ইসরায়েল যখন ১০ লাখের ওপর ফিলিস্তিনিকে গাজা ছাড়ার নির্দেশ দিল, তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগল, আর কত হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ এই খুনে লোকজনের দরকার? এটা পরিষ্কার, হামাসের ভয়াবহ হামলার বদলা নিতে চায় ইসরায়েল। ইসরায়েলিদের স্মৃতিতে ৭ অক্টোবর আজীবন ১ হাজার ৩০০ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যার দিন হিসেবে বিবেচিত হবে। আইনগতভাবে বলতে গেলে, এই হামলা নির্লজ্জ ও জঘন্য ধরনের যুদ্ধাপরাধ এবং সে কারণেই বিশ্বনেতারা এই বর্বর সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছেন।
কিন্তু ইসরায়েল যখন বেসামরিক জনগণের ভবন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিল, ফিলিস্তিনি শিশু, নারী ও পুরুষ খুন করল, তখন পশ্চিমা নেতারা আর মুখ খুললেন না। বরং বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ বন্ধ করা কিংবা গাজাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ায় ইসরায়েলের তেমন সমালোচনাই হলো না। যদিও ইসরায়েলের এই কর্মকাণ্ড যুদ্ধাপরাধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কেন ফিলিস্তিনিদের ওপর এই হত্যাযজ্ঞ পশ্চিমা অভিজাতদের বিবেককে নাড়া দেয় না, কিংবা ইসরায়েল বাহিনী সীমা অতিক্রম করে গাজায় প্রবেশ করলেও কেন তাদের কিছুই যায় আসেনি, তার পেছনে কিছু কারণ আছে। সে কারণে প্রতিটি হামলার পর ইসরায়েলি ভাষ্য কী ছিল, তা বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ২ হাজার ২০০ ফিলিস্তিনি নিহত হন, যাদের মধ্যে ৫৫৬ জন ছিল শিশু। ওই একই সময় ৬৪ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছিলেন। ২০১৪ সালে ইসরায়েল এমন অসম ও প্রাণঘাতী সহিংসতা ঘটানোর পরও পশ্চিমা বিশ্ব কেন বিশ্বাস করে যে ইসরায়েল সেনাবাহিনী বিশ্বের সবচেয়ে নৈতিক সেনাবাহিনী? আর ফিলিস্তিনিরা সহিংস ও আগ্রাসী? কেন পশ্চিমা নেতারা প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে যুদ্ধাপরাধের জন্য নিন্দা করে না?
এই প্রশ্নের জবাব এককথায় দেওয়া সম্ভব নয়। তবে অন্যতম কারণ, ইসরায়েল আইনকানুনকে পাশ কাটানোয় অবিশ্বাস্য দক্ষতা অর্জন করেছে। এর ফলে তারা সফলভাবে তাদের ঘটানো সহিংসতাকে ‘নৈতিক’ হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ পায়। তারা আন্তর্জাতিক আইনের অপব্যাখ্যা দিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি করে ও ফাঁকফোকর বের করে ফেলে। এই সমর আইনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে রাষ্ট্রীয় নয় এমন শক্তির থেকে এবং সবলদের দুর্বলের ওপর অগ্রাধিকার দেয়। ফলে গাজার বেসামরিক জনগণের জন্য এই আইন ঢাল হয়ে দাঁড়ায় না।
সুনির্দিষ্ট কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১৪ সালে গাজায় ঢোকার ইসরায়েলি বাহিনীর প্রতি সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল, যাঁরা ইসরায়েলের সতর্কসংকেত মেনে বাড়িঘর ছেড়ে দক্ষিণ চলে যাননি, তাঁদের ওপর সামরিক বাহিনী হামলা চালাতে পারবে। ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সকে একজন সৈন্য বলেন, ‘আসলে সে রকমভাবে কোনো নির্দেশনা থাকে না। তারা বলে দিয়েছে, ওখানে বেসামরিক লোকজনের থাকার কথা নয়। যদি কাউকে দেখো, তাহলে গুলি ছুড়বে।’ ওই ব্যক্তি সৈনিককে হুমকি দিন আর না–ই দিন, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। কারণ, প্রথমত, জায়গাটির নাম গাজা এবং দ্বিতীয়ত, এই ঘটনা যুদ্ধকালীন। সৈনিকদের তারা আরও বলে থাকে, ‘গুলি ছুড়তে ভয় পাবে না।’ তারা বোঝায় যে ওখানে বেসামরিক যে লোকজন রয়েছে, তাদের কেউই যুদ্ধবহির্ভূত নয়।’
দুঃখজনক হলেও সত্য, ইসরায়েল সমর আইন ব্যবহার করেই নিজেদের একটা ‘নৈতিক’ ভাবমূর্তি তৈরি করেছে। সপ্তাহখানেক আগে ইসরায়েল যা করেছে, ২০১৪ সালেও তারা তা-ই করেছিল। তারা ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ছেড়ে দক্ষিণে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। যদিও তারা জানে, যাদের তারা গাজা ছেড়ে যেতে বলছে, তাদের মধ্যে হাজারো বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তি আছে। সরে যেতে তাদের যে সময় দেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়।
ইসরায়েল আরও জানে, ফিলিস্তিনি বেসামরিক জনগণকে সতর্ক করা বা নির্দেশনা দেওয়ার অর্থ, তারা এখন উত্তর গাজায় বেসামরিক জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে অস্বীকার করবে। এ পরিস্থিতিকেই তারা বলছে যুদ্ধবহির্ভূত কোনো বেসামরিক মানুষের অনুপস্থিতি। যদিও এখনো যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় বেসামরিক লোকজনের সংখ্যা বেশি, যাদের পক্ষে অন্যত্র যাওয়া অসম্ভব। জাতিসংঘের ভাষায়, এই জনগোষ্ঠীর একটি অংশ ‘বিরোধী গোষ্ঠী’ বা ‘স্বেচ্ছায় মানবঢাল’ হতে ইচ্ছুক। সমর আইনের কোনো কোনো ব্যাখ্যায় এ ধরনের মানুষকে হত্যা করা যুদ্ধাপরাধ নয়।
যেহেতু এখানে নৈতিকতা; সমর আইন মানা না–মানার সঙ্গে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ ইসরায়েল সেনাবাহিনী, যারা সাধারণ মানুষকে শুধু নিজ ঘরবাড়িতে অবস্থানের জন্য হত্যা করছে, তারা তাদের কাজকে নৈতিকভাবে যুক্তিযুক্ত বলে দাবি করছে।
আইনি এই ব্যাখ্যার পাশাপাশি ইসরায়েল একটি ঔপনিবেশিক ভাষ্য প্রচার করে থাকে। এখানে তারা ফিলিস্তিনিদের ‘মানবপশু’ বলে আখ্যা দেয়। এই ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণা ও আইনের মারপ্যাঁচে তারা ফিলিস্তিনিদের অনৈতিক বর্বর হিসেবে উপস্থাপন করে। তাদের হত্যা করাই উচিত, এমন একটা ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে। আর এর বিপরীতে ইসরায়েলি সভ্য ও নৈতিক ‘যোদ্ধা’দের দাঁড় করায়।
মাসখানেক আগে সিবিএস নিউজের সিক্সটি মিনিটস শিরা এটিং নামের একজন ইসরায়েলি পাইলটের সাক্ষাৎকার নেয়। তিনি ইসরায়েলের বিচারসভার পরিবর্তন নিয়ে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি একজন পাইলটকে উড়তে বলেন ও এমন জায়গায় বোমা ফেলতে বলেন যেখানে শিশুরা রয়েছে, তাহলে রাজনৈতিক নেতাদের এ ধরনের সিদ্ধান্ত দিতে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।’
চিন্তা করে দেখুন, যারা সহিংসতা ঘটাচ্ছে, তাদের স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে নৈতিক গুণসম্পন্ন। তাদেরই ঘটনার শিকার বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। ভুক্তভোগী ইসরায়েলিদের নাম ও জীবনের গল্প আছে। তাঁদের উপস্থাপন করা হচ্ছে মহান হিসেবে, যাঁদের মৃত্যুতে শোক করা যায়। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি ভুক্তভোগীরা একটা নামও পান না, তাঁরা কেবল সংখ্যা হয়েই থাকেন। যেন তাঁরা রক্ত–মাংসের মানুষ নন, যাঁদের জন্য শোক করা যায়। এভাবে যুগের পর যুগ ইসরায়েলি সেনারা ‘নৈতিকতা’র প্রতিভূ হয়ে থাকেন।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে অনূদিত
● নেভ গর্ডন লন্ডনের কুইন ম্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনবিষয়ক অধ্যাপক