জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে একজন বিপ্লবী বলা যাবে না। তবে ৭৩ বছর বয়সী এই সাবেক পর্তুগিজ প্রধানমন্ত্রী যেন বিপ্লবী চে গুয়েভারার মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা উল্টে দেওয়ার সেই স্বপ্ন পূরণের মিশনে নেমেছেন।
গত সপ্তাহে দোহা ফোরামে দেওয়া উদ্বোধনী ভাষণে গুতেরেস অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের নাম ধরে কিছু বলেননি। কিন্তু তিনি নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো দেওয়ার সিদ্ধান্তের যে কড়া সমালোচনা করেছেন তাতে বাইডেনের নাম উল্লেখ করার কোনো দরকার ছিল না।
দোহার ওই অনুষ্ঠানে গুতেরেস বলেন, ‘আমি নিরাপত্তা পরিষদকে মানবিক বিপর্যয় এড়াতে চাপ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম এবং একটি মানবিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার জন্য আমার আবেদন পুনর্ব্যক্ত করেছিলাম।’
গুতেরেস সেখানে যা বলেছেন, তার মানে দাঁড়ায়,—যদি গাজায় কোনো গণহত্যা ঘটে থাকে, তাহলে তার জন্য জো বাইডেন দায়ী।
অবশ্য ইতিমধ্যেই কেউ কেউ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ‘জেনোসাইড জো’ (গণহত্যাকারী জো) বলা শুরু করে দিয়েছেন।
গাজায় ইতিমধ্যেই প্রায় ১৮ হাজার চার শ ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হয়েছেন। এই সংখ্যা ২৮ বছর আগে স্রেব্রেনিকায় গণহত্যায় নিহত মানুষের সংখ্যার দ্বিগুণ। তাই এটি মোটেও হেলাফেলার বিষয় নয়।
আমি নিজে একজন আইনজীবী নই। তবে গত অক্টোবরে আন্তর্জাতিক আইন ও সংঘাত বিষয়ক আট শতাধিক বিশেষজ্ঞ গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী গণহত্যা চালাতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন।
ওই বিশেষজ্ঞরা ইসরায়েলের সম্ভাব্য হামলার তীব্রতা ও ভয়াবহতা নিয়ে জোরালো প্রমাণ পেশ করেছিলেন এবং তাঁরা ইসরায়েলি নেতাদের গণহত্যা সংঘটনের উসকানি দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন।
তবে শেষ পর্যন্ত তাঁরা যত ভয়াবহ পরিস্থিতির পূর্বাভাষ দিয়েছিলেন, সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি তার চেয়ে এখন অনেক ভয়ানক।
যদি একটি আন্তর্জাতিক আদালত এই ঘটনার নিরপেক্ষ বিচার করে এবং তার অস্থায়ী রায় নিশ্চিত করে, তাহলে প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিশ্চিতভাবেই গণহত্যায় মদদ দেওয়ার জন্য দোষী সাব্যস্ত হবেন। সেই রায় বাইডেনকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়েও ভয়ানক অপরাধে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করবে।
এতে অবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই, চলতি সপ্তাহেই বাইডেনের তেজ পড়ে গেছে। তিনি দেরি করে হলেও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে গাজা যুদ্ধের কারণে জনসমর্থন হারানোর বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এবং বিলম্বে হলেও ইসরায়েলের নিরবচ্ছিন্ন বোমাবর্ষণকে ‘নির্বিচার’ বলে উল্লেখ করেছেন।
‘নির্বিচার’ বোমা হামলা সরাসরি একটি যুদ্ধাপরাধ। আর এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, পূর্ণাঙ্গ মার্কিন সমর্থনে এবং মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করেই গাজায় নির্বিচার বোমা হামলা হয়েছে।
দোহা ফোরামে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণার রেশ এতটাই স্পষ্ট ছিল যে, সেটিকে এড়িয়ে যাওয়া একেবারে অসম্ভব। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সাধারণভাবে অনুগত দেশ জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন, তিনি জাতিসংঘে মার্কিন ভেটোর কারণে অত্যন্ত হতাশ।
সাফাদি বলেছেন, ‘ইসরায়েল মনে করছে, তারা খুন-খারাবি করে সহজেই পার পেতে পারে। একটি দেশ সারা পৃথিবীকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখাচ্ছে আর সারা পৃথিবী সেই একটি দেশকে থামাতে একেবারেই অক্ষম হয়ে আছে।’
সাফাদি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে সেই দেশ যে কিনা ইসরায়েলকে তার যাবতীয় কুকর্মের দায় থেকে অব্যাহতি দিয়ে যাচ্ছে।
দোহাতে আমি যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের প্রত্যেকেই একমত, শান্তি আলোচনা পরিচালনায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখার ব্যাপারে আমেরিকানদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যদিও আন্তর্জাতিক শান্তির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্থলাভিষিক্ত কে হতে পারে সে বিষয়ে কোনো চুক্তি হয়নি।
তবে এ বিষয়ে চীন তার হাত খুলতে শুরু করেছে। একটি প্যানেল আলোচনায় চীনের স্টেট কাউন্সিলের প্রাক্তন কাউন্সেলর ড. হুইয়াও ওয়াং গাজা ইস্যুতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন।
দোহা ফোরামে ‘মাল্টি পোলার’ বা বহু পক্ষের একটি গুঞ্জন শোনা গেছে যার অন্তর্নিহিত মানে দাঁড়ায়, মার্কিন আধিপত্যের যুগ শেষ হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের সমাপ্তিসূচক এই ‘মাল্টি পোলার’ শব্দবন্ধটি রাশিয়া এবং ইরান উভয়ের কাছে সুমিষ্ট সংগীতের মতো মনে হতে পারে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুসাইন আমিন আবদুল্লাহিয়ান অনলাইনে ওই ফোরামে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন।
ইতিহাসের এক বিস্ময়কর মোচড়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ব্রিটেন নেতানিয়াহুকে যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতাদানের মাধ্যমে তাদের নিজেদের চালু করা কথিত উদার বিশ্ব ব্যবস্থাকেই অসম্মান করেছে।
গাজা পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা দোহা বিতর্কের প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছিল।
সেখানে জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস তাঁর আলোচনায় বলেছেন, গাজার ভয়ংকর ঘটনায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের এই ব্যর্থতা প্রমাণ করেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবর্তিত কথিত উদার বিশ্ব ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী নিরাপত্তা কাঠামোর জরুরি সংস্কারের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, এই কাঠামো খুবই দুর্বল এবং পুরোনো। এর মাধ্যমে ৮০ বছর আগেকার একটি অকার্যকর ব্যবস্থা চালু আছে বলে প্রমাণিত হচ্ছে।
আন্তোনিও গুতেরেস হতাশার সুরে বলেছেন, নিরাপত্তা পরিষদ ভূকৌশলগত বিভাজনে একেবারে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
ইতিহাসের এক বিস্ময়কর মোচড়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ব্রিটেন নেতানিয়াহুকে যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতাদানের মাধ্যমে তাদের নিজেদের চালু করা কথিত উদার বিশ্ব ব্যবস্থাকেই অসম্মান করেছে।
এই দোহা সম্মেলন দেখিয়েছে, ফিলিস্তিনি জনগণের সাহস, দুর্ভোগ এবং তাঁদের সহিষ্ণুতা বিশ্ব ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে খোদ জাতিসংঘের মহাসচিব সেই ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে বাগ্মী কণ্ঠে পরিণত হয়েছেন।
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে অনূদিত
পিটার ওসবোর্ন মিডল ইস্ট আইয়ের নিয়মিত কলাম লেখক