প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

প্রবৃদ্ধির কমার পূর্বাভাস, কী প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে

দেশের শিল্প খাতে অস্থিরতা চলছে। ব্যাংকঋণের সুদহার এক বছরের বেশি সময় ধরেই বাড়তি। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলে দিয়েছেন, একদম অতি জরুরি প্রয়োজন না হলে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া হবে না।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এখন বেশি সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগের ঝুঁকি খুব একটা নেবেন না। বিদেশি বিনিয়োগের পরিস্থিতি আগে থেকেই খারাপ। এখন তার পালে হাওয়া লাগার বাস্তবতা নেই। ফলে আগামী অন্তত এক বছর কর্মসংস্থানে গতি আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

বাস্তবতা হলো, গত জুলাই মাসে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনের মূল পাটাতন ছিল কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা, বিশেষ করে শোভন কর্মসংস্থানের। সে কারণেই সরকারি চাকরির প্রতি তরুণদের এত আকর্ষণ। সেই কোটা সংস্কার আন্দোলন শেষমেশ এক দফায় পরিণত হয় এবং পরিণামে শেখ হাসিনা সরকারের পতন। যে কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো, তা থেকে মধ্য মেয়াদে উত্তরণের পূর্ব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

গত জুলাই ও আগস্ট মাসে দেশের অর্থনীতি এক রকম স্থবির ছিল। এরপর সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে ছিল চরম অনিশ্চয়তা; প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন শিল্প খাতে বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়েছে। এরপর দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিকদের আন্দোলন শুরু হলে এই খাতের উৎপাদনও ব্যাহত হয়।

বাংলাদেশ থেকে অনেক কার্যাদেশ চলে গেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পোশাক খাতের বড় এক ব্যবসায়ী সম্প্রতি প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে জানান, চলমান অনিশ্চয়তার কারণে দেশের প্রায় ২৫০টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বছরের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ১০ দশমিক ২৮ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নে কমেছে ৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির চিত্র খুব একটা সুখকর নয়।

ইতিমধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) চলতি অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ছাঁটাই করেছে। সেটাও ছোটখাটো কিছু নয়; এক ধাক্কায় তারা ১ দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট পূর্বাভাস হ্রাস করেছে। এপ্রিলের পূর্বাভাসে তারা বলেছিল, প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ; এবার তারা বলছে, প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ১ শতাংশ। এডিবি না বললেও সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বোঝা যায়, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কমবে।

বেকারত্ব সমস্যা এমনিতেই বাংলাদেশের অর্থনীতির বিষফোড়া। অনেক দিন ধরেই অর্থনীতিবিদেরা বলে আসছেন, দেশে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। দেশে জিডিপির অনুপাতে কর্মসংস্থান কম। এমনকি যখন উচ্চ প্রবৃদ্ধি ছিল, তখনো জিডিপির অনুপাতে কর্মসংস্থান কম ছিল। এখন যখন প্রবৃদ্ধির গতি নিম্নমুখী, তখন পরিস্থিতি আরও সঙিন হবে, সেটাই স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে আছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি।

কর্মবাজারে একদিকে শোভন কর্মসংস্থানের অভাব, আরেক দিকে আছে কাঠামোগত সংকট। সেটা হলো, সরকারি-বেসরকারি চাকরির ক্রমবর্ধমান ব্যবধান। গত দেড় দশকে বেসরকারি খাতের বেতনকাঠামোর তেমন উন্নতি হয়নি, যদিও এ সময়ে সরকারি চাকরির বেতন অনেকটাই বেড়েছে। সেই সঙ্গে আছে ক্ষমতা। এই বাস্তবতায় তরুণদের জীবনের একমাত্র সোনার হরিণ হলো সরকারি চাকরি। এই বিষয়ে আগের সরকার কখনোই কথা বলেনি।

কর্মজীবী ও বেকার যুবকদের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যে বড় ব্যবধান আছে। বেশির ভাগ কর্মজীবীর ভাষ্য, তাঁদের প্রতি সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে আসা তরুণেরা তা প্রত্যাশা করেন না।

বর্তমান সরকারও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত একটি বাক্য ব্যয় করেনি। বেসরকারি খাত তরুণদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও সরকারি চাকরির ওপর চাপ কমত; এই খাত উত্তম বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয়তা পেত। দুর্নীতি হ্রাস করতে হলে বেসরকারি খাতের চাকরি আকর্ষণীয় করার বিকল্প নেই। অথচ বিভিন্ন জরিপে জানা যায়, সরকারি চাকরিতে বেতন বাড়লেও কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বাড়েনি।

গত দেড় দশকে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে এখন শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর যে বিপুলসংখ্যক তরুণ স্নাতক হয়ে বেরোচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই শোভন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। অনেকেই বাধ্য হয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ঝুঁকছেন বা স্বকর্মসংস্থানে যাচ্ছেন; কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় উদ্যোক্তা হওয়া সহজ কাজ নয়।

গত দেড় দশকের বড় সময়জুড়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে মানুষের মনে আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে; কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের পথ সংকীর্ণ। গত দেড় দশকে লাগামহীন দুর্নীতির কারণে যে অসমতা সৃষ্টি হয়েছে, তা-ও মানুষের মনে বঞ্চনাবোধ তৈরি করেছে। বঞ্চনার সেই স্ফুলিঙ্গ সম্ভবত কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দাবানলে রূপ নেয়।

ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌরাত্ম্যে রাজধানীতে এখন পথচলাই দায়। শেখ হাসিনা সরকার রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের উদ্যোগ নিয়েও পিছিয়ে আসে। গত ৫ আগস্টের পর এরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বাস্তবতা হচ্ছে, এই যে এত অটোরিকশার দৌরাত্ম্য, তার সঙ্গে বেকারত্বের যোগ আছে।

অটোরিকশাচালকদের একটি বড় অংশ ফ্যাশনেবল পোশাক পরেন; প্যাডেলচালিত রিকশার চালকদের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য দৃশ্যমান। তাঁরা অনেকে কলেজ পাস করে ঢাকায় কাজ খুঁজতে এসেছিলেন; কিন্তু কাজের অভাব ও সর্বোপরি শোভন কাজের অভাবে তাঁরা অটোরিকশা চালাতে নেমে গেছেন। এতে আয়রোজগারও ভালো। আগামী এক বছর কর্মসংস্থান না বাড়লে আরও অনেক তরুণ যে অটোরিকশা চালাতে নেমে যাবেন, তা বলাই বাহুল্য।

শ্রমশক্তি জরিপে জানা যায়, দেশের তরুণদের মধ্যে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ ও তরুণীদের মধ্যে মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বা শোভন কর্মসংস্থানে নিয়োজিত। বাকি তরুণেরা কাজ করছেন ঠিকই, হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে ভালো রোজগারও করছেন, কিন্তু তাঁদের জীবনের প্রতি পদে আছে অনিশ্চয়তা। সেই সঙ্গে আছে যথাযথ কর্মপরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব।

এমনকি অনেক সময় কর্মক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার পর্যন্ত নেই। এখানেই তরুণেরা ব্যর্থ হচ্ছেন। সম্প্রতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের এক সমীক্ষায় জানা যায়, দেশের কর্মবাজারের বাস্তবতার সঙ্গে তরুণদের প্রত্যাশার ফারাক বাড়ছে। তরুণেরা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতন চাকরি চান। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাঁরা কম বেতনের চাকরি পেলেও করতে চান না। এ ছাড়া দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মসময় নিয়ে তরুণদের আপত্তি আছে।

কর্মজীবী ও বেকার যুবকদের ভাষ্য, কর্মসংস্থানের সুবিধা, সাংগঠনিক পরিবেশ, বেতন স্কেল, প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য ও কর্মসময় নিয়ে প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যে বড় ব্যবধান আছে। বেশির ভাগ কর্মজীবীর ভাষ্য, তাঁদের প্রতি সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে আসা তরুণেরা তা প্রত্যাশা করেন না।

কর্মসময়ের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টায় শীর্ষ ১২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১তম। সপ্তাহে ৪৯ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় কাজ করতে হয়—এমন কর্মী সংখ্যার নিরিখে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ তিনে। ভুটানে সর্বোচ্চ ৬১ শতাংশ কর্মী সপ্তাহে ৪৯ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় কাজ করে; ভারতে এই গড় ৫১ ও বাংলাদেশে ৪৭ শতাংশ।

অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক মানুষকে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয়। মোদ্দাকথা হলো, বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে না। সেই সঙ্গে বেসরকারি খাতের চাকরির গুণগত উন্নয়নও জরুরি; এ বিষয়ে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ লাগবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন এই দ্বৈত বাস্তবতা মোকাবিলা করতে হবে।

  • প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক