেস্টামেন্টের ওই শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়ে টেম্পল ইনস্টিটিউট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছে, ‘আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন ইসরায়েল তার সমস্ত শত্রুদের পরাজিত করবে। পবিত্র মন্দির নির্মিত হবে যা হবে সমস্ত জাতির জন্য প্রার্থনার ঘর।’
টেম্পল ইনস্টিটিউটের আন্তর্জাতিক বিভাগের পরিচালক আইজ্যাক রিউভেন নিউজউইককে বলেন, ‘মুসলমানরা ইহুদিদের টেম্পল মাউন্টের ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় গুরুত্ব সঠিকভাবে বোঝে; তাই টেম্পল মাউন্টকে কেন্দ্র করে তারা উসকানি দিয়ে থাকে। এ কারণে বলতে পারি গাজা যুদ্ধ টেম্পল মাউন্টকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে।’
আল আকসা চত্বরে ইহুদিদের ধর্মীয় কার্যকলাপ বেড়ে যাওয়াকে ফিলিস্তিনিরা ইতিমধ্যেই তাদের জন্য বিপর্যয়কর অবস্থা বলে মনে করতে শুরু করেছেন।
ফিলিস্তিনি শিক্ষাবিদ আদনান জুলানি নিউজউইককে বলেছেন, ‘ইসরায়েলিদের এ ধরনের কার্যকলাপ মূলত সংঘাতের বীজ এবং এই আগুনের মতো বীজ গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে পারে।’ তিনি বলছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড নিয়ে এটি এক ভয়ংকর খেলা’।
জায়নবাদী এই আন্দোলনকারীরা মনে করেন, জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এই পুরো এলাকা ঈশ্বর তাদের আশীর্বাদ হিসেবে দিয়েছেন। ১৯৬৭ সালে মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিম তীর দখল করে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনের পেছনে এই মতাদর্শ কাজ করেছে।
এখনো থার্ড টেম্পল নির্মাণে বিশ্বাসী ইহুদিদের একটি ছোট গোষ্ঠী সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে যাচ্ছে, কারণ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু রাজনৈতিকভাবে নিজের স্বার্থ হাতিয়ে নিতে ধর্মীয় দিকে ঝুঁকে গেছেন।
ইসরায়েলের পিস নাউ গ্রুপ নামের একটি বামপন্থী ধারার একটি শান্তিবাদী সংগঠন। সংগঠনটির নেতা জনাথন মিজরাচি নিউজউইককে বলেছেন, ‘ ‘মাত্র ২০ বছর আগেও দখলকৃত ফিলিস্তিনে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা পর্যন্ত হারাম আল শরিফ/টেম্পল মাউন্টের সংশ্লিষ্টতা এড়িয়ে চলত। তখন এই মসজিদের দাবিদারের সংখ্যা খুব কমই ছিল। কিন্তু এখন একটি শক্তিশালী আন্দোলন হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।’
এই ডোম অব দ্য রক শুধু যে জেরুজালেমের কাঠামোগত প্রতীক, তা-ই নয়, ফিলিস্তিনিরা সুদীর্ঘ দিন ধরে আলাদা যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছে, সেই ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে তারা জেরুজালেমকে আশা করে আছে। তারা সেই রাজধানী জেরুজালেমের প্রতীক হিসেবে এই মসজিদটিকে গণ্য করে থাকে। ইসরায়েলও জেরুজালেমকে তার রাজধানী হিসেবে মনে করছে।
এই ডোম অব দ্য রক শুধু যে জেরুজালেমের কাঠামোগত প্রতীক, তা-ই নয়, ফিলিস্তিনিরা সুদীর্ঘ দিন ধরে আলাদা যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছে, সেই ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে তারা জেরুজালেমকে আশা করে আছে। তারা সেই রাজধানী জেরুজালেমের প্রতীক হিসেবে এই মসজিদটিকে গণ্য করে থাকে। ইসরায়েলও জেরুজালেমকে তার রাজধানী হিসেবে মনে করছে।
আশঙ্কার কথা হলো, গত ২৮ মার্চ মিডল ইস্ট মনিটর ‘ইন এ ওয়েস্ট ব্যাংক সেটেলমেন্ট, ইসরাইলিজ টেন্ড রেড কাউজ অ্যান্ড প্ল্যান দ্য থার্ড টেম্পল’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে বলেছে, এ মাসেই থার্ড টেম্পল অ্যাকটিভিস্টরা লাল গরু বলি দিতে পারে।
প্রতিবেদনে থার্ড টেম্পল গ্রুপ উভনি জেরুজালেম-এর রাবাই আইজ্যাক মামোর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, চলতি এপ্রিলের শেষে ইসরায়েলিদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পাসওভারের (নবী মুসা আ. বনি ইসরায়েলিদের নিয়ে মিসর থেকে জেরুজালেমের দিকে রওনা হওয়ার সেই ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণে ইসরায়েলিরা যে অনুষ্ঠান করে তাকে ‘পাসওভার’ বলে) সময় (২২ এপ্রিল সূর্যাস্তের পর থেকে ৩০ এপ্রিল সূর্যাস্ত পর্যন্ত) একটি লাল গরু বলি দেওয়া হতে পারে।
এটি সত্যি সত্যি করা হলে তা আল আকসা দখলের একটি নতুন পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি হতে পারে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সেই উত্তেজনা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যে প্রভাব ফেলবে তা কল্পনা করা আসলেই শক্ত।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com