ময়মনসিংহের বলাইশিমুল মাঠের কথা। স্থানীয় লোকজন মাঠ চায়। তাদের সন্তানেরা ওই মাঠে খেলে, কেউ মারা গেলে ওখানে জানাজা পড়ানো হয়। কিন্তু প্রশাসন ওখানে আশ্রয়ণকেন্দ্র করতে চায়। ওখানকার সে সময়ের ইউএনও তো আবালবৃদ্ধবনিতা সবাইকে মামলায় ঝুলাতে চাইলেন। ৬৩ জন গ্রামবাসীর নামে মামলাও দিলেন। স্থানীয় লোকজন সংগঠনের নাম দিলেন বলাইশিমুল মাঠ রক্ষা গণকমিটি। স্লোগান- সংগঠিত জনগণই ইতিহাসের নির্মাতা!
আগে বাজেটে সামরিক খাতে বেশি বরাদ্দ ছিল। আমরা স্লোগান দিতাম: সামরিক খাতে ব্যয় কমাও, শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াও। শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার। এ বছর জনপ্রশাসন খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ হয়েছে। আমাদের তরুণেরা এখন আমলারা এলাকায় জয়েন করার আগেই ফেসবুকে অভিনন্দনবার্তায় ভাসিয়ে দেয়। আমরা বলতে পারিনি—প্রশাসন খাতে ব্যয় কমাও, শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াও। শিক্ষা এখন অধিকার নয়, সামাজিক নিরাপত্তা খাত।
আচ্ছা, ঢাকার উত্তরায় গার্ডারের তলায় যাঁরা মরলেন, তাঁরা অপমৃত্যুর শিকার কেন হবেন? রাষ্ট্রের হাত দিয়ে নাগরিককে মেরে ফেললে কত্ত আরাম। নো বিচার! রূপপুরের দেড় লাখ কোটি টাকার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে আল্লাহ না করুন কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেও বিচার হবে না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইনে কর্তাদের ‘সরল বিশ্বাসে’ পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। সেই ভারতীয় আইন এখনো বহাল। ৭২-এর সংবিধান প্রচলিত আইন নামে তা বহাল রেখেছে।
বিএনপি আমলে কানসাট বিদ্যুৎ আন্দোলনের আগের ঘটনা। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বাংলাদেশের সঙ্গে দায়মুক্তির চুক্তি করতে চেয়েছিল, আমরা রংপুরেই রাস্তায় নেমেছিলাম এর বিরুদ্ধে। আর দায়মুক্তি চুক্তি হয়নি।
আনু মুহাম্মদদের জাতীয় কমিটি বছর দশেক আগেই বিকল্প জ্বালানি ব্যবস্থাপত্র হাজির করেছিল। কীভাবে স্বল্প মূল্যে গ্যাস উত্তোলন, সরবরাহ ও পরিবেশবান্ধব স্বয়ংসম্পূর্ণ জ্বালানিব্যবস্থা দাঁড় করানো যায়, সেগুলো কানে তোলা হয়নি। উইকিলিকসেও ফাঁস হয়ে গিয়েছিল বিদ্যুৎ-জ্বালানির কিছু ঘটনা। সেগুলোও তদন্ত করা হয়নি। আদানির পক্ষ নিয়ে কথা তারাই বলছে। জাতীয় কমিটি রামপাল নিয়ে যা যা বলেছে, তা-ই ফলছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালেই বলেছিলেন, সুন্দরবন আমরা সৃষ্টি করতে পারব না। সুন্দরবন আমাদের রক্ষাকবচ।
পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে—এ কথা বলে গ্যালিলিও পুরো ইউরোপে আগুন জ্বালায়ে দিলেন। ওখানকার খ্রিষ্টান কট্টরপন্থীরা তাঁর শাস্তির দাবিতে এককাট্টা। এ কারণে শাস্তির অপেক্ষায় গ্যালিলিও। পাশে তাঁর এক শিষ্য। দুজনে চুপচাপ। নীরবতা ভেঙে শিষ্য বলছেন, দুর্ভাগা সেই দেশ, যে দেশে বীরের কদর হয় না।
সেদিন ক্রাচ কিনতে গেছি কুড়িগ্রাম হাসপাতালের সামনের এক ফার্মেসিতে। হঠাৎ শুনি, ওষুধ কোম্পানির এক বিক্রয় প্রতিনিধি ফার্মেসির কর্মচারীরে স্যার ডাকছেন। কিছুদিন আগে এক নবিশ ডাক্তারকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করে সেবা চেয়েছিলাম, তিনি তাঁর নিজ ঠোঁটে আঙুল রেখে বলেছিলেন, উঁহু, ভাই না, স্যার। মানে, যার কাছে যার দায়, তাকে ‘স্যার’ বলে তোয়াজ করতে হবে। আমিও বেসরকারি ক্লিনিকে যাই নার্সদের মুখে ‘স্যার’ শুনব বলে।
মৌলিক অধিকার না থাকুক, প্রটোকলের প্রয়োগ চাই। মানুষ বুঝে গেছে তাদের কোনো ইজ্জত নেই, কিন্তু যাদের ইজ্জতের বলে সে ইজ্জতওয়ালা, ইজ্জতের মালিক আজ ইজ্জতহীন।
পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে—এ কথা বলে গ্যালিলিও পুরো ইউরোপে আগুন জ্বালায়ে দিলেন। ওখানকার খ্রিষ্টান কট্টরপন্থীরা তাঁর শাস্তির দাবিতে এককাট্টা। এ কারণে শাস্তির অপেক্ষায় গ্যালিলিও। পাশে তাঁর এক শিষ্য। দুজনে চুপচাপ। নীরবতা ভেঙে শিষ্য বলছেন, দুর্ভাগা সেই দেশ, যে দেশে বীরের কদর হয় না।
তখন উত্তরে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও বললেন, না, দুর্ভাগা সেই দেশ; যেখানে বীরের দরকার হয়।
আমাদের কেন বীরের দরকার হয়? এই দুর্ভাগ্য থেকে কবে উদ্ধার পাব। কেন এমন ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না যে আমরা নিজেরা নিজেদের দেশটার মালিক বলে অনুভব করব?
নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
nahidknowledge1@gmail.com