যুক্তরাজ্যে ১৪ বছর পর লেবার পার্টি ক্ষমতায় ফিরেছে
যুক্তরাজ্যে ১৪ বছর পর লেবার পার্টি ক্ষমতায় ফিরেছে

মতামত

যুক্তরাজ্যের নতুন সরকার কি শ্রেণিযুদ্ধে জড়াবে

যুক্তরাজ্যে এমন একটি নতুন লেবার সরকার গঠিত হচ্ছে, যার শ্রেণিগঠন আগের সরকারগুলোর চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে।

লেবার পার্টির ছায়া মন্ত্রিসভা সম্পর্কে আমাদের বিশ্লেষণ হলো, কিয়ার স্টারমারের সম্ভাব্য মন্ত্রিসভার প্রায় ৪৬ শতাংশ সদস্য যুক্তরাজ্যের দরিদ্র অথবা মধ্যবিত্ত ‘শ্রমিক শ্রেণি’ভুক্ত মা–বাবার সংসারে বেড়ে উঠেছেন।

বৃহত্তর শ্রমিক শ্রেণিভুক্ত জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতকে বিবেচনায় নিয়ে হিসাব করলে দেখা যাবে, গড় হিসেবে শ্রমিক শ্রেণির যে পরিমাণ প্রতিনিধির মন্ত্রিসভায় থাকার কথা, নতুন মন্ত্রিসভায় তার চেয়ে অনেক বেশি থাকছে। অথচ বিদায়ী কনজারভেটিভ সরকারের মন্ত্রিসভায় শ্রমিক শ্রেণি থেকে উঠে আসা সদস্য ছিল মাত্র ৭ শতাংশ।

বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের কনজারভেটিভ সরকারে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের ৬৯ শতাংশই কোনো না কোনো স্তরে অভিজাত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন। আর স্টারমারের মন্ত্রিসভায় যাঁরা থাকছেন, তাঁদের মাত্র ১৭ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছেন। এটি আগেকার লেবার মন্ত্রিসভার তুলনায়ও উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

টনি ব্লেয়ারের প্রথম মন্ত্রিসভার প্রায় ৩২ শতাংশ সদস্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছিলেন। তাঁর আগেকার হ্যারল্ড উইলসনের মন্ত্রিসভার ৩৫ শতাংশ এবং ক্লেমেন্ট অ্যাটলির মন্ত্রিসভার ২৫ শতাংশ সদস্য প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে এসেছিলেন।

বর্তমানে পুরো যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ ব্যক্তি কোনো না কোনো সময়ে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষিত হয়েছেন।

লেবার সরকারের মন্ত্রিসভার এই বৃহৎ পরিবর্তনকে মূর্ত করেছেন স্বয়ং স্টারমার। শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে তাঁর নাড়ির সম্পর্ক, এমনটা বোঝাতে তিনি নির্বাচনী প্রচারণার সময় বারবার বলেছেন, তিনি একজন টুল মেকারের (কারখানার বিভিন্ন ধরনের পণ্য বানানোয় ব্যবহার্য বিশেষত হস্তচালিত মেশিন বা ‘টুল’ যাঁরা তৈরি করেন) ছেলে।

ঋষি সুনাকের বিরুদ্ধে প্রথম বিতর্কে স্টারমার বলেছিলেন, ‘আমরা এমন অবস্থায় ছিলাম যে আমরা ঠিকমতো আমাদের পরিষেবা বিল মেটাতে পারতাম না। এ কারণে আমি সে ধরনের অবস্থায় পড়া মানুষের মনের অবস্থা বুঝতে পারি।’

এটি ঠিক যে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠে পরে অভিজাত পরিমণ্ডলে পা রাখা বা নেতৃত্বের আসনে বসা ব্যক্তিদের পরিবর্তিত জীবন রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।

‘বর্ন টু রুল: দ্য মেকিং অ্যান্ড রিমেকিং অব দ্য ব্রিটিশ এলিট’ শিরোনামে লেখা আমাদের (এই নিবন্ধের লেখক অ্যারন রিভস ও স্যাম ফ্রিডম্যান) নতুন বইয়ে আমরা এমন তিন হাজারের বেশি লোকের ওপর সমীক্ষা চালিয়েছি যাঁরা ব্রিটেনের ‘উল্লেখযোগ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি’।

স্টারমার সরকারের শ্রেণিগঠন যে তাঁর নীতিনির্ধারণকে প্রভাবিত করবে, ইতিমধ্যেই তার কিছু আলামত দেখা গেছে। যেমন ভাবি এই প্রধানমন্ত্রী প্রাইভেট স্কুলগুলোয় কর বাড়ানো এবং ‘নন-ডোম’ ট্যাক্স অব্যাহতি (নন-ডমেস্টিক, অর্থাৎ যাঁরা যুক্তরাজ্যে থাকেন, কিন্তু অন্য দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন) বাতিল করার বিষয়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে অটল রয়েছেন। এই দুটো এমনই সমস্যা যা অতীতে লেবার সরকারগুলো আমলে নিতে ব্যর্থ হয়েছিল।

এ সমীক্ষায় আমরা দেখেছি, শুধু শ্রমিক শ্রেণি নয়, ব্রিটিশ অভিজাত পরিবার থেকে উঠে আসা নেতাদের মধ্যেও রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বামপন্থার দিকে একধরনের ঝোঁক থাকে। তাঁরা সাধারণত ধনীদের ওপর কর বাড়ানোর পক্ষে থাকেন, দারিদ্র্য হ্রাসের ওপর জোর দেন এবং তাঁদের মধ্যে ব্রিটেনকে একটি বর্ণবাদী দেশ মনে করার প্রবণতা বেশি থাকে।

আমরা যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া প্রতিটি রায় বিশ্লেষণ করেছি এবং দেখেছি যে উচ্চ শ্রেণির পরিবার থেকে উঠে আসা বিচারকদের দেওয়া রায়গুলো (যেমন রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমিত করে বা বড় ব্যবসাকে সমর্থন করে দেওয়া রায়) জনগণের অধিকারের পক্ষে থাকে।

পারিবারিক উৎসের এই প্রভাব রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে অধিকতর তীব্র হতে পারে। শ্রমিক শ্রেণির পরিবার থেকে উঠে আসা লেবার এমপিদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎকারগুলো স্পষ্ট করেছে যে তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়ের শেকড় তাঁদের প্রথম দিককার জীবনের অভিজ্ঞতা এবং তাঁদের বামের দিকে ঝুঁকে থাকা মা–বাবা, দাদা-দাদির প্রভাবের সঙ্গে জোরালোভাবে প্রোথিত।

স্টারমার সরকারের শ্রেণিগঠন যে তাঁর নীতিনির্ধারণকে প্রভাবিত করবে, ইতিমধ্যেই তার কিছু আলামত দেখা গেছে। যেমন ভাবি এই প্রধানমন্ত্রী প্রাইভেট স্কুলগুলোয় কর বাড়ানো এবং ‘নন-ডোম’ ট্যাক্স অব্যাহতি (নন-ডমেস্টিক, অর্থাৎ যাঁরা যুক্তরাজ্যে থাকেন, কিন্তু অন্য দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন) বাতিল করার বিষয়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে অটল রয়েছেন। এই দুটো এমনই সমস্যা যা অতীতে লেবার সরকারগুলো আমলে নিতে ব্যর্থ হয়েছিল।

কিন্তু এর মানে এই নয় যে নতুন সরকার একটা শ্রেণিযুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছে। রাজনীতিবিদেরা ঘন ঘন অবস্থান পাল্টালেও বেশির ভাগ অভিজাত ব্যক্তি তুলনামূলক বেশি সময় নিজেদের নীতিগত অবস্থান ধরে থাকেন। ফলে স্টারমার, দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা অ্যাঞ্জেলা রেনার ও ছায়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওয়েস স্ট্রিটিংয়ের মতো লেবার নেতাদের অভিজাত আমলা ও ব্যবসায়িক জগতের লোকদের সঙ্গে আপন হয়ে কাজ করতে হবে।

আমাদের গবেষণা দেখিয়েছে, গত শতাব্দীতে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যাকগ্রাউন্ডের ব্যক্তিরা ব্রিটিশ অভিজাতদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৮৯০ সালের দশক থেকে ধরলে দেখা যাবে, শীর্ষ সম্পদশালী ১ শতাংশ পরিবার থেকে আসা লোকদের পক্ষে অভিজাতদের সঙ্গে ওঠাবসা ও তাঁদের কাছে পৌঁছাতে পারার সম্ভাবনা সাধারণ লোকদের তুলনায় ২০ গুণ বেশি থাকে।

যুক্তরাজ্যের ৯টি অভিজাত প্রাইভেট স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের একটি গ্রুপ আছে। ব্রিটিশ অভিজাতদের কাছে তাঁদের পৌঁছানোর সম্ভাবনা সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় ৫২ গুণ বেশি। ফলে এই উচ্চস্তরের শ্রেণির প্রসার গুরুত্বপূর্ণ।

নতুন প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এ সত্য বুঝবেন এবং অভিজাত শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণিকে মুখোমুখি করা থেকে বিরত থাকবেন।

  • অ্যারন রিভস অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ও সামাজিক নীতির অধ্যাপক এবং স্যাম ফ্রিডম্যান; লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক

    স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট। ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত