মিয়ানমারের একটা বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো
মিয়ানমারের একটা বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো

মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশের এ কেমন ‘নিরপেক্ষতা’

২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর মিয়ানমারের শান রাজ্যের চীন সীমান্তবর্তী এলাকায় থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সমন্বিত আক্রমণ শুরুর পর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা তাতমাদোর জন্য তেমন কোনো সুখবর নেই।

মাঝে একবার চীনের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষেরই অস্ত্র সংবরণের একটা বোঝাপড়া হয়েছে বলে খবর এসেছিল; তবে বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। সংঘাত চলমান থেকেছে এবং একে একে মিয়ানমার সেনাদের ঘাঁটি বা চৌকির পতন হয়েছে বিদ্রোহীদের হাতে।

অ্যালায়েন্সের সবচেয়ে শক্তিধর গোষ্ঠী বলে বিবেচিত হয় আরাকান আর্মি, যাদের মূল স্বার্থের এলাকা এই সংঘাতস্থল থেকে অনেক পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর-তীরবর্তী, বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন রাখাইন বা আরাকান রাজ্যে।

চীন সীমান্তে অ্যালায়েন্সের সাফল্যের পর আরাকান আর্মি ক্রমে পশ্চিমে এগোতে থাকে এবং গত বছর ১৩ নভেম্বর রাখাইন-সংলগ্ন চীন রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ শহর পালেতোয়া দখল করে নেয়। উল্লেখ্য, পালেতোয়া ভারতের উচ্চাভিলাষী কালাদান মাল্টিমোডাল পরিবহন প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল। 

জানুয়ারি মাসে মিয়ানমার সেনা এবং আরাকান আর্মির লড়াই পৌঁছে যায় রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ সীমান্তে। এই লড়াইয়ে সীমান্ত অশান্ত হয়ে উঠেছে, মর্টার বা কামানের গোলা এসে পড়েছে বাংলাদেশের ভেতরে, মৃত্যু হয়েছে অন্তত দুজনের। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে সরে এসেছেন সীমান্ত থেকে দূরে।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বর্ডার গার্ড পুলিশ) ৬৮ জন সদস্য (মতান্তরে ১০০ জন) মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় এবং বিজিবি তাঁদের নিরস্ত্র করে হেফাজতে নেয়। এরপর বেশ কিছুদিন এই ধারা অব্যাহত থাকে এবং পালিয়ে আসা বিজিপি সদস্যের সংখ্যা ৩৩০-এ পৌঁছায়। তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়।

বাংলাদেশ তাঁদের আকাশপথে ফেরত পাঠাতে চেয়েছিল। অজ্ঞাত কারণে মিয়ানমার তাঁদের নৌপথে ফিরিয়ে নিতে চাপ প্রয়োগ করে এবং বাংলাদেশ তাতে সম্মত হয়। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বিজিবির তত্ত্বাবধানে নৌবাহিনীর ইনানী জেটিতে তাঁদের মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

মিয়ানমার সেনা এবং আরাকান আর্মির লড়াই যথারীতি অব্যাহত আছে এবং যতটা দেখা যাচ্ছে, ধীর—কিন্তু নিশ্চিতভাবেই আরাকান আর্মির কাছে ভূমি হারাচ্ছে সেনাবাহিনী। যুদ্ধে পরাস্ত বা কোণঠাসা সেনাদের ছোট ছোট দল সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে।

বিজিপি ও সেনাসদস্য মিলিয়ে সর্বশেষ এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮ জনে। মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর ২৫ এপ্রিল তাদের মিয়ানমারের ফেরত পাঠানো হয়। অন্যদিকে এর এক দিন আগে অবশ্য মিয়ানমারের বিভিন্ন কারাগারে আটক ১৭৩ জন বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়। 

বাংলাদেশের মূল ইস্যু হচ্ছে উদ্বাস্তু শিবিরে অবস্থানরত ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার স্বদেশ (তথা রাখাইনে) প্রত্যাবর্তন। সামরিক জান্তার প্রতি নমনীয় হয়ে ছয় বছরে কিছুই অর্জিত হয়নি। যুদ্ধোত্তর রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে আরাকান আর্মির অবস্থান নিঃসন্দেহে যথাযথ গুরুত্ব পাবে। এ অবস্থায় এমন কিছুই বাংলাদেশের করা উচিত হবে না, যাকে আরাকান আর্মি তাদের প্রতি বৈরী আচরণ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। 

আরাকান আর্মির হাত থেকে রক্ষা পেতে মিয়ানমার সেনাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এবং এরপর তাঁদের মিয়ানমারের জান্তা সরকারের কাছে ফেরত পাঠানো, বিষয়টি একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। যেকোনো যুদ্ধের একটি প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে, বিরূপ পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার্থে পিছিয়ে আসা এবং পরে আবার যুদ্ধে অংশগ্রহণ। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এরই মধ্যে সৈন্যস্বল্পতায় ভুগছে।

ফেরত যাচ্ছেন যে সেনারা, তাঁদের আবার চলমান যুদ্ধে নিয়োজিত করা হবে বলে ধরে নেওয়া যায়। বিষয়টি তাহলে কী দাঁড়াবে? বাংলাদেশকে সে ক্ষেত্রে মিয়ানমার সেনারা সাময়িক পশ্চাদপসরণের নিরাপদ ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন, তাই না?

মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশ একটা নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু মিয়ানমার সেনাদের বাংলাদেশে পিছিয়ে আসা এবং এরপর ফিরে গিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে পুনরায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া কি অনেকটাই জান্তার পক্ষ অবলম্বন হয়ে দাঁড়াচ্ছে না? 

বিষয়টিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখা যায়। ধরা যাক, সীমান্তে কোনো একটি যুদ্ধে আরাকান আর্মির একটি দল পরাজিত হলো এবং প্রাণ রক্ষার্থে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পিছিয়ে এল। তাদেরও আমরা আশ্রয় দিলাম। বাংলাদেশ এরপর কী করবে? আমরা কি আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ফিরিয়ে নিতে বলব? নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে গেলে তো তা-ই করা উচিত, তাই না?

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বার্থ হচ্ছে মূল বিবেচ্য বিষয়। তাই নিরপেক্ষতা তখনই অনুসরণযোগ্য, যখন তা জাতীয় স্বার্থের অনুকূল হয়। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে সরাসরি কোনো পক্ষ না নেওয়াই সম্ভবত আমাদের জাতীয় স্বার্থের অনুকূল। কিন্তু মিয়ানমার সেনাদের বাংলাদেশে প্রবেশ এবং প্রত্যাবাসনে এই নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি না, তা বিবেচনার দাবি রাখে। 

তা ছাড়া সেনা সরকারের প্রতি এই বদান্যতা কোনোভাবে আমাদের স্বার্থে আসছে কি না, তা-ও পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। আপাতদৃষ্টে ব্যাকফুটে থাকা জান্তাও বাংলাদেশের সঙ্গে অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করে চলেছে। পালিয়ে আসা সেনাদের কীভাবে প্রত্যাবাসন করা হবে, তা-ও মিয়ানমারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বাংলাদেশকে তা মেনে নিতে হয়েছে। কিছুদিন আগেও নাফ নদীতে মিয়ানমার নৌবাহিনীর গুলিতে বাংলাদেশের দুজন জেলে আহত হয়েছেন।

গৃহযুদ্ধে জান্তা বাহিনী যদিও ভূমি হারাচ্ছে বিদ্রোহীদের কাছে, চূড়ান্ত ফলাফল কী হবে, তা এখনো কেউ বলতে পারছেন না। আমার ধারণা, কোনো একপর্যায়ে যুদ্ধে একটি অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে এবং সব পক্ষ আলোচনার টেবিলে বসেই যুদ্ধের সমাপ্তি টানবে। যুদ্ধরত জাতিগত দলগুলো অনেকটা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায় করে নিতে পারবে বলে বিশ্লেষকেরা বিশ্বাস করেন। 

চলমান গৃহযুদ্ধে সবচেয়ে চমকপ্রদ ভূমিকা রাখছে চীন। একদিকে সামরিক জান্তার মূল খুঁটি হচ্ছে চীন। অন্যদিকে আরাকান আর্মিসহ যুদ্ধরত জাতিসত্তাগুলোকেও তারা মদদ দিচ্ছে নিজ স্বার্থে, যাতে ভবিষ্যতে পরিবর্তিত পটভূমিতেও চীনের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে। যুদ্ধোত্তর রাখাইনে আরাকান আর্মি এবং তার রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান যে মূল শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে, এ নিয়ে প্রায় সবাই একমত। 

বাংলাদেশের মূল ইস্যু হচ্ছে উদ্বাস্তু শিবিরে অবস্থানরত ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার স্বদেশ (তথা রাখাইনে) প্রত্যাবর্তন। সামরিক জান্তার প্রতি নমনীয় হয়ে ছয় বছরে কিছুই অর্জিত হয়নি। যুদ্ধোত্তর রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে আরাকান আর্মির অবস্থান নিঃসন্দেহে যথাযথ গুরুত্ব পাবে। এ অবস্থায় এমন কিছুই বাংলাদেশের করা উচিত হবে না, যাকে আরাকান আর্মি তাদের প্রতি বৈরী আচরণ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। 

সর্বশেষ পুনরায় আমি আমার দৃঢ় বিশ্বাস ব্যক্ত করছি যে নিজ স্বার্থে বাংলাদেশের উচিত হবে অবিলম্বে আরাকান আর্মির সঙ্গে পর্দার আড়ালে কার্যকর সম্পর্ক তৈরি করা।

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব