মানুষ কি ক্রমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বশীভূত হয়ে পড়ছে?
মানুষ কি ক্রমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বশীভূত হয়ে পড়ছে?

মানুষের ‘পরাজয়ের’ দিন কি ঘনিয়ে আসছে

ছেলেটি রাজধানীর একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। পরীক্ষার আগে রাতে অঙ্ক করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) সাহায্য নিচ্ছিল সে। চ্যাটজিপিটিতে একটি অঙ্ক করতে দেওয়ার পর সেটির উত্তরও চলে আসে দ্রুত, সঠিকও ছিল সেটি। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় অঙ্কটি করা হয়েছে, তা বুঝতে পারছিল না ওই শিক্ষার্থী। তখন সে বাবার কাছে বিষয়টি জানতে চায়। বাবা এই প্রথম জানতে পারেন, সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া তাঁর ছেলে এতটা ‘প্রযুক্তিবান্ধব’ এবং এআইয়ের সুবিধা নেওয়ার বিষয়েও সে পটু।

এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। মানুষের অগ্রগতির ইতিহাস তো প্রকারান্তরে প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্তেরও ইতিহাস। কিন্তু মানুষ কি ক্রমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বশীভূত হয়ে পড়ছে না? ভয়–জাগানিয়া এ প্রশ্ন এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী বহুবার বহুভাবে উচ্চারিত হয়েছে। কিছু বিজ্ঞানীদেরও একাংশের শঙ্কা, ভবিষ্যতে এমন দিন আসতে পারে, যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধবে মানবজাতির। সেই দ্বন্দ্বে মানুষের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

বর্তমান সময়ে মনোযোগ কাড়া বুদ্ধিজীবী ও লেখক ইয়ুভাল নোয়া হারারি এক কদম এগিয়ে জানিয়েছেন আরও ভয়াবহ কথা। তাঁর অনুমান, ২০৩৪ সাল নাগাদ মানবজাতিকে, তথা গোটা পৃথিবীকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এআই। এ বছর প্রকাশিত তাঁর নতুন বই ‘নেক্সাস: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব ইনফরমেশন নেটওয়ার্কস ফ্রম দ্য স্টোন এজ টু এআই’–তেও আছে এর ইঙ্গিত।

একুশ শতক যে তথ্যের শতক, তা নিয়ে সম্ভবত দ্বিমত নেই কারও। ‘তথ্য আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ’, এই বিতর্কে শেষতক ‘অভিশাপের’ পক্ষে পাল্লা ভারী হয়ে যাবে না তো? একুশ শতক এখন এ প্রশ্নেরও শতক! প্রশ্নটাকে আরেকটু তীক্ষ্ণ করে এভাবেও তুলছেন অনেকে—মানুষ কি তবে তারই সৃষ্টির কাছেই ‘পরাজিত’ হবে?

মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যন্ত্র তথা প্রযুক্তি স্বাধীনভাবে ভাবার ক্ষমতা অর্জন করেছে। এর আগে মানুষের যত ভয়ংকর আবিষ্কারই থাকুক না কেন, তার কোনোটার সামর্থ্য ছিল না নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। যেমন কোন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে হবে, তা নিবারণ করার সাধ্য ছিল না পারমাণবিক বোমার বা টমাহক মিসাইলের। এআইয়ের সেই শক্তি আছে। মানুষই তাকে জুগিয়েছে সেই সামর্থ্য।

গত বছরের মার্চে চ্যাটজিপিটির উদ্ভাবনকারী প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই ও গুগল ডিপমাইন্ড একযোগে এআইয়ের কাছে মানবসভ্যতার সম্ভাব্য পরাভূত হওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল। এমন শঙ্কা বাস্তবে কত দূর গড়াবে, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু এরই মধ্যে আরেক শঙ্কা আকার পেতে শুরু করেছে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বিভেদকামী রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীগত শক্তি, এমনকি ব্যক্তির হাতে এআইয়ের অপব্যবহারে মাধ্যমে ঘৃণা-বিদ্বেষ উসকে দেওয়া। ভুয়া, বিকৃত ও অপতথ্য ছড়ানোর পালে যেভাবে হাওয়া লাগছে, তা শেষ পর্যন্ত মানবসভ্যতার পাটাতনে জোর ঝাঁকুনি দিতে পারে বৈকি।

সম্প্রতি তথ্যের সত্যতা যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাবের এক গবেষণা দেখা গেছে, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে আওয়ামী লীগের পক্ষে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বিরোধী দলের ফেসবুক পেজে নানা মন্তব্য করা হয়েছে ভুয়া বা ফেক ফেসবুক প্রোফাইল থেকে। আর এসব ফেসবুক প্রোফাইল পরিচালিত হয়েছে বট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। এমন ১ হাজার ৩৬৯টি ফেসবুক প্রোফাইলের একটি বট নেটওয়ার্কের সন্ধান মিলেছে গবেষণায়। দেশ-বিদেশ থেকে এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ টানা যায়। প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, গোষ্ঠী থেকে শাসকমণ্ডলী নিজ স্বার্থের পক্ষে তথ্যের আদল দিতে সচেষ্ট।

কেন মানবজাতি পৃথিবী শাসন করে—বছর দশেক আগেই ইয়ুভাল নোয়া হারারি সেই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সেই তিনিই এখন বলছেন তথ্য, অপতথ্য ও অ্যালগরিদম কীভাবে দিন দিন মানুষের মনস্তত্ত্বের ‘নিয়ন্ত্রক’ হয়ে উঠেছে। তাঁর ভাষ্যমতে, আমরা যতবার চ্যাটজিপিটি কিংবা অন্য কোনো এআই টুল ব্যবহার করি, এর সঙ্গে কথা বলি, প্রতিবারই এটি মানুষের চিন্তাচেতনা, মনস্তত্ত্ব আর ভাবার প্রক্রিয়া সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করে। এতে মানুষকে প্রভাবিত করার দক্ষতাও তার বাড়ছে দিন দিন।

যে দেশে গণমাধ্যম স্বাধীন, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না—নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এ কথা বলার মধ্য দিয়ে তথ্যের অবাধ প্রবাহের পক্ষেই সওয়াল করেছেন। মানুষের দুয়ারে অবাধ তথ্য পৌঁছে দেওয়াই হতে পারে গণতন্ত্র সুরক্ষার উৎকৃষ্ট পথ। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমশাসিত বর্তমানে তথ্যের সঙ্গে অপতথ্যের ফারাক নিবারণ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে। কে না জানে, মিথ্যার চেয়ে অর্ধ-সত্য বরং বেশি ভয়ংকর।

গত শতকের শেষার্ধে তথ্যপ্রযুক্তির যে আজদাহা বিস্তার ঘটতে থাকে, তাকে ‘প্রযুক্তিবিপ্লব’ বলতে কারও আপত্তি ছিল না। তথ্য হয়ে ওঠে অধিকারের আরেক নাম। তবে আধুনিকতার এই দর্শনগত অবস্থান ক্রমে আবছা হয়ে পড়ছিল। পোস্টট্রুথ বা উত্তর-সত্য জামানায় তা মুছে যাওয়ার জোগাড়! তথ্যের সঙ্গে সত্যের বিশেষত, পক্ষপাতহীন সত্যের সম্পর্কটি অস্বীকার করেছে নব্য জনরঞ্জনবাদী রাজনীতি, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। তাই যেকোনো তথ্যের সঙ্গে এ প্রশ্নও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিচ্ছে—তথ্য কার বা কোন পক্ষ বা গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিলে সহায়ক হবে?

একক বা সর্বজনগ্রাহ্য সত্যে পৌঁছানোর দিশা হওয়ার কথা ছিল যে তথ্যের, তা–ই হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ভ্রান্তির ভাষা’। ‘তথ্য ও অপতথ্যের’ এই ডিসটোপিয়ার শেষ কোথায়?

  • হাসান ইমাম সাংবাদিক
    hello.hasanimam@gmail.com